সংবাদটা সকালেই পেলাম, আমাদের প্রিয় স্যার, আলতাফ স্যার আর এই জগতে নেই। সুমনের কাছ থেকে সংক্ষিপ্ত মেসেজ পেয়েছি। কল দিয়ে বিস্তারিত জানার সুযোগ হয়নি, কোন মতে রেডি হয়ে অফিসে আসতে হয়েছে। অফিসে আসার পথে ফোন দিয়েও খোঁজ নিতে পারিনি, অফিস থেকে একের পর এক কলের জবাব দিতে হয়েছে।
আলতাফ স্যার ছিলেন আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন জনপ্রিয় শিক্ষক। স্যারের বয়স হয়েছিল, তার মৃত্যু একটা স্বাভাবিক ঘটনা, তবুও শুনে মনটা খুব খারাপ হল।
ইচ্ছে ছিল স্যারের জানাজায় শরিক হতে, কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং থাকায় সেটা সম্ভব হল না। সকালবেলায় অফিসে গিয়েই কাজে বসতে হল। মনটা খুব খারাপ থাকায় কাজেও মন বসাতে পারছি না, টুকটাক ভুল হয়ে যাচ্ছে।
আলতাফ স্যার ছিলেন আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন জনপ্রিয় শিক্ষক। স্যারের বয়স হয়েছিল, তার মৃত্যু একটা স্বাভাবিক ঘটনা, তবুও শুনে মনটা খুব খারাপ হল।
ইচ্ছে ছিল স্যারের জানাজায় শরিক হতে, কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং থাকায় সেটা সম্ভব হল না। সকালবেলায় অফিসে গিয়েই কাজে বসতে হল। মনটা খুব খারাপ থাকায় কাজেও মন বসাতে পারছি না, টুকটাক ভুল হয়ে যাচ্ছে।
দশটার দিকে এককাপ কফি নিয়ে বসলাম, হাতে খবরের কাগজ, এটা ওটা পড়ার চেষ্টা মাত্র। কোন খবরই মনকে টানতে পারলো না। শুধু চোখ বুলিয়ে যাওয়া।
মন পড়ে আছে সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাসগুলোতে। স্যারের সাথে কত মজার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। স্যার সবাইকে সমানভাবে ভালোবাসত, তবুও সবাই মনে করত তাকেই হয়ত বেশি ভালোবাসে।
আমাদের বিদ্যালয়টি এখন সরকারি হলেও আগে এটা বেসরকারি বিদ্যালয় ছিল। স্যারের দাদা গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। সবাই তার কথা মান্যও করত। সবার পরামর্শে গ্রামের শিশুদের পড়াশোনা করতে যাতে সুবিধা হয়, তাই নিজের জমিতে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিল।
প্রিয় নাতি পড়াশোনা করে যেন বাইরে চলে না যায় সেজন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে আলতাফ স্যারকেই যোগদান করান। তখন মাত্র ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছেন আলতাফ স্যার। কত আশা ছিল ভার্সিটিতে পড়াশোনা করবে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষাও দিয়েছিল। বন্ধুদের কাছে শুনেছিল তার নাকি চান্সও হয়েছিল, ভর্তি হলে বাংলায় অনার্স করতে পারত কিন্তু দাদার আবেগের সামনে বিষয়টা উপস্থাপনও করতে পারেনি।
সেই থেকে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এর মাঝে কত জল গড়িয়ে পড়ল, কতজন এই স্কুলে শিক্ষক হয়ে আসল, আবার অনেকে ভালো চাকরি নিয়ে চলেও গেল, আলতাফ স্যার এখানেই রয়ে গেলেন।
স্যারের হাত দিয়ে আমাদের স্কুলে থেকে কতশত শিক্ষার্থী বের হয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। বিদ্যালয়ের একটা সুনাম থাকায় দুর থেকেও শিক্ষার্থী পড়তে আসত। এখান থেকে পাশ করে অনেকে অনেক জায়গায় সুনামের সাথে চাকরি করছে।
স্যারের বয়স হয়ে গিয়েছে। অনেকদিন হয় স্যারের সাথে যোগাযোগ করা হয়নি, দুই বছর আগে রিটায়ার্ড করেছেন। এক ছেলে পলিটেকনিক পাশ করে একটা সোলার কম্পানিতে চাকরি করে। কয়েকবার সরকারি চাকরির চেষ্টা করেছে। কিন্তু সব জায়গায় যে ডিমান্ড করা হয় সেটা স্যার কখনও দিবে না, তাই চাকরিও হয়নি। সে কখনও চায়নি তার ছেলের এইভাবে চাকরি হোক।
মনটা খুব ছটফট করছে। স্যারের জানাজায় থাকতে পারলাম। কত কি মনের কোনে উকি দিচ্ছে। দুপুরের খাওয়াটাও ঠিক মতো হয়নি, আজই কি যে হল, একের পর এক জরুরী মিটিং। মন ভালো না থাকলে কাজ করেও শান্তি নেই। দুপুরের পর আবারও সুমনের ফোন। ভাবলাম যাক এবার অন্তত বিস্তারিত জানা যাবে।
দোস্ত তোর কাছে কি সাকিবের ফোন নম্বর আছে? ওরে খুব দরকার। স্যারের বিষয়ে একটু কথা বলা দরকার।
সুমনের কথায় একটু খটকা লাগল। সাকিব আমাদের বাল্যকালের বন্ধু। পুলিশ বাহিনীতে সুনামের সাথে চাকরি করছে। মাঝে মাঝে আড্ডা হয়। তবে কাজের চাপে দেখা হয় খুবই কম। স্যারের মৃত্যুর সাথে সাকিবের কি দরকার। আমি কথা না বাড়িয়ে সাকিবের ফোন নম্বর দিয়ে দিলাম। সুমন কিছু না বলে লাইন কেটে দিল। ভাবলাম থাক, পরে বিস্তারিত জানি, সুমনের তাড়া দেখে আর কথা বলা হলো না।
ঐদিন কাজের চাপে আর সুমনের সাথে কথা বলা হল না। জীবন কারও জন্য থেমে থাকে না। আমার আরেক বন্ধু লতিফ বলত, বাঙ্গালীর শোক আর প্রেমের ছ্যাঁকা তিনদিনের বেশি থাকে না। আমারও হয়ত তাই। কাজের চাপে স্যারের কথা ভুলেই গিয়েছি। চারদিন পর অফিসে রেজিস্ট্রি ডাকে চিঠি এলো। সচরাচর এই সময়ে চিঠি লেখে না কেউ। স্বাক্ষর করে চিঠি নিয়ে দেখি প্রেরকের ঘরে স্যারের নাম, হাতের লেখা সেই আগের মতই আছে। মুক্তোর মত ঝক্ঝকে। দেখে আত্মাটা ছ্যাৎ করে উঠলো। স্যার গত হয়েছেন চারদিন হলো। আজ চিঠি এসেছে। প্রেরণের তারিখ দেখলাম মৃত্যুর কয়েকদিন আগেই পাঠিয়েছে। রেজিস্ট্রি করা চিঠি এতদিন পরে আসার কথা না। জানি না কেন এত দেরি হলো।
স্যার হঠাৎ হঠাৎ এরকম করতেন। শিক্ষার্থীদের মাঝে মাঝে চিঠি লিখতেন, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা থাকত। স্যার অনেক বিষয় নিয়ে ভাবতেন, তারই প্রকাশ থাকত চিঠিতে।
আজকের চিঠিটা একটু ভিন্ন লাগল।
চিঠির শুরুতেই খটকা,
প্রিয় মুশফিক,
আমি ব্যর্থ।!!
চাকরি জীবনে কখনও কোন কিছু নিয়ে আপস করিনি, কতশত প্রলোভন পেয়েছি, কিন্তু শিক্ষকতাকে মহৎ পেশা হিসাবে দেখে এটা ছেড়ে কখনও যাইনি। তোমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, আমাদের স্কুল সরকারি হওয়ার সময় টাকা চেয়েছিল কর্তৃপক্ষ, এটা নিয়ে কত আন্দোলন করে শেষ পর্যন্ত টাকা ছাড়াই আমরা সফল হলাম।
তুমি হয়ত ভাবছ, তোমাকে কেন এসব বলছি। এতবছর চাকরি করে শেষ বয়সে এসে মনে হল আমি ব্যর্থ। মনে হল এই ব্যর্থতার গল্প তোমাকে বলা দরকার। তুমি যেহেতু লেখালেখি কর, তোমার গল্প অনেকেই পড়ে, তাই তোমার মাধ্যমে আমার গল্পটা বলা দরকার।
কলেজ শেষ করার পর যখন আমি রাজশাহীতে ভর্তি হতে যাই তখন চোখে কত স্বপ্ন ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করব, জীবনটা অন্য রকম ভাবে সাজাবো। সবই ঠিক ছিল, বাধ সাধল আমার দাদা। তিনি ভাবলেন তার গ্রামের সবার জন্য এমন কিছু করবে যেখান থেকে সবাই উপকৃত হতে পারে। এর জন্য তিনি গ্রামে স্কুল স্থাপন করলেন।
আর এই স্কুল চালানোর দায়িত্ব দিলেন আমাকে। নিজের স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিলাম দাদার চাওয়াকে পূর্ণ করতে। কয়েকজন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হল আমার যাত্রা। প্রথম প্রথম কাজটা বিরক্তিকর মনে হত।
নিজে যখন ছাত্র ছিলাম তখন শিক্ষকদের অনেক যন্ত্রনা দিয়েছি, তার সবই যেন শিক্ষক হিসাবে ফেরত পাচ্ছি। তবে যন্ত্রণা একসময় ভালো লাগতে শুরু করলো। একঝাঁক নতুন প্রাণ আমার হাত ধরে কত কি শিখতে পারছে। মনপ্রাণ ঢেলে দিলাম ওদের পেছনে। যেখানে যত কিছু শেখা যায়, ঘুরে ঘুরে শিখতে শুরু করলাম। চাকরির পাশাপাশি ডিগ্রি পাশটাও করা হলো। আর স্কুলটাকেও ঢেলে সাজালাম। চারদিকে সুনাম ছড়িয়ে পড়লো, স্কুল বড় হলো। শিক্ষক বাড়ালাম, নিজের ধ্যানজ্ঞান সবই ঢেলে দিলাম স্কুলের উন্নয়নে। স্কুল চালাতে বাঁধা আসেনি তা নয়, বাঁধাও আসতো। সবই কিভাবে যেন পার হয়ে যাই।
তবে বেশি কষ্ট লেগেছিল সরকারি স্কুল হতে গিয়ে। তখন কেমন যেন দোটানায় পড়েছিলাম। সব কিছু ঠিক তবুও সরকারি হচ্ছে না। একদিকে এতগুলো শিক্ষার্থীর জীবন, শিক্ষকদের ক্যারিয়ার অন্য দিকে অন্যায়ের সাথে আপস। হয়ত টিকে থাকতে পারতাম না, তবে তোমাদের আন্দোলনের কারণে সেই যাত্রায় পার পেয়ে গেলাম।
আমি সারাজীবন তোমাদের শিখিয়েছি অন্যায়কে প্রশ্রয় না দিতে। অসাধু উপায়ে টাকা কামাইকে ঘেন্না করতে শিখিয়েছি। এটা নিয়ে আমার গর্বের অন্ত ছিল না। কিন্তু আজ জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে মনে হল আমি ব্যর্থ।
তুমি তো জানই, দুবছর হলো আমার চাকরি শেষ হয়েছে। এতবছর সরকারি চাকরি করে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। কিন্তু তার ফলাফল কি? ভেবেছিলাম শেষ বয়সে পেনশনের টাকাটা পেলে পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে থাকতে পারব। আমার এতদিনের জমানো অর্থ ভালো কাজে লাগাতে পারব। ইচ্ছে ছিল পেনশনের টাকা পেলে স্কুলে একটা লাইব্রেরিও স্থাপন করে পড়ার পরিবেশ তৈরি করব। কিন্তু সেই ভাবনা ভাবনায়ই রয়ে গেল।
আজ দুবছর ধরে নিয়মিত অফিসে ঘুরে ঘুরে আমি আজ ক্লান্ত। ক্লান্তিও হয়ত দূর হয়ে যেত। অফিসের পিয়ন আমাকে নিয়মিতই বলে আসছে, তাকে কিছু টাকা দিলে এই ঘোরাঘুরি আর করতে হবে না, আমি বলে এসেছি নিজের টাকা নিজে তুলব এতে ঘুষ কেন দিতে হবে। ও অল্প শিক্ষিত, তাই ভাবতাম ওর শিক্ষার অভাব। তাই ওর পক্ষে এরকম প্রস্তাব দেওয়া অসম্ভব না।
তোমাকে আজ এই চিঠি লিখছি, হয়ত এটাই আমার শেষ লেখা, সব কিছু ঠিক থাকলে আগামীকাল সকালটা আর দেখা হবে না। চিঠি আমি আজ পোস্ট করব এমনভাবে যেন তুমি একটু দেরিতে পাও।
গতকাল অফিসে গিয়েছিলাম, অফিসে যার হাতে সকল বিষয় নির্ভর করত সে আমার ছাত্র। তাই আশা ভরসা বেশি ছিল, ও আমার অনেক প্রিয় একজন ছাত্র ছিল, মনে আছে, ওর এসএসসি পরীক্ষার ফিস দেওয়ার টাকা ছিল না তখন আমি সহায়তা করেছিলাম। তাই মনের কোনে একটা সুপ্ত আশা ছিল, হয়ত আমার কাজটা হয়ে যাবে। ওর সাথে যতবার দেখা হয়েছে, ও যেভাবে আশ্বাস দিত মনে হত ঠিকই তো আছে। সরকারি কাজ দেরি হতেই পারে। ওর প্রতি বিশ্বাস ছিল, আর যাই হোক ঘুষ দিয়ে আমার পেনশনের টাকা ছাড়াতে হবে না। আজ আমার সব বিশ্বাস টলে গেল, জানতে পারলাম, আমার সব আটকে রেখেছে আমারই প্রিয় শিক্ষার্থী। নিজে টাকা চাইতে পারছে না, তাই ভায়া হয়ে টাকা দাবি করছে।
এত বছর শিক্ষকতা করে, শিশুদের শিক্ষার আলোতে আলোকিত করে, আজ সত্যি মনে হল, আমি ব্যর্থ, আমি শেখাতে পারিনি কীভাবে সৎ থাকতে হয়। ওর বাবা মা বিশ্বাস করে আমার হাতে ওকে তুলে দিয়েছিল যাতে আমি মানুষের মত মানুষ করতে পারি। আমি ওকে কাদামাটি থেকে শক্ত মাটিতে পরিনত করতে সহায়তা করেছি, কিন্তু মানুষের মত মানুষ করতে পারিনি। তাই এই ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে আজ সিদ্ধান্ত নিলাম আমার বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।
ভালো থেকো, মানুষের মত মানুষ হোক তোমার সন্তানেরা।
তোমার প্রিয় আলতাফ স্যার।
সুমনকে ফোন দিলাম, জানলাম সেদিন সাকিবকে ফোন দিতে হয়েছিল, স্যারের লাশ যাতে ময়নাতদন্তের জন্য কাঁটাছেড়া না করা হয় সেটার অনুরোধ জানাতে। স্যারের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে হয়নি। সবাই জানে কোন এক অজানা কারণে স্যার বেছে নিয়েছিলেন আত্মহননের পথ।
আর কেউ না জানলেও আজ আমি জানি স্যারের এই মৃত্যুর রহস্য।
মন পড়ে আছে সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাসগুলোতে। স্যারের সাথে কত মজার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। স্যার সবাইকে সমানভাবে ভালোবাসত, তবুও সবাই মনে করত তাকেই হয়ত বেশি ভালোবাসে।
আমাদের বিদ্যালয়টি এখন সরকারি হলেও আগে এটা বেসরকারি বিদ্যালয় ছিল। স্যারের দাদা গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। সবাই তার কথা মান্যও করত। সবার পরামর্শে গ্রামের শিশুদের পড়াশোনা করতে যাতে সুবিধা হয়, তাই নিজের জমিতে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিল।
প্রিয় নাতি পড়াশোনা করে যেন বাইরে চলে না যায় সেজন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে আলতাফ স্যারকেই যোগদান করান। তখন মাত্র ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছেন আলতাফ স্যার। কত আশা ছিল ভার্সিটিতে পড়াশোনা করবে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষাও দিয়েছিল। বন্ধুদের কাছে শুনেছিল তার নাকি চান্সও হয়েছিল, ভর্তি হলে বাংলায় অনার্স করতে পারত কিন্তু দাদার আবেগের সামনে বিষয়টা উপস্থাপনও করতে পারেনি।
সেই থেকে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এর মাঝে কত জল গড়িয়ে পড়ল, কতজন এই স্কুলে শিক্ষক হয়ে আসল, আবার অনেকে ভালো চাকরি নিয়ে চলেও গেল, আলতাফ স্যার এখানেই রয়ে গেলেন।
স্যারের হাত দিয়ে আমাদের স্কুলে থেকে কতশত শিক্ষার্থী বের হয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। বিদ্যালয়ের একটা সুনাম থাকায় দুর থেকেও শিক্ষার্থী পড়তে আসত। এখান থেকে পাশ করে অনেকে অনেক জায়গায় সুনামের সাথে চাকরি করছে।
স্যারের বয়স হয়ে গিয়েছে। অনেকদিন হয় স্যারের সাথে যোগাযোগ করা হয়নি, দুই বছর আগে রিটায়ার্ড করেছেন। এক ছেলে পলিটেকনিক পাশ করে একটা সোলার কম্পানিতে চাকরি করে। কয়েকবার সরকারি চাকরির চেষ্টা করেছে। কিন্তু সব জায়গায় যে ডিমান্ড করা হয় সেটা স্যার কখনও দিবে না, তাই চাকরিও হয়নি। সে কখনও চায়নি তার ছেলের এইভাবে চাকরি হোক।
মনটা খুব ছটফট করছে। স্যারের জানাজায় থাকতে পারলাম। কত কি মনের কোনে উকি দিচ্ছে। দুপুরের খাওয়াটাও ঠিক মতো হয়নি, আজই কি যে হল, একের পর এক জরুরী মিটিং। মন ভালো না থাকলে কাজ করেও শান্তি নেই। দুপুরের পর আবারও সুমনের ফোন। ভাবলাম যাক এবার অন্তত বিস্তারিত জানা যাবে।
দোস্ত তোর কাছে কি সাকিবের ফোন নম্বর আছে? ওরে খুব দরকার। স্যারের বিষয়ে একটু কথা বলা দরকার।
সুমনের কথায় একটু খটকা লাগল। সাকিব আমাদের বাল্যকালের বন্ধু। পুলিশ বাহিনীতে সুনামের সাথে চাকরি করছে। মাঝে মাঝে আড্ডা হয়। তবে কাজের চাপে দেখা হয় খুবই কম। স্যারের মৃত্যুর সাথে সাকিবের কি দরকার। আমি কথা না বাড়িয়ে সাকিবের ফোন নম্বর দিয়ে দিলাম। সুমন কিছু না বলে লাইন কেটে দিল। ভাবলাম থাক, পরে বিস্তারিত জানি, সুমনের তাড়া দেখে আর কথা বলা হলো না।
ঐদিন কাজের চাপে আর সুমনের সাথে কথা বলা হল না। জীবন কারও জন্য থেমে থাকে না। আমার আরেক বন্ধু লতিফ বলত, বাঙ্গালীর শোক আর প্রেমের ছ্যাঁকা তিনদিনের বেশি থাকে না। আমারও হয়ত তাই। কাজের চাপে স্যারের কথা ভুলেই গিয়েছি। চারদিন পর অফিসে রেজিস্ট্রি ডাকে চিঠি এলো। সচরাচর এই সময়ে চিঠি লেখে না কেউ। স্বাক্ষর করে চিঠি নিয়ে দেখি প্রেরকের ঘরে স্যারের নাম, হাতের লেখা সেই আগের মতই আছে। মুক্তোর মত ঝক্ঝকে। দেখে আত্মাটা ছ্যাৎ করে উঠলো। স্যার গত হয়েছেন চারদিন হলো। আজ চিঠি এসেছে। প্রেরণের তারিখ দেখলাম মৃত্যুর কয়েকদিন আগেই পাঠিয়েছে। রেজিস্ট্রি করা চিঠি এতদিন পরে আসার কথা না। জানি না কেন এত দেরি হলো।
স্যার হঠাৎ হঠাৎ এরকম করতেন। শিক্ষার্থীদের মাঝে মাঝে চিঠি লিখতেন, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা থাকত। স্যার অনেক বিষয় নিয়ে ভাবতেন, তারই প্রকাশ থাকত চিঠিতে।
আজকের চিঠিটা একটু ভিন্ন লাগল।
চিঠির শুরুতেই খটকা,
প্রিয় মুশফিক,
আমি ব্যর্থ।!!
চাকরি জীবনে কখনও কোন কিছু নিয়ে আপস করিনি, কতশত প্রলোভন পেয়েছি, কিন্তু শিক্ষকতাকে মহৎ পেশা হিসাবে দেখে এটা ছেড়ে কখনও যাইনি। তোমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, আমাদের স্কুল সরকারি হওয়ার সময় টাকা চেয়েছিল কর্তৃপক্ষ, এটা নিয়ে কত আন্দোলন করে শেষ পর্যন্ত টাকা ছাড়াই আমরা সফল হলাম।
তুমি হয়ত ভাবছ, তোমাকে কেন এসব বলছি। এতবছর চাকরি করে শেষ বয়সে এসে মনে হল আমি ব্যর্থ। মনে হল এই ব্যর্থতার গল্প তোমাকে বলা দরকার। তুমি যেহেতু লেখালেখি কর, তোমার গল্প অনেকেই পড়ে, তাই তোমার মাধ্যমে আমার গল্পটা বলা দরকার।
কলেজ শেষ করার পর যখন আমি রাজশাহীতে ভর্তি হতে যাই তখন চোখে কত স্বপ্ন ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করব, জীবনটা অন্য রকম ভাবে সাজাবো। সবই ঠিক ছিল, বাধ সাধল আমার দাদা। তিনি ভাবলেন তার গ্রামের সবার জন্য এমন কিছু করবে যেখান থেকে সবাই উপকৃত হতে পারে। এর জন্য তিনি গ্রামে স্কুল স্থাপন করলেন।
আর এই স্কুল চালানোর দায়িত্ব দিলেন আমাকে। নিজের স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিলাম দাদার চাওয়াকে পূর্ণ করতে। কয়েকজন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হল আমার যাত্রা। প্রথম প্রথম কাজটা বিরক্তিকর মনে হত।
নিজে যখন ছাত্র ছিলাম তখন শিক্ষকদের অনেক যন্ত্রনা দিয়েছি, তার সবই যেন শিক্ষক হিসাবে ফেরত পাচ্ছি। তবে যন্ত্রণা একসময় ভালো লাগতে শুরু করলো। একঝাঁক নতুন প্রাণ আমার হাত ধরে কত কি শিখতে পারছে। মনপ্রাণ ঢেলে দিলাম ওদের পেছনে। যেখানে যত কিছু শেখা যায়, ঘুরে ঘুরে শিখতে শুরু করলাম। চাকরির পাশাপাশি ডিগ্রি পাশটাও করা হলো। আর স্কুলটাকেও ঢেলে সাজালাম। চারদিকে সুনাম ছড়িয়ে পড়লো, স্কুল বড় হলো। শিক্ষক বাড়ালাম, নিজের ধ্যানজ্ঞান সবই ঢেলে দিলাম স্কুলের উন্নয়নে। স্কুল চালাতে বাঁধা আসেনি তা নয়, বাঁধাও আসতো। সবই কিভাবে যেন পার হয়ে যাই।
তবে বেশি কষ্ট লেগেছিল সরকারি স্কুল হতে গিয়ে। তখন কেমন যেন দোটানায় পড়েছিলাম। সব কিছু ঠিক তবুও সরকারি হচ্ছে না। একদিকে এতগুলো শিক্ষার্থীর জীবন, শিক্ষকদের ক্যারিয়ার অন্য দিকে অন্যায়ের সাথে আপস। হয়ত টিকে থাকতে পারতাম না, তবে তোমাদের আন্দোলনের কারণে সেই যাত্রায় পার পেয়ে গেলাম।
আমি সারাজীবন তোমাদের শিখিয়েছি অন্যায়কে প্রশ্রয় না দিতে। অসাধু উপায়ে টাকা কামাইকে ঘেন্না করতে শিখিয়েছি। এটা নিয়ে আমার গর্বের অন্ত ছিল না। কিন্তু আজ জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে মনে হল আমি ব্যর্থ।
তুমি তো জানই, দুবছর হলো আমার চাকরি শেষ হয়েছে। এতবছর সরকারি চাকরি করে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। কিন্তু তার ফলাফল কি? ভেবেছিলাম শেষ বয়সে পেনশনের টাকাটা পেলে পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে থাকতে পারব। আমার এতদিনের জমানো অর্থ ভালো কাজে লাগাতে পারব। ইচ্ছে ছিল পেনশনের টাকা পেলে স্কুলে একটা লাইব্রেরিও স্থাপন করে পড়ার পরিবেশ তৈরি করব। কিন্তু সেই ভাবনা ভাবনায়ই রয়ে গেল।
আজ দুবছর ধরে নিয়মিত অফিসে ঘুরে ঘুরে আমি আজ ক্লান্ত। ক্লান্তিও হয়ত দূর হয়ে যেত। অফিসের পিয়ন আমাকে নিয়মিতই বলে আসছে, তাকে কিছু টাকা দিলে এই ঘোরাঘুরি আর করতে হবে না, আমি বলে এসেছি নিজের টাকা নিজে তুলব এতে ঘুষ কেন দিতে হবে। ও অল্প শিক্ষিত, তাই ভাবতাম ওর শিক্ষার অভাব। তাই ওর পক্ষে এরকম প্রস্তাব দেওয়া অসম্ভব না।
তোমাকে আজ এই চিঠি লিখছি, হয়ত এটাই আমার শেষ লেখা, সব কিছু ঠিক থাকলে আগামীকাল সকালটা আর দেখা হবে না। চিঠি আমি আজ পোস্ট করব এমনভাবে যেন তুমি একটু দেরিতে পাও।
গতকাল অফিসে গিয়েছিলাম, অফিসে যার হাতে সকল বিষয় নির্ভর করত সে আমার ছাত্র। তাই আশা ভরসা বেশি ছিল, ও আমার অনেক প্রিয় একজন ছাত্র ছিল, মনে আছে, ওর এসএসসি পরীক্ষার ফিস দেওয়ার টাকা ছিল না তখন আমি সহায়তা করেছিলাম। তাই মনের কোনে একটা সুপ্ত আশা ছিল, হয়ত আমার কাজটা হয়ে যাবে। ওর সাথে যতবার দেখা হয়েছে, ও যেভাবে আশ্বাস দিত মনে হত ঠিকই তো আছে। সরকারি কাজ দেরি হতেই পারে। ওর প্রতি বিশ্বাস ছিল, আর যাই হোক ঘুষ দিয়ে আমার পেনশনের টাকা ছাড়াতে হবে না। আজ আমার সব বিশ্বাস টলে গেল, জানতে পারলাম, আমার সব আটকে রেখেছে আমারই প্রিয় শিক্ষার্থী। নিজে টাকা চাইতে পারছে না, তাই ভায়া হয়ে টাকা দাবি করছে।
এত বছর শিক্ষকতা করে, শিশুদের শিক্ষার আলোতে আলোকিত করে, আজ সত্যি মনে হল, আমি ব্যর্থ, আমি শেখাতে পারিনি কীভাবে সৎ থাকতে হয়। ওর বাবা মা বিশ্বাস করে আমার হাতে ওকে তুলে দিয়েছিল যাতে আমি মানুষের মত মানুষ করতে পারি। আমি ওকে কাদামাটি থেকে শক্ত মাটিতে পরিনত করতে সহায়তা করেছি, কিন্তু মানুষের মত মানুষ করতে পারিনি। তাই এই ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে আজ সিদ্ধান্ত নিলাম আমার বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।
ভালো থেকো, মানুষের মত মানুষ হোক তোমার সন্তানেরা।
তোমার প্রিয় আলতাফ স্যার।
সুমনকে ফোন দিলাম, জানলাম সেদিন সাকিবকে ফোন দিতে হয়েছিল, স্যারের লাশ যাতে ময়নাতদন্তের জন্য কাঁটাছেড়া না করা হয় সেটার অনুরোধ জানাতে। স্যারের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে হয়নি। সবাই জানে কোন এক অজানা কারণে স্যার বেছে নিয়েছিলেন আত্মহননের পথ।
আর কেউ না জানলেও আজ আমি জানি স্যারের এই মৃত্যুর রহস্য।
মুশফিকুর রহমান
১৬ মে ২০২৫