কয়েকদিন
আগে ঘটা করে পালন করা হল ইউনিয়ন
তথ্য ও সেবা কেন্দ্রের (ইউআইএসসি)
বর্ষপূর্তি
অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে উপস্থিত
ছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব
বান-কি-মুন।
সরকারের একটি ঘোষণা ডিজিটাল
বাংলাদেশ প্রণয়নে ইউআইএসসির
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন এক
যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ইউআইএসসি
গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছাতে পেরেছে
ইন্টারনেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ
হাতিয়ার। যার মাধ্যমে দেশের
তৃণমূল মানুষ সংযুক্ত হতে
পারছে তথ্যের মহাসড়কে।
কর্মসূত্রে
দেশের কিছু সংখ্যক ইউআইএসসি
পরিদর্শন ও তাদের উদ্যোক্তাদের
সাথে কিছু কাজ করার সৌভাগ্য
আমার হয়েছিল। এর মাধ্যমে আমি
উদ্যোক্তাদের কাজের ধারার
সাথে পরিচিত হতে পেরেছিলাম।
তার আলোকে ইউআইএসসির কিছু
সমস্যা ও তার সম্ভাব্য সমাধান
আমার নজরে আসে।
ইউআইএসসি
পরিচালিত হয়ে আসছে সরকারে
একসেস টু ইনফরমেশন বা এটুআই
প্রকল্পের মাধ্যমে। অর্থায়ন
করেছে ইউএনডিপি। বাংলাদেশের
প্রায় প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ
এর জন্য একটি করে কক্ষ বরাদ্ধ
করেছে। প্রতিটি ইউআইএসসিতে
এক বা একাধিক কম্পিউটার,
প্রিন্টার,
স্ক্যানার,
মডেম,
ক্যামেরা,
কোন কোন কেন্দ্রে
ফোন, ফটোস্ট্যাট
মেশিন দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে
কয়েকটি কেন্দ্রে সরকারি ভাবে
অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহার
করে ব্রডব্যান্ড লাইনের
সাহায্যে ইন্টারনেটের ব্যবস্থা
করা হয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রে
দুইজন করে উদ্যোক্তা নিয়োগ
দেওয়া হয়েছে। এই নিয়োগ
প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেছে
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের
চেয়ারম্যান।
ইউআইএসসিগুলোতে
মূলত জনগণকে বিশেষ কিছু সেবা
প্রদান করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে
আছে জন্ম নিবন্ধনের সনদ দেওয়া,
ভূমি সংক্রান্ত
কাগজপত্র দেওয়া,
ইন্টারনেট ব্যবহার
করে কৃষি,
স্বাস্থ্য,
শিক্ষা,
বিদেশগমন,
প্রবাসীদের সাথে
ভিডিও চ্যাট ইত্যাদিতে সহায়তা
দেওয়া, কম্পিউটার
কম্পোজে সহায়তা করা,
কোথাও কোথায়
মোবাইল ব্যাংকিং এর ব্যবস্থা
করা, ফোন
ফ্যাক্সে সহায়তা ইত্যাদি।
এই সব সেবা প্রদানের বিষয়টি
নির্ভর করে উদ্যোক্তার উদ্যোগ,
কর্মদক্ষতা,
আগ্রহ ইত্যাদির
উপর।
ইউআইএসসির
কাজের ক্ষেত্রগুলো লক্ষ্য
করলে দুইটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে
উঠে। প্রথমত,
উদ্যোক্তারার
কি কি কাজ করে,
দ্বিতীয়ত তাদের
কর্মদক্ষতা। আমরা যদি এই দুইটি
বিষয় বিশ্লেষণ করতে পারি তবে
ইউআইএসসির সাফল্য বা ব্যর্থতা
দুই দিকই স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
ইউআইএসসিতে
ব্যবহার করা হয় আধুনিক বিজ্ঞান
ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর আবিষ্কার
কম্পিউটার। এর সাথে সংযুক্ত
থাকে তথ্যের মহাসড়ক ইন্টারনেট।
যা পরিচালনার জন্য দরকার হয়
এক বা একাধিক দক্ষ উদ্যোক্তার।
যাদের থাকতে হবে নূন্যতম
কম্পিউটার সম্পর্কে সাধারণ
জ্ঞান ও তাদের হতে হবে কর্ম
উদ্যোগী। যেহেতু এই পদের জন্য
সরকারি ভাবে কোন বেতন ভাতা
দেওয়া হয় না,
তাই তাদের থাকতে
হয় উদ্যোগী মনোভাব ও সব ধরনের
চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার পারদর্শিতা
এবং কর্মচঞ্চল প্রাণ শক্তি।
ইউআইএসসির উদ্যোক্তা বাছাইয়ের
প্রাথমিক কর্মটুকু সম্পাদনা
করে থাকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের
চেয়ারম্যান। এছাড়া গ্রাম
পর্যায়ে শিক্ষিত উদ্যোক্তা
পাওয়া (যেহেতু
সরকারি কোন ভাতা দেওয়া হয় না)
অনেক স্থানেই
সম্ভব হয়না। তাও বা যা পাওয়া
যায় কিন্তু কম্পিউটারে দক্ষ
লোক পাওয়া সম্ভব হয় না। লোকজন
একটু শিক্ষিত হলে ঢাকার দিকে
দৌড় দেয় আর যারা একটু কম্পিউটারে
পারদর্শী তাদের তো কোন কথাই
নেই। তাই সরকার যখন চেয়ারম্যানদের
কাছে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে
উদ্যোক্তা চেয়ে পাঠান তখন
তারা নিজেদের পছন্দের লোকজনদের
(স্বজনপ্রীতির
মাধ্যমে)
প্রশিক্ষণ গ্রহনের
জন্য পাঠিয়ে দেয়।
এটুআই
বিসিএসের সহায়তায় উদ্যোক্তাদের
স্বল্প সময়ে কম্পিউটার বিষয়ক
প্রশিক্ষণ প্রদান করে। এ
ব্যাপারে কয়েক জনের সাথে আলাপ
করে জানতে পেরেছি ঐ প্রশিক্ষণের
সময়ই অনেক উদ্যোক্তা প্রথম
কম্পিউটারের হাতে খড়ি হয়।
ফলে তাদের পক্ষে কম্পিউটারের
নানান ধরনের সেবা দেওয়া দুরূহ
হয়ে দাঁড়ায়। তবে যাদের আগ্রহ
ছিল তারা ঠিকই এই সমস্যার
মোকাবেলা করতে পেরেছে। তারা
সফল হতে পেরেছে।
কয়েকদিন
আগে দেশের ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে
(ইউপি)
শেষ হয়ে গেল
নির্বাচন। অনেক স্থানেই নতুন
নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত
হলো। যে সব ইউপিতে চেয়ারম্যান
বদল হলো সেখানে ঘটলো নানান
বিপত্তি। যেহেতু ইউআইএসসির
উদ্যোক্তা কোন স্থায়ী পদ না
তাই অনেক স্থানে নতুন চেয়ারম্যানরা
আগের উদ্যোক্তাদের সহজেই
সরিয়ে নিজেদের পছন্দমতো লোকদের
বসাতে শুরু করলো। ফলে যারা
সরকার থেকে প্রশিক্ষণ নিল ও
কাজের মাধ্যমে অভিজ্ঞ হলো
তারা কাজ হারালো এবং ইউআইএসসি
গুলো পরিচালিত হতে থাকলো অদক্ষ
উদ্যোক্তাদের দ্বারা। এ কারণে
ইউআইএসসির পথচলা ধীর থেকে
ধীর গতির হতে লাগলো। বিষয়টির
সত্যতা পাওয়া যাবে পরবর্তীতে
যখন সরকারি ভাবে পুনরায় দেশের
সকল উদ্যেক্তাদের প্রশিক্ষণ
দেওয়া হবে তখন। একটু খোঁজ
নিলেই দেখতে পারা যাবে যারা
প্রথমবার প্রশিক্ষণ নিয়ে
ছিলো তাদের মধ্যে কত জন এখনো
কেন্দ্র পরিচালনা করে ও কত
জন নতুন মুখ। আশা করি সংশ্লিষ্টদের
সহজেই এ ব্যাপারটি নজরে আসবে।
তবে
ইউআইএসসির পেছনে যাদের কালো
হাত সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার
করে তারা হলো ইউনিয়ন পরিষদের
সচিব। এই সচিবরা সরকারী
কর্মচারী। তারা স্থানীয়
পর্যায়ের শক্তিশালী আমলা।
সচিবরা ইউনিয়নের নানান বিষয়ে
দিক নির্দেশনা দেয়। সরকারী
সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে
চেয়ারম্যানকে সহায়তা করে।
সরকার যায় সরকার আসে,
কিন্তু সচিবরা
আগের স্থানেই বহাল থাকেন।
সচিবরা
নানা ধরনের কাজ করে থাকে। এর
মধ্যে আছে জন্ম নিবন্ধন সনদ
প্রদান, ভুমি
সংক্রান্ত কাগজপত্র প্রদান,
নাগরিকত্ব সনদ,
ইত্যাদি। এ জন্য
তারা এতো কাল জনগনের কাছ থেকে
অর্থ নিতেন কিন্তু ইউআইএসসি
আসায় কেন্দ্রে কেন্দ্রে এই
সেবা দিচ্ছে বর্তমানে উদ্যোক্তারা।
তারা ঐ সব কাগজ কম্পিউটারে
কম্পোজ করে অর্থ নিচ্ছেন।
ফলে সচিবদের প্রাপ্ত অর্থ
ভাগ হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া জনগন
তাদের প্রয়োজনীয় কাগজ কম্পিউটার
কম্পোজ করে নিতে চায় বলে সচিবরা
উদ্যোক্তাদের উপর নির্ভর হয়ে
পড়ছে। যেহেতু উদ্যোক্তারা
ইউনিয়নে বসে কাজ করে ও অনলাইনে
নানা বিষয় জানতে পারে তাই তারা
সরকারি অনেক গোপন খবর বিশেষ
করে ইউপির জন্য সরকারি বাজেটের
হিসাবটাও জানতে পারছেন। এছাড়া
সরকার বিভিন্ন কাজে ইউআইএসসিকে
যুক্ত করায় উদ্যোক্তারা
উন্নয়নের নানা বিষয় জানতে
পারছে, যা
এতো দিন চেয়ারম্যান,
মেম্বার ও সচিবরা
জানতে পারতো। তাছাড়া উদ্যোক্তাদের
সাথে যেহেতু এডিসির সরাসরি
যোগাযোগ আছে তাই দুর্নীতির
বিষয়েও সচিবদের সচেতন হতে
হচ্ছে।
ইউনিয়ন
পরিষদের আয়ের একটি অন্যতম
প্রদান উৎস হলো জনগনকে দেয়া
জন্ম নিবন্ধন সনদ। এর মাধ্যমে
প্রাপ্ত অর্থ এর আগে সচিবরা
একছত্র ভাবে পেয়ে আসতেন।
কিন্তু ইউআইএসসি বর্তমানে
এই কাজে অংশ নেওয়ায় সচিবদের
আয় কমে যায়। ফলে তারা ইউআইএসসির
অন্যান্য আয়ের ভাগ চেয়ে বসে।
অনেক স্থানে শুনেছি জোড় করে
এই ভাগের অর্থ নেওয়া হয়। না
দিলে শুরু হয় নানা মুখী নির্যাতন।
এ
প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দেওয়া
যেতে পারে।
ইউআইএসসির
নিজস্ব একটি ব্লগ সাইট আছে,
যেখানে উদ্যোক্তারা
নিজেরা নিজেদের কথা লিখে
জানাতে পারেন।
এই
সাইট থেকে আমি তাদের নানান
সমস্যা,
তার
সমাধানের উপায়,
উদ্যোক্তাদের
সুখ-দুঃখ,
সাফল্য-ব্যর্থতা
আমার নজরে আসে। সাইটটি যেহেতু
ইউআইএসসি সংশ্লিষ্ট তাই
সর্বসাধারণ তাদের সব কথা জানতে
পারেন না।
এই
ব্লগে আমার একজন পরিচিত
উদ্যোক্তা আমাকে ফোন দিয়ে
একটি বিশেষ লেখা পড়তে বলে।
আমি তার লেখা পড়ে জানতে পারি,
তার
কেন্দ্রে সরকার ফাইবার ক্যাবল
দিয়ে ব্রডব্যান্ড লাইন দিবে।
এই উদ্যোক্তা দেশের প্রথম
সারির কয়েকজন উদ্যোক্তার
মধ্যে একজন। তার কেন্দ্রেই
পরীক্ষামূলক নানান পদক্ষেপ
নেওয়া হয়। এবার তিনি বেশ বিপদেই
পড়েছেন বোঝা যায়,
তার
ইউপিতে চেয়ারম্যান বদল হয়েছে।
বর্তমান চেয়ারম্যান তাকে
তেমন পছন্দ করে না। কিন্তু
জেলা পর্যায়ের এডিসি ডিসির
সাথে ভালো সম্পর্ক থাকায় তাকে
কিছু বলতেও পারেন না। এবার
বলার সুযোগ পেয়েছে মনে হয়।
সচিব
সাফ সাফ জানিয়েছেন তাকে তার
জন্য বরাদ্ধকৃত জায়গা ছেড়ে
দিতে হবে। এর পরিবর্তে তাকে
উপরের তালায় কোনার দিকে একটি
রুম নিতে বলা হলো। কিন্তু ঐ
রুম অনেক ছোট। এছাড়া ব্রডব্যান্ড
লাইনের আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি
কোথায় রাখবে জানতে চাইলে সচিব
চমৎকার ভাবে (!!)
তার
সমাধান দেয়। নিচের তলায় একটি
টয়লেট তৈরি করা হয়েছে। অনেক
জায়গা জুড়ে এই টয়লেট,
কিন্তু
তেমন একটা ব্যবহার করা হয়না।
সেখানে রাখতে বলে ব্র্ডব্যান্ড
লাইনের যাবতীয় জিনিস। সমস্যাটা
হয়েছিল সম্ভবত ঐ উদ্যোক্তার
সাফল্যে।
এই
যদি হয় সেরা দশটি ইউআইএসসির
একটির অবস্থা তবে অন্যান্য
স্থানে কি হতে পারে তা সহজেই
অনুমেয়।
আমি
এ ছাড়া কয়েকটি ইউআইএসসি পরিদর্শন
করে দেখেছি ইউপি সচিবরা নানা
ভাবে উদ্যোক্তাদের হেনস্তা
করে আসছে। বাধা প্রদান করছে
তাদের কাজে। ভাগ বসাচ্ছে
উদ্যোক্তাদের আয়ের উপর। ফলে
উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে উদ্যোক্তারা।
সরকার
যদি মনে করে দেশকে একটি সত্যিকার
ডিজিটাল দেশ হিসাবে গড়ে তুলবে
তবে এখনই কিছু পদক্ষেপ নিতে
হবে। ইউআইএসসির উদ্যোক্তাদের
সরকারি ভাবে নিয়োগ দিয়ে তাদের
চাকুরি নিশ্চিত ও স্থায়ী করতে
হবে। হয়তো সরকারি ব্যয় বাড়বে,
তবে
সরকার যদি মনে করে তাদের বেতন
ভাতা না দিয়ে শুধু চাকুরি
নিশ্চিত করে ও কেন্দ্রের আয়
পুরোটাই যেন উদ্যোক্তা পায়
তা নিশ্চিত করে,
ও
তাদের কে নানান সুযোগ সুবিধা
(বিদ্যুৎ
বিল কমানো,
বিনামূল্যে
ইন্টারনেট প্রদান)
দেয়,
বেশি
বেশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা
করতে পারে,
তথ্য
প্রযুক্তির উপর ডিগ্রির
ব্যবস্থা করতে পারে তবে
উদ্যোক্তারা স্বাধীন ভাবে
কাজ করে দেশকে ডিজিটাল দেশে
রূপান্তর করতে পারবে।
আশা
করি সরকার এ ব্যাপারে কার্যকর
ভুমিকা রাখবে।