Saturday, October 30, 2021

ভাঙ্গা গড়া‌

কুরিয়ারে বিয়ের কার্ড এসেছে।

দামি কাগজে সুন্দর করে সাজানো একটা কার্ড। কার্ডের উপরে নিজের নামটা আরেকবার পড়লাম, ঠিকানা ভুল করে এলো কিনা সেটা নিশ্চিত হতে। নাহ আমারই নাম লেখা। কার্ডটা খুলে দেখি পাত্রের নাম শাহজাদা। নাম দেখে খটকা লেগেছিল, কোন শাহজাদা! পরে পাত্রের ডিটেইলস দেখে চিনতে পারলাম, বাল্য বন্ধু শাহজাদার বিয়ের কার্ড।
 

শাহজাদা, আমার বাল্য বেলার বন্ধু। হাইস্কুল পর্যন্ত একসাথে পড়াশোনা করেছি। এরপর একেকজন একেক দিকে। কতবছর হল যোগাযোগ হয় না, মাঝখানে শুনেছিলাম বিদেশে আছে। আমারও বাড়ি যাওয়া হয় না তেমন, তাই কে কোথায় আছে, কী করে কিছুই জানা হয় না।

শাহজাদা আমাকে এখনও মনে রেখেছে। ভালোই লেগেছে বিষয়টা। হাইস্কুলে দুজন যেন একাত্মা ছিলাম। দুজনই চুপচাপ, দুজনেরই বন্ধু বলতে আমরা দুজনই। আমাদের আর তেমন কোন বন্ধু ছিল না, ওর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপের গল্প আমার সাথে শেয়ার করত।
 

হঠাৎ কী মনে হতে পাত্রীর নামটা দেখতে ইচ্ছে হল, লিমা আহমেদ। একটু অবাকই হলাম। নাহ, মনের কোনে একটা নাম দেখার ইচ্ছে ছিল, জানি হওয়ার না তবুও মনের কোনে আশাটা ছিল, হয়ত দেখব নামটা শারমিন কিন্তু মিলল না, তবুও কোথায় যেন একটা খটকা রয়েই গেল। একটা বিষয় নিশ্চিত হতে ইচ্ছে হল। শারমিনের ভালো নাম যেন কী ছিল? কিছুতেই মনে করতে পারলাম না, কাউকে যে জিজ্ঞেস করব, সেটাও পারছি না। ওরকম কারও সাথে তেমন যোগাযোগ নেই।

বিয়ের দাওয়াতটা এড়িয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, লোকের ভীড় তেমন একটা পছন্দ না, আমি সব সময় নিরিবিলি থাকতেই পছন্দ করি। তবে এই বিয়েতে আমাকে যেতেই হবে। এতবছর পর শাহজাদা কাকে বিয়ে করলো সেটা দেখার লোভ সামলানো যাবে না কিছুতেই। শারমিন যাকে সে পাগলের মত ভালোবাসত তাকে না পেয়ে কাকে বিয়ে করল সেটা আমাকে দেখতেই হবে।

শারমিন, আমাদের সাথেই পড়তো। ওর বাবা সরকারি চাকরি করার সুবাদে আমাদের উপজেলার একমাত্র সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ও সহজেই ভর্তি হতে পেরেছিল। আর আমরা সাধারণ জনগন তাই কষ্ট করে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েই ভর্তি হয়েছিলাম। হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই শাহজাদার সাথে বন্ধুত্ব শুরু হয়। ওর সাথে আমার অনেক মিল দুজনই চুপচাপ থাকি, একেবারে শান্ত ছেলে বলতে যা বোঝায় তাই।

নবম শ্রেণিতে উঠার পর ক্লাসে একটা নতুন মেয়ে আসে, নিজের পরিচয় দেয় শারমিন নামে। ওর বাবার বদলির চাকরি তাই এই বছর এখানে ভর্তি হয়েছে। আমাদের ঠিক বিপরীত, শ্যামলা সুন্দর বর্ণের মেয়েটি সবার সাথে সহজেই মিশতে পারে, তাই খুব তাড়াতাড়ি হু হু করে তার বন্ধুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় একটা রেকর্ড ভঙ্গ হয়, আমাদের ক্লাসে নিয়মিত ঘটনা ছিল, শাহজাদা প্রথম হতো আর আমি দ্বিতীয়, এবারই সেটার ব্যত্যয় হল, শাহজাদা হলো তৃতীয়, আমি দ্বিতীয় ছিলাম এখনও আছি, তবে প্রথম হলো শারমিন।

মকবুল স্যার যখন হাতে রেজাল্ট কার্ড হাতে ধরিয়ে দিল, সেদিন দেখি শাহজাদার মুখের একপাশে একচিলতে হাসি। আমি তো অবাক, জানতে চাইলাম, এটা কী হলো, কোথাকার কে এসে তোকে একেবারে থার্ড বানিয়ে দিল? আর তা দেখেও তুই হাসছিস?

তো কী করব? আমি কী কাঁদব? পড়াশোনা করিনি একয়মাস তার ফল পেলাম, হাসবো না তো কাঁদবো? শাহজাদার সরল উক্তি।

কেন কী এমন হলো যে পড়তে পারলি না, মানসম্মান কিছু থাকবে বল, উড়ে এসে জুড়ে বসবে? আমরা কেন তা মানব?
 

‌শাহজাদা মুখটা গম্ভীর করে বলল, বল তাহলে কী করতে হবে?

আমার যেন ক্রমশ রাগ বাড়ছিল, ক্রোধটা কোন মতে চাপা দিয়ে বললাম, কী আর করবি, তোকে আগামী পরীক্ষায় প্রথম হতে হবে।‌

কথা শেষ করে শাহজাদার দিকে তাকালাম, কেমন একটা অদ্ভুদ ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। এই চোখে কী আছে কে জানে। ওর চোখে দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও তাকালাম, শারমিনের দিকে অদ্ভুদ দৃষ্টিতে শাহজাদা তাকিয়ে আছে।

বয়স তখন আর কতই হবে। সবে মাত্র পনের তে পা দিয়েছি। বাড়িতে টিভি দেখার ব্যবস্থা আছে, সেখানে নাটক দেখা হয়, সেই নাটকে নায়ক নায়িকা যেভাবে তাকিয়ে থাকে শাহজাদার চাহনি ঠিক তেমনটাই। মনে খটকা লাগল, তাহলে কী শাহজাদা...

তাই বা হয় কী করে, শাহজাদা এত ভালো একজন বন্ধু আর আমাকে বলবে না?

স্কুল শেষ করে বিকেল বেলায় মাঠে বসেই আড্ডা দেই। সেখানেই শাহজাদাকে ধরলাম, ঘটনা কী জানতে? অনেক বলার পর শাহজাদার মুখ খুলল, হ্যাঁ একয়মাসে শারমিনকে ওর ভালো লেগেছে, হয়ত এটাকে ভালোবাসাই বলে। আমার হাত চেপে ধরে বলল, দোস্ত কাউকে বলবি না কথা দে। এমনকি শারমিনকেও না।
 

‌আমি কথা রেখেছি, শাহজাদার ভালোবাসার কথা কাউকে বলা হয়নি।

শাহজাদা তার ভালোবাসার কথাটা আমাকে জানাতে পেরে মনে হয় হালকা হয়েছে। আগের চেয়ে উৎফুল্ল ভাবটা বেড়েছে। তবে পরিবর্তন করতে পারেনি নিজেকে। এখনও চুপচাপ থাকে, তবে আমি খেয়াল করি, সময় পেলেই শাহজাদা, শারমিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় যেন, শারমিনের প্রতিটা পদক্ষেপের দিকে তার নজর থাকে। দুজন দু গ্রহের মানুষ, একজন যেমন চুপচাপ আরেকজন তার বিপরীত।

সব সময় ক্লাসের ছেলেমেয়েরা শারমিনকে ঘিরে থাকে। ওর হাতের লেখা যেমন সুন্দর তেমনই ছবি আঁকার হাত। ফজলু স্যার ঘোষনা দিলেন, এই সপ্তাহের মাঝে বায়োলজি ব্যবহারিক খাতায় কমপক্ষে দুইটা করে ছবি এঁকে আনতে হবে। আমার তো মাথায় হাত। আমার আঁকার হাত যা তাতে ছবি আঁকালে সেটা আবার গিয়ে স্যারকে বুঝিয়ে আসতে হবে, কী এঁকেছি। উপায় কী?

আমার মতো আরও অনেকে আছে। আমাদের জন্য শারমিন এগিয়ে এলো। ও ঘোষনা দিল, যার যার ছবি আঁকাতে প্রবলেম হবে সে যেন তার সাথে যোগাযোগ করে, ও এঁকে দিবে। ইশ কী মধুর বাণী, আমাকে পায় কে? দৌড়ে গেলাম শারমিনের কাছে। খাতাটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, আমাকেও আঁকিয়ে দিতে হবে।

দেখলাম শুধু আমি না, আমাদের ক্লাসের প্রায় সবাই শারমিনের সহায়তা নিচ্ছে। একজনই শুধু বাদ, সে শাহজাদা। আমি জানি ওর আঁকার হাত ভালো না, শাহজাদাকে বললাম এই সুযোগ, চল দুজনেই যাই। ও কিছুতেই রাজি হল না।

নির্ধারিত দিনে সবাই খাতা জমা দিলাম, শাহজাদা ছাড়া সবারটাই ভালো হয়েছে। স্যার হালকা বকাও দিল এটা নিয়ে। স্যার তো আর জানে না, সবারটা ভালো হওয়ার কারণ কী?

টিফিনে সবাই বাইরে খেলতে গেছে, শাহজাদার মন খারাপ, ও যায়নি তাই আমিও ওর পাশে বসে আছি। দেখি আমাদের দিকে শারমিন এগিয়ে আসছে। রাগী রাগী মুখ নিয়ে শাহজাদাকে বলল, আমাকে কী হিংসে হয়?

শাহজাদার মুখটা লাল হয়ে গেছে, হয়ত লজ্জায় বা ভয়ে, কোন মতে বলতে পারলো, না না তা হবে কেন?

তাহলে সবাই খাতা নিয়ে গেল তুমি কেন গেলে না, আমি কী তোমাকে এঁকে দিতাম না। দাও আমি এঁকে দিচ্ছি বাকিগুলো। এরপর কোন কথা না বলতে দিয়ে খাতাটা জোর করে নিয়ে নিল। যে ঝড়ের বেগে এসেছিল সেই পরিমান গতি নিয়ে আবারও ঝড়ের বেগে চলেও গেল। মাঝখান থেকে এলোমেলো করে দিয়ে গেল আমাদের।

কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এটা কী হল।

সেই শুরু, এরপর টুকটাক কথা হত দুজনের মাঝে, তাও খুব একটা বেশি না। শাহজাদা যে পরিমান লাজুক, মন খুলে মনের কথা বলতে পারবে না এটা আমি নিশ্চিত।

আমার বাড়ি থেকে স্কুলে আসতে শাহজাদাদের বাড়ির সামনে দিয়ে আসতে হয়। স্কুলে যাওয়ার সময় শাহাজাদাকে নিয়ে একসাথেই যাই। আজও এসেছি ওর বাড়িতে। ও বাড়িতে কবুতর পালে, এসে দেখি রেডি হয়ে মইএ উঠে কবুতরের খোপ দেখছে। বললাম, কিরে স্কুলে যাবি না?

হ্যাঁ যাবো তো, দাঁড়া একটু দেখে নেই কবুতরগুলো ঠিক আছে কিনা? 

ওর দিকে তাকালাম, কবুতরের চেয়ে রাস্তার দিকেই নজর বেশি। হঠাৎ ই নেমে বলল, চল দোস্ত স্কুলের সময় হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি নেমে ব্যাগ নিয়েই রাস্তার দিকে চলে গেল, আমি গেলাম না দাঁড়ালাম একটু তাকালো না। রহস্যটা কী?

সব রহস্যের ভেদ হল এক নিমিষে, আমাদের সামনে দিয়ে শারমিন চলে গেল, আমরাও ওর পেছন পেছন যেতে লাগলাম। এতক্ষণে কবুতর দেখার রহস্যটা বুঝতে পারলাম। একসাথে যাওয়ার জন্য এত আয়োজন। হায়রে প্রেম! জানি না এর শেষ কোথায়!

কতবার বলেছি, মনের কথাটা বলে দে, এভাবে নিজের মাঝে লুকিয়ে রাখিস না, শাহজাদা ততবার পিছিয়ে এসেছে। আমি বলে দিতে চেয়েছিলাম সেখানেও বাঁধা দিয়েছে। ওর কথা একটাই কপালে থাকলে একদিন শারমিন ওর হবেই। আমিও হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে বলতাম, এই ভাবনা নিয়েই পড়ে থাক।

ও ভাবনা নিয়েই পড়ে থাকে, আমার সাথে যখনই আড্ডা দিতে বসে তখনই শারমিনের কথা চলে আসে। শারমিনের কথা শুনতে শুনতে আমার কান ঝালাপালা। টিফিনে স্কুলের যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, শারমিনকে কখনও ও চোখের আড়াল হতে দেয় না। আর ক্লাসে তো এমন জায়গায় বসবে যেন শারমিনকে সব সময় দেখা যায়। 

প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় যে ধস নেমেছিল শারমিনের সাথে টুকটাক কথা বলায় সেই ধস কিছুটা কমেছে। এবার দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় আমাকে তৃতীয় স্থানে ফেলে শাহজাদা দ্বিতীয় হয়েছে। বরাবরের মতো এবারও শারমিন প্রথম। 

তাও তো কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে ওদের মাঝে নম্বরের ব্যবধান থাকত খুব কম, হাতের লেখার জন্যেই শারমিন প্রথম হতো। ওর হাতের লেখা মুক্তোর মতো ঝরঝরে।

এভাবেই চলছে না বলা প্রেম কাহিনী। টুকটাক কথা বলা, তবে কথা বলাটা আগের চেয়ে একটু বাড়ছে। ক্লাসের সব অনুষ্ঠান আয়োজনে স্যার আমাদের তিনজনকেই যুক্ত করেন। সে সময় যেন শাহজাদার চোখে হাসির আমেজ দেখা যায়। অন্ততপক্ষে এই সময়ে শারমিনের কাছাকাছি থাকা যায়। 

আচ্ছা শারমিন কি কিছুই বুঝতে পারে না? শুনেছি মেয়েরা নাকি না বলা কথাও বুঝতে পারে, তাহলে এই যে শাহজাদা ওর জন্য এত পাগল তার কিছুই কি শারমিন বুঝতে পারে না? নাকি বুঝেও না বোঝার ভান ধরে।

নবম শ্রেণির পাঠ শেষ করে আমরা সবাই দশম শ্রেণিতে উঠলাম, বরাবরের মতোই আমি তৃতীয়, শাহজাদা দ্বিতীয় আর শারমিন প্রথম স্থান অধিকার করলো। বুঝলাম এই সিরিয়াল আর ভাঙ্গবে না। সামনেই আমাদের এসএসসি পরীক্ষায় বসতে হবে, সবাই সিরিয়াস। শাহজাদার সাথে তেমন আড্ডা আর দেওয়া হয় না, যতটুকু সময় তা পড়তে পড়তেই কেটে যায়।

শাহজাদারও মনের ভুত মনে হয় দূর হয়েছে, আগের মত আর শারমিনের কথা বলে না, বুঝলাম পড়াশোনার চাপে প্রেমের ভুত দুরে চলে গেছে। যাক ভালোই হয়েছে। এই বয়সটা হলো পড়াশোনা করার প্রেম করার কত সময় পড়ে আছে। তখন দেখা যাবে।

সারাদিন কী ব্যস্ততায় কাটে সে আমরাই জানি, এই ক্লাস প্রাইভেট, নিজের পড়া, ব্যবহারিক ক্লাসে সময় দেওয়া। যদিও বায়োলজি খাতাটার দায়িত্ব নিয়েছে শারমিন, আমি পদার্থের লেখার কাজটা নিয়েছি, আর কেমেস্ট্রি ভালো বুঝে শাহাজাদা। এই বিষয়টার ব্যবহারিক খাতা বানানোর দায়িত্ব সেই নিয়েছে। তিনজনে মিলে খাতাগুলো তৈরি করা। কি এক দিন!

আমরা দুইজন যে পরিমান কথা বলি তার সমষ্টির চেয়ে বেশি বলে শারমিন, বেনি দুলিয়ে যখন হাস্যোজ্জ্বল মুখে কথা বলে ভালোই লাগে দেখতে। তাই তো বলি বন্ধু আমার এত পাগল কেন?

আফসোস হয়, এতদিন গেল শাহজাদা বলতেই পারল না, আমাকে কঠিন শপথ করিয়েছে, আমিও কিছু বলতে পারছি না, জানি না এর শেষ কোথায়? তবে শাহজাদার এক কথা কপালে থাকলে শারমিন একদিন ওর হবেই হবে।

একে একে বিদায় অনুষ্ঠানের দিন ঘনিয়ে এলো। চারদিকে সাজানো হয়েছে। বিদায় বেলায় আমাদের নিয়ে অনুষ্ঠান। কষ্টের এক অনুষ্ঠান। এই বিদ্যালয়ে এতদিন কাটিয়েছি, এর প্রতিটি কোনায় কতশত স্মৃতি। সব যেন আজ একসাথে মনে পড়ে যাচ্ছে। আর মাত্র কয়েকটা দিন তারপর কে কোথায় থাকব। 

ছোট ভাই বোনদের সকল আয়োজন একের পর এক শেষ হয়ে গেল। স্যারেরা কত কী উপদেশমূলক কথা বলল, কোনটাই কানে এলো না, স্কুলটাকে এত ভালোবাসতাম আজ তা অনুভব করতে পারলাম। আমাদেরও সুযোগ হল কিছু কথা বলার, কী যে বলেছিলাম আজ আর তা মনে নেই।

তবে সবার চোখেই পানির ধারা দিনটা আজও মনে করিয়ে দেয়। আবার কি সেই দিন ফিরে পাবো?

দেখতে দেখতে এসএসসি পরীক্ষা হয়ে গেল। সামনে অফুরন্ত সময়, রেজাল্ট দিতে তিন মাস সময় লাগবে। এই সময়ে কী করা যায় সেই ভাবনায় আমরা। কত রকমের প্ল্যান। পরীক্ষার এক সপ্তাহ পরেই শাহজাদা বলল, ঢাকায় যাবে, ওর কোন এক খালার বাসায় থাকবে মাসখানেক। ওর তো যাওয়ার জায়গা আছে, আমার এরকম কোন আত্মীয় নেই, যেখান গিয়ে বেড়ানো যায়। তাই আমি বাড়িতেই রয়ে গেলাম।

প্রতিদিন মাঠে খেলতে যাই, দু'একজন বন্ধু যে হয়নি তা না, তবে শাহজাদার মতো কারও সাথে মিশতে পারি না। এরই মাঝে একদিন শুনলাম শারমিনরা চলে যাচ্ছে। ওর বাবার বদলীর চাকরি, বরিশাল নাকি কোথায় যেন যাবে এবার। যাওয়ার আগে আমাদের স্কুলের সব বন্ধুদের ডেকে বিদায় নিয়ে নিল। সব বন্ধুদের বলা ভুল, আসল জনই নেই, শাহজাদা তখনও ঢাকায়। ওর বাড়িতেও কয়েকদিন ধরে কেউ নেই। খবর দিতে পারিনি শাহজাদাকে। 

শারমিন ওর বর্তমান ঠিকানা ওখানে গিয়ে পাঠাবে। ও জানে না কোথায় বাসা নিবে কোথায় থাকবে। ওখানে গিয়ে আমাকে জানাবে। আফসোস করলো অনেক শাহজাদাকে দেখতে না পেয়ে। কেন যেন মনে হলো ওর চোখের কোণে একফোঁটা জল।

কতদিন হল শাহজাদার সাথে যোগাযোগ নেই। এই যে এখন হাতের কাছে ফোন চাইলেই যে কারও সাথে ফোনে যোগাযোগ করা যায়, কয়েকবছর আগেও সেটা অসম্ভব ছিল।

একসময় পরীক্ষার ফলাফল দেওয়া হলো, শাহজাদাও বাড়ি এলো, তবে একটু দেরিতে। ওর আসার আগেই শারমিনের বাবা স্কুল থেকে যাবতীয় কাগজ তুলে নিয়েছে। তাই শারমিনের ঠিকানা পাওয়ার যে আশাটুকু ছিল সেটাও নাই হয়ে গেল। শারমিনও ওখানে গিয়ে ঠিকানা দিতে পারেনি। কেন পারেনি সেটা আজও এক রহস্য।

আমরা তিনজন তিন কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম। আমি ঢাকায় চলে গেলাম, শাহজাদা এলাকার কলেজেই রয়ে গেল। আর শারমিনের খবর তখনও জানি না। এলাকার সাথে তখন থেকেই যোগাযোগ প্রায় বন্ধ বলা চলে। খুব কম সময়ের জন্যেই আমি এলাকায় যাই। শাহজাদার সাথে চিঠিতে যোগযোগ ছিল সেটাও প্রথম দিকে কয়েকমাস, সেটাও কমে গেল। কলেজ পাশ করার পর কে কোথায় কোন খোঁজখবর ছিল না।

তবে শুনেছিলাম, শাহজাদা ডিগ্রিতে পড়াকালীন বিদেশে চলে যায়। আমাদের উপজেলায় বেশিরভাগ ছেলেই বিদেশে কাজের খোঁজে যায়, এটা একটা ঐতিহ্যও বলা যায়। সেই ধারাবাহিকতায় শাহজাদাও চলে গেল। রয়ে গেলাম আমি। তারপর কেটে গেল প্রায় পনের বছর।

আজ হঠাৎ এতদিন পর বিয়ের কার্ড পেয়ে মনটা আবারও সেই ছোট বেলায় ফিরে গেল। যাক এতদিন পর তাহলে বিয়ে করার সময় হয়েছে শাহজাদার। তবে পাত্রীর নামটা শারমিন না হয়ে লিমা রহমান দেখে মনটা খারাপও হয়েছিল, যদিও জানি এটা সম্ভব না। শারমিন এখন কোথায় আছে কেমন আছে কে জানে? আর যদি শাহজাদার সাথে কোন সম্পর্ক থেকেও থাকে সেটা আমি জানতে পারতাম, আমাকে অবশ্যই বলত।

বিয়ের আরও একমাস আছে, অনেক দেরি। এর মাঝে একদিন দেখি ফেসবুকে একটা আইডি থেকে রিকুয়েস্ট দিয়েছে। শারমিন নামের আইডি। প্রোফাইলটাও লক করা। তবে স্কুলের কয়েকজন বন্ধুর সাথে মিউচুয়াল বন্ধু দেখে মনে হল এটা আমাদের শারমিন হতে পারে। একসেপ্ট করলাম, একসেপ্ট করার পর ছবি দেখে একটু দ্বিধা লেগেছিল, তবে মনে হল সময় তো অনেক বয়ে গেছে চেহারার পরিবর্তন হতেও পারে। 

নক করলাম, আমাদের শারমিন কিনা সেটা জানতে, উত্তর এল, সেই শারমিন। প্রোফাইল জুড়ে শারমিনের ছবি, তবে বেশিরভাগ ছবিতেই সাথে একটা আটনয় বছরের ছেলে। বুঝলাম শারমিনের ছেলেই হবে এটা। জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হলাম। ওরই ছেলে, ছেলের বাবাকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল, জানতে চাইলাম সে কই, কেন যেন নিশ্চুপ হয়ে গেল। বুঝলাম বলতে চাইছে না। আমিও জোর দিলাম না।

মাঝে মাঝে টুকটাক কথা হয়, তবে কখনও শাহজাদার কথা জানতে চায় না। আমিও কিছু বলি না, শপথ রক্ষা করাই ধর্ম।

একদিন নক করে বলল, আমার কি একটু সময় হবে। আমার সাথে কিছু কথা বলতে চায়।

তখন অফিসের তাড়া ছিল, কাজের চাপও ছিল, ওর জন্য বিকেলে একটা সময় বের করলাম, ফোন নং বিনিময় হলো, নির্দিষ্ট সময়ে আমিই কল দিলাম।

একে একে ও এখান থেকে চলে যাওয়া থেকে শুরু করে ওর জীবনের কিছু কথা আমায় শোনালো-

আমাদের এই এলাকায় ওর নানীর বাড়ি ছিল, যেটা আমি জানতাম না, ওর বাবা এখান থেকে বদলী হয়ে বরিশাল চলে যায়, সেখানের কলেজেই ভর্তি হয় শারমিন। কলেজ পাশ করে অনার্সে ভর্তি হয় বরিশালের বিএম কলেজে। তবে প্রথম বর্ষ শেষ হতে না হতেই বিয়ের আসরে বসতে হয়। 

শারমিনের একমাত্র ফুফু তখন অসুস্থ। তার একটা ছেলে আর দুইটা মেয়ে। ফুফা নেই। সব দায়িত্ব ছেলে কামরুলের উপর। পড়াশোনা শেষ করে চাচার বদান্যতায় পৌরসভায় চাকরি পেয়েছে। ওর চাচা পৌর মেয়র থাকায় চাকরিটা পেতে সমস্যা হয়নি। চাকরি করে দুই বোনকে বিয়ে দিয়েছে। এবার ফুফু অসুস্থ ছেলের বিয়ে দিয়ে যেতে চায়। পাত্রীতো হাতের কাছেই। ভাইয়ের মেয়ে শারমিন, পড়াশোনায় ভালো, দেখতেও মন্দ না। হাত ছাড়া করার কারণই নেই। ভাইকে প্রস্তাবটা জানানোর পর কোন না শুনতে হয়নি। বিয়ে হয়ে গেল শারমিনের কামরুলের সাথে।

বিয়ের একবছরের মাথায় তারা দুইজন থেকে তিনজনও হয়ে গেল। দিনগুলো সুখেই কাটছে। ছেলের ছয় মাস হতে আরেকটা সুখবর পেল শারমিন। প্রাইমারি স্কুলে এপ্লাই করে পরীক্ষা দিয়েছিল, সেটার ফল পেয়েছে। শিক্ষক হিসাবে তাকে নির্বাচন করা হয়েছে। ছেলের বয়স যদিও কম, শাশুড়ির কাছে রেখে স্কুলে যায়। বাড়ীর কাছেই স্কুলে তাই তেমন অসুবিধা হয় না।

তবে শাশুড়ির বয়স হয়ে যাচ্ছে ননদেরাও তাদের নিজ নিজ শ্বশুরবাড়ি। ছেলেকে নিয়ে মুশকিলই হয়। শিক্ষা অফিস থেকে চিঠি এলো ডিপিএড করতে হবে পিটিআইতে গিয়ে।

এর মাঝে শারমিনের বাবাও বদলি হয়েছে আগের জায়গায় অর্থাৎ আমাদের উপজেলায়। শারমিনের নানীর বাড়ির কাছেই ওর বাবা জায়গা কিনে বাড়ি করেছে। এখান থেকে পিটিআই কাছেই। শারমিন তাই আবেদন করে বাবার বাড়ির কাছের পিটিআইতে ভর্তি হয়। এখান থেকে ক্লাস করাও সুবিধা আর ছেলেটাকেও নানীর কাছে রেখে যেতে পারবে।

সেই প্রথম আঠারো মাস স্বামীর বাড়ি ছেড়ে থাকা। কামরুল কোন আপত্তি করেনি। কেন যেন মনে হত একটু খুশিই হয়েছিল। এমন একটা চাকরি করে, খুব যে অফিস করতে হয় তা না, হাজিরা দিলেই চলে, আর সাথে আছে বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা। শারমিন ওখানে থাকে রাত ৯-১০টার আগে বাড়ি ফিরত না, এটা নিয়ে মাঝে মাঝে কথা হত। শারমিন আসায় যেন আরও সুবিধাই হয়েছে। রাত করে বাড়ি ফেরায় কেউ আর বলার রইল না।

আঠারো মাসে প্রথম দিকে মাসে একদুইবার করে কামরুল দেখতে আসত। এরপর সেই সময়টা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল।

একসময় শারমিনের পরীক্ষা শেষ হয়ে আবার চলে গেল শ্বশুরবাড়ি। অনেকদিন পর নিজের সংসারে ফিরে গিয়ে কেমন যেন পরিবর্তন লক্ষ্য করল। কিন্তু পরিবর্তনটা ধরতে পারছে না। এখনও কামরুল রাত করেই বাড়ি ফিরে কোনদিন খায় কোনদিন না খেয়েই ঘুমায়। মেজাজটাও কেমন যেন খিটখিটে হয়ে থাকে, কিছু বলতে গেলেই ঝগড়া করতে চায়। শারমিন কিছু বলে না, ঝগড়া এড়াতে চায়।

এরমাঝে মেয়েকে দেখতে শারমিনের বাবা আসে। একসপ্তাহ থেকে যায়। তার চোখে ঠিকই পরিবর্তনটা ধরা পড়ে। মেয়েকে জানায় কামরুল মারাত্মক নেশার কবলে পড়েছে। সব লক্ষণই মিলে যায়। শারমিন বিশ্বাস করতে চায় না, কামরুল এমনটা করতে পারে।

একদিন ধরাও পড়ে যায়। তখন সব স্বীকার করে কামরুল, মরন নেশার কবলে পড়েছে কামরুল, এখান থেকে বের হওয়ার কোন পথ নেই। বিয়ের আগেও নেশা করত, তবে এতটা ভয়ংকর ছিল না, এখন যেটা ধরেছে সেটা আর ছাড়তে পারবে না, প্রয়োজন হলে শারমিনকে ছাড়তে পারবে।

শারমিন অনেকভাবে চেষ্টা করেছে। কাজ হয়নি। উল্টো রাগারাগি বেড়েছে, মাঝে মাঝে শারীরিকভাবেও আঘাত পেতে হয়েছে। বেতনের টাকার ভাগ বসেছে। শারমিন তার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেছে কোন কাজ হয়নি। কামরুলের বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সব দায়িত্ব ছিল ওর উপর। ছোট বোনদের মানুষ করতে গিয়ে কখন যে নিজে ছিটকে পড়েছে সেটা জানতেও পারেনি। ছোট বেলা থেকেই নিজে যা ভালো মনে করে সেটাই করে। কারও কথা শুনতে চায় না।

শারমিন অনেক ভেবেছে, বাবা মায়ের সাথে কথা বলেছে। শেষে আর কোন উপায় না দেখে বিচ্ছিন্ন হয়েছে কামরুলের থেকে। ছেলেটার বয়স তখন পাঁচ বছর। শিক্ষা অফিসে আবেদন করে বদলি হয়ে এসেছে আমাদের উপজেলায়। কি আশ্চর্য, আমাদের এলাকায় শারমিন থাকে আর জানতে পারিনি। আসলে এলাকায় যাওয়া হয়না তেমন, বন্ধুবান্ধব কারও সাথে তেমন যোগাযোগ নেই, তাই হয়ত কেউ বলেনি।

শারমিনের ছেলের বয়স এখন নয় বছর।

আচ্ছা, একটা কথা মাথায় এলো, শারমিনের সাথে কি শাহজাদার যোগাযোগ হয়? ও কি বিয়ের দাওয়াত পেয়েছে? না কখনও শারমিনকে বলা হয়নি এ কথা। ওর সামনে শাহজাদার নামটাও বলা হয়নি কখনও। আমার যেমন শারমিন আর শাহজাদার কথা মনে পড়ছে, শাহজাদার মনেও কি এখনও শারমিন আছে? যাকে পাওয়ার জন্য কতটা আকুল ছিল, কত সহজেই শতভাগ বিশ্বাস নিয়ে বলত, একদিন শারমিনকে পাবেই পাবে, সেই আত্মবিশ্বাসটা আজ কোথায়? শাহজাদা কি জানে শারমিনের জীবনের এই কথাগুলো।

মনটা কেমন যেন অস্থির। একসময় মনে হয় শারমিনকে সব জানাই, ওর জন্য কতটা পাগল ছিল শাহজাদা সেটা জানাই। আবার মনে হয় জানিয়ে কী হবে? শাহজাদা তো আরেকজনকে বিয়ে করতে যাচ্ছে। সে কি এই ডিভোর্সি মেয়েকে গ্রহণ করবে? আর এই সময় কি সে পারবে লিমার সাথে বিয়ে ভেঙ্গে দিতে? কি যে সব ভাবছি নিজেও জানি না।

অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বিয়ের আগের দিন পৌঁছালাম শাহজাদের বাড়ি। বাড়িঘরের অবস্থা আগের চেয়ে কত পরিবর্তন হয়েছে। একযুগ বিদেশে থেকে বাড়িঘরের চেহারা পাল্টে দিয়েছে। আগে যেখানে টিনশেড ছিল সেখানে পাঁচতলা ফাউন্ডেশন করে দোতলা বাড়ি করেছে। রাতে আমাদের পুরনো বাড়িতেই থাকতাম, শাহজাদা যেতে দিল না, ওর সাথে আজ থাকতে হবে।


রাতে গায়ে হলুদের পর অনেক রাত অবধি সবাই জেগে ছিল। মেয়ের বাড়ি গায়ে হলুদে সবাই গিয়েছে আমাকে যেতে দেয়নি। ইচ্ছে ছিল যেতে, লিমাকে দেখার একটা লোভ ছিল, যেতে দেয়নি।


সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আমি পাত্রীর পরিচয় জানতে চাইলাম।

ও শুরু করলো ওর গল্প-
বিদেশে থাকতে একটা মেয়ের সাথে ফেসবুকে পরিচয় হয়, মেয়েটা চেনা হলেও ছিল অচেনা। শাহজাদার গল্পটা কেমন যেন হেঁয়ালিতে ভরা। মেয়েটার পরিবারে নানান সমস্যা। ফেসবুকে কথা হতো, সব কথা শেয়ার করত। একজন ভালো বন্ধু মনে করেই সব শেয়ার করত। মেয়েটির সাথে কথা বলে শাহজাদা প্রেমে পড়ে যায়।


এটুকু শুনে মনে মনে শাহজাদাকে গালি দিলাম, মনে মনে বললাম এই তোর প্রেম, শারমিনকে ভুলে লিমাকে মনে ঠাই দিয়েছিস। মুখে কিছু বললাম না।


শাহাজাদা বলতে লাগল, লিমার সমস্যার কথা শুনে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল, তবে লিমা তা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে। সৌদি থাকার সময় যখনই সময় পেত মেয়েটির জন্য দোয়া করত। মেয়েটির সমস্যার যেন সমাধান হয়। অনেকবার জানতে চাইলাম কী সমস্যা ছিল, শাহজাদা এড়িয়ে যেত।


তিনমাস আগে দেশে এসেছে শাহজাদা। এই তিনমাস লিমার মাকে বুঝিয়েছে, লিমাকে তার কতটা পছন্দ, লিমার মা রাজি ছিল না তবে তিনমাস অনবরত বোঝানোর পর রাজি হয়েছে। লিমার কিছুটা অরাজি ছিল তবে শাহজাদার সামনে তা আর খাটে নি।

একবার ভাবলাম, শারমিনের বিষয়টা তাকে বলি, আবার কী মনে করে থেমে গেলাম। যার মনে থাকার কথা তার যদি মনে নাই থাকে আমার কি ঠেকা পড়েছে বলার?

কি মানুষরে আমার বন্ধু ভাবতেও অবাক লাগছে, একবারও শারমিনের কথা তুলল না। আমিও আর কিছু বললাম না, রাত বেড়েই যাচ্ছিল কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টেরও পাইনি।

আজ বিয়ে, সকাল থেকেই আয়োজনের কমতি নেই। গাড়ি সাজানো হয়েছে, ফুলে ফুলে মৌ মৌ করছে। বরের সাথে আমি আর ওর বোন, দুলাভাই বসেছে।

শহরটার কত পরিবর্তন হয়েছে। স্কুলটা দেখে আবারও শারমিনের কথা মনে পড়ছিল। ইশ কার বউ হওয়ার কথা কে বউ হচ্ছে। হয়ত এটাই নিয়তি।

একসময় বিয়ে বাড়ির গেটে গাড়ি থামল, শাহজাদাকে নামিয়ে আনা হলো গাড়ি থেকে, গেটের সামনে আমরা দাঁড়িয়েছি, ওপাশে নয় দশ বছরের একটা ছেলেকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছিল, মনে করতে পারছি না। কে হতে পারে?

গেটের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে, আমাদের নিয়ে বসানো হলো বরমঞ্চে। আমি বারে বারে ওখান থেকে বের হতে চেষ্টা করছিলাম শাহজাদা টান দিয়ে ধরে রাখছিল, যেতে দিবে না। ও আমাকে ছাড়তেই চাচ্ছে না। ওর কানে কানে বললাম, এখন তো ধরে রাখছিস বিয়ে টা হলে তখন তো তাড়িয়ে দিবি, দুরে সরিয়ে দিবি।

ও কিছু না বলে মুচকি হাসল।

খাবার দেওয়া হলো, রাজকীয় আয়োজন, আমাদের এলাকায় বিয়ে বাড়িতে প্রচুর খরচ করা হয়, খাবারের নমুনা দেখলেই বুঝা যায়। বরের সামনে যে খাবার দেওয়া হয় এ এলাকায় এটাকে বলে দুরুচকুরা। সে এক বিরাট আয়োজন। খাওয়া দাওয়ার পর বিয়ে পড়ানো হলো। এরপর এল সেই চরম ক্ষণ, আমার তর যেন শাহজাদার চেয়েও বেশি। কন্যা কে সেটা দেখতেই হবে। আমরা কয়েকজন রওয়ানা হলাম কনের কাছে, এখানে কিছু আনুষ্ঠানিকতা আছে। যাক এখন তো দেখতে পারব, লিমাকে।

এখানেও গেট বন্ধ আলাপচারিতা টাকার বিনিময় ইত্যাদি আয়োজনের পর আমরা ঢুকতে পারলাম, ঐতো সামনে লিমা বসে আছে, চমকে উঠলাম লিমাকে দেখে, এ যদি লিমা হয় তাহলে শারমিন কে??

সামনে তো বসে আছে শারমিন, বউ সেজে, আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসিও দিল, কী আশ্চর্য, এতক্ষণে মনে পড়ল গেটের সামনে যাকে দেখেছিলাম সে ছিল শারমিনের ছেলেই।

কিন্তু এ কী করে সম্ভব?

শারমিন এখানে এভাবে সেজে বসে থাকবে কেন? গায়ে চিমটি কাটলাম, না স্বপ্ন না, সত্যিই।

শাহজাদা সামনে টেনে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিল, এ হল লিমা রহমান, ডাক নাম শারমিন। আসলে বিষয়টা হলো আমরা সব সময় শারমিন নামেই চিনতাম, ওটা ছিল ওর ডাকনাম, আসল নাম, লিমা রহমান।

আসলেই মনে ছিল না, শারমিন নামটা এতবার বলেছি, শুনেছি, লিমা যে ওর আসল নাম সেটা মাথাতেই ছিল না।

ঘরে আর কেউ নেই আমরা তিনজনই, শাহাজাদার দিকে তাকালাম ওর চোখে পানি, বিয়ে করে কোন ছেলের চোখে পানি থাকে ওরে না দেখলেই বিশ্বাসই হতো না। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, জানিস সেই যে এসএসসি দিয়ে ঢাকায় গেলাম, একমাত্র শারমিনকে ভুলতে, যতবার ভুলতে চেয়েছি ততবার যেন মনের পর্দায় ভেসে উঠেছে। বাড়ি ফিরলাম দেখি ওরা নেই, কেউ বলতেও পারল না। এরপর তো তুইও কলেজে ভর্তি হলি ঢাকায় আমি রয়ে গেলাম এখানেই, পড়াশোনায় মন বসে না, শারমিনের কোন খোঁজ পাই না, আসলে কাকে বলব, সেটাই জানতাম না, তুইও নেই।

কলেজ পাশ করে ডিগ্রিতে পড়ার সময় চলে গেলাম সৌদি, এই সুযোগে যদি ভুলতে পারতাম, তা হলো না, নামাজ পড়ে সব সময় দোয়া করতাম শারমিন যেখানেই থাকুক সুখে থাকুক। কিন্তু সেই সুখটা যে এভাবে আসবে সেটা কে জানত। তখনও জানতাম না কেমন আছে কোথায় আছে শারমিন। ওর বিয়ে হয়েছে, সন্তানও আছে কিছুই জানতাম না।

বছর দুয়েক আগে ফেসবুকে রিকুয়েস্ট পাই, শারমিন নামে, এলাকার কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিউচুয়াল, একসেপ্ট করি, ছবি দেখে চিনতে পারি এই সেই শারমিন, কত কথা হয়, কেন যেন আগের সেই ভয়টা নেই। এমনিই কথা হত, ওর সব কথা আমাকে জানায়, বিয়ে, সন্তান, জব, ডিভোর্স সব জানায়।


আমিও কেমন যেন ভয় কাটিয়ে আমার স্কুল লাইফের সব ওরে জানাই, ও তো শুনে বিশ্বাসই করতে চায় না। আমাকে বলে আমি ছিলাম এক শান্ত ছেলে, আমি যখন জানাই ওর প্রতিটি পদক্ষেপ আমি খেয়াল করতাম, ও শুনে আশ্চর্য হয়।


কবে কোথায় প্রাইভেট পড়তে যেত সব মনে করিয়ে দেই, ও শুনে অবাক হয়। আমাকে বলে এত কিছু খেয়াল করতাম? কেন জানাই নি তখন।

তবে বিয়ের কথায় বেঁকে বসে। ও চায়না ওর অভিশপ্ত জীবনে কাউকে জড়াতে। আমি বুঝতে পারি, কীভাবে শারমিনকে রাজি করাতে হবে।

শারমিনের একমাত্র বন্ধু ওর মা, এই তিনমাস ওর পেছনে না ব্যয় করে শারমিনের মায়ের পেছনে ব্যায় করেছে শাহজাদা। সাথে ছিল শারমিনের ছেলেকে পটানো। শারমিনের বাবা কোন বিষয় না, তাকে বোঝানো গেছে সহজেই।

শারমিনকে যখন চারদিক থেকে সবাই ধরেছে তখন আর না বলতে পারেনি। আর এই কয়বছরে দেখেছে এই সমাজে একজন ডিভোর্সি মেয়েকে কোন চোখে দেখা হয়।

আমাকে দুজনের একজনও এসব কিছু জানায়নি, এটা ছিল ওদের প্ল্যান। আমাকে অবাক করিয়ে দেওয়ার।

বিয়ে বাড়ি ভালোই কাটলো, অবশেষে এলো বিদায়ের পালা, চলে আসার সময় এয়ারপোর্টে সবাই এসেছে। শাহজাদা আমার হাত ধরে বলল, দোস্ত, এসএসসির সময় থেকে প্রতিবার এবাদতের সময় দোয়া করতাম, শারমিন যেন সুখে থাকে। এরপর কত দিন গেল, কত কী ঘটল, এদিকের পানি ওদিকে ওদিকের পানি এদিকে গড়ালো। ওর বিয়ে ও হল সংসার ভেঙ্গেও গেল, জানিস কেন যেন মনে হয় সব আমার দোয়ায়। কখনও নিজের জন্য দোয়া করিনি, করেছি ওর জন্য যাতে ও সুখে থাকে। দোয়া যে আমার দিকেই ফিরে আসবে সেটা কে জানত? আসলেই অপরের জন্য দোয়া করলে তার শতগুণ ফিরে আসে। দোয়া করিস আমাদের জন্য, আমরা যেন সুখে থাকতে পারি। হাসি দিয়ে বললাম, দোয়া করি সুখে থাকো সব সময়।


মুশফিকুর রহমান
কক্সবাজার
৩০ অক্টোবর, ২০২১‌

আপনার মন্তব্য লিখুন

ফেসবুক লাইক ও শেয়ার