Wednesday, April 11, 2012

বাঙ্গালীর চাষাবাদ বনাম দ্রব্যমূল্য


ছোট বেলাটা আমার গ্রামে কেটেছে। তখন আমার একখণ্ড জমিও ছিল, আমাদের জমিগুলোর মাঝে আমার জমিটিই ছিল সবচেয়ে সুন্দর। সুন্দর এই কারণে যে এই জমিটি ছিল তিন কোনা বিশিষ্ট। অবশ্য এই তিন কোনা হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল আমাদের গ্রামের গরুগুলোর। গরুগুলো গণিত না পড়েই বুঝতে পেরেছিল ত্রিভুজের দুই বাহুর সমষ্টি তৃতীয় বাহু অপেক্ষা বৃহত্তর। অর্থাৎ গরুগুলো আমার জমির দুই পাড় ব্যবহার না করে কোনাকোনী ভাবে চলাচল করতো। একারণেই আমার জমিটি ছিল তিন কোনা বিশিষ্ট।


ছবিটি নিজ হাতে তোলা, ব্যবহার করতে চাইলে অনুমতি নিতে হবে


আমার সেই জমিতে চাষ করা হতো মরিচ, পেয়াজ, ধনিয়া সজ, রসুন, সরিষা, বিভিন্ন ধরনের ডাল ইত্যাদি রবিশস্য। তখন একটি দেখার মতোই দৃশ্য ছিল। মরিচের দিনে গাছে গাছে ভরে যেত সাদা ফুলে। সেই ফুল এক সময় রূপ নিত সবুজ মরিচে। কাচা মরিচ বড় হলে বাজারে বিক্রি করা হতো, গাছে যা অবশিষ্ট থাকতো তা একসময় লাল হয়ে যেত। এগুলো সংগ্রহ করে শুকিয়ে রাখা হতো। এই শুকনা মরিচ আমাদের সারা বছরের মরিচের চাহিদা পূরণ করতো।

আমরা দেখতাম শীতের দিনে পেয়াজ গাছে পেয়াজ পাতার আভাস। এই পেয়াজ পাতা দিয়ে রান্না করা হতো তরকারী। আমরা অন্যান্য খাবারের সাথেও এই মরিচের পাতা ব্যবহার করতাম। একবার মনে করে দেখুন তো পেয়াজ পাতা দিয়ে বানানো আলু ভর্তার কথা কিংবা ঝালমুড়ির কথা। তখন পেয়াজ পাতা ছাড়া এগুলো কল্পনাই করা যেত না। অনেক সময় শুধু মাত্র এই পাতা দিয়েই তৈরি করা হতো তরকারী। পেয়াজ বড় হলে একটি বিশেষ প্রক্রিয়া তা সংরক্ষণ করা হতো। যা চলতো বছরের সারাটা সময়।

কিংবা রসুনের কথাই ধরা যাক, সাদা সাদা রসুনগুলো যখন এক সাথে বেধে রাখা হতো তখন এর সৌন্দর্য হার মানাতো যে কোন সাদা ফুলের সৌন্দর্যকে।


আমার নাকে আজও লেগে আছে ধনিয়া সজের ফুলের গন্ধ। এর লম্বা লম্বা ডাটার উপর ফুটে থাকা একগুচ্ছ ফুলকে মনে হতো শত গোলাপের পাপড়ি। এর মন কাড়া গন্ধ পাগল করে দিত আমাদের। তখন অবশ্য ধনে পাতার এতো চল ছিল না, কিন্তু চারদিক থেকে আসা এই সজের গন্ধ আমাদের ধনে পাতার চাহিদা মিটিয়ে দিত।

কিছু হলেই আমরা বলি চোখে সরিষা ফুল দেখছে, কিন্তু সরিষা ফুলের সেই সৌন্দর্য যে দেখেছে সেই জানে এর রূপের কথা। যখন জমিতে সরিষার চাষ হতো তখন চারদিক ভরে যতো হলুদে হলুদে। সে এক দেখার মতো দৃশ্য। যা লিখে প্রকাশ করার নয়। নিজের চোখে যে দেখতে পায়নি সেই সৌন্দর্য সে সত্যিই অনেক কিছু মিস করেছে।

আর ডালের কথা কি বলবো, শীতের রাতে পরিপক্ক ডাল পুরিয়ে আমরা আমাদের মতো করে বারবিকিউ করতাম। ডাল, গম ইত্যাদি দিয়ে তখন গ্রাম্য বারবিকিউ করা হতো। বাড়ীর উঠোনে আগুন ধরিয়ে তাতে ডাল গমকে পুড়িয়ে খাওয়া হতো। এর স্বাদ যেন আজও মুখে লেগে আছে। কোথায় হারালো সেই সব সোনালী দিন?

এখন ফিরে আসি বর্তমান সময়ে। উল্লেখিত কৃষি পণ্যগুলো আজও বাজারে পাওয়া যায়, কিন্তু দিন দিন এগুলোর দাম আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে। এর কারণ কি হতে পারে?

আমার সেই জমিটি আজও আছে, কিন্তু জমিতে চাষাবাদের ধরন পাল্টে গিয়েছে। সেই জমিতে এখন চাষ করা হয় ধানের। বছরে দুই বার ধান আবাদ করা হয়। আমরা মাছে ভাতে বাঙ্গালী, তাই আমাদের জন্য ধানের আবাদ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শুধু ধান খাওয়ার উপায় আমাদের জানা নাই, তাই অন্যান্য সবজি, রবিশস্য আমাদের প্রয়োজন। যেহেতু আমাদের দেশে আমরা বেশির ভাগ জমিতে ধান আবাদ করছি তাই‍ ঐসব শস্য আমাদের আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কিনতে হচ্ছে। এর ফলে নির্ভর করতে হচ্ছে দ্বিতীয় কোন পক্ষের উপর। যারা ইচ্ছে করলে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে ঐ সব পণ্যের বাজার মূল্যকে।

ধান আমাদের প্রধান শস্য, তাই ধানের আবাদ বাড়ানো দরকার। কিন্তু গত কয়েক বছরে ধানের আবাদ এই পরিমান বাড়েনি যে আমরা তা রপ্তানি করতে পারি। নানাবিধ কারণে আমাদের কৃষকরা ধান চাষের পদ্ধতিকে আধুনিক করতে পারেনি। যার ফলে আমরা আমাদের ধানের চাষ করে কাঙ্খিত পরিমান ফসল ফলাতে পারিনি। ফলে দেশে যে পরিমান ধানের আবাদ হচ্ছে তা দিয়ে আমাদের নিজেদের প্রয়োজন মিটাতে পারিনি। তাই এখনও আমাদেরকে অন্যান্য দেশ থেকে ধান আমদানী করতে হচ্ছে।

ফলে দেখা যাচ্ছে আমরা দুই দিক থেকেই ক্ষতির মুখে পড়ছি। না পারছি ধানের আবাদকে কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রায় নিয়ে যেতে না পারছি আমাদের রবিশস্যের আবাদ করে কাঁচামরিচের দাম হাতের নাগালে রাখতে।

তাই এখন আমাদের ভাবার সময় এসেছে, প্রতি বছর শুধু ধান চাষ করবো, নাকি এর সাথে সাথে অন্যান্য রবিশস্যের আবাদ করে দেশের প্রয়োজন মিটাবো। কমিয়ে আনবো অন্যান্য দেশের উপর নির্ভরতার হার।

Creative Commons License
আপনার মন্তব্য লিখুন

ফেসবুক লাইক ও শেয়ার