মা-মনি
বড় তো হচ্ছি,
লম্বা হবে কবে?
টিভি চালু করলে
লাইনটি একটি বিজ্ঞাপনের অংশ
হিসাবে মাঝে মাঝেই কানে আসে।
লম্বা হওয়ার জন্য শিশুটির
আকুতি চোখে পড়ার মতোই। সত্যিই
তো, ওর
সাথে থাকা শিশুরা ওকে ফেলেই
লম্বা হয়ে গেলে দুঃখ তো কিছুটা
হবেই।
লম্বা
হওয়ার জন্য কতই না আয়োজন।
কেউ বলে ঝুলে থাকতে,
কেউ বলে পুষ্টির
অভাব, আবার
কেউ বলে ওগুলো সব বাদ,
বিশেষ একটি খাবার
খেলেই লম্বা হওয়া যাবে। ঐ
বিশেষ খাবারে নাকি লম্বা হওয়ার
সকল উপাদান বিদ্যমান। আহা !
শুনে বড়ই প্রীত
হই। ঠিক ঐ রকম বিশেষ খাবারের
মতোন, বিশেষ
কিছু আমাদের জাতিগত ভাবেই
প্রয়োজন।
১৯৪৭
থেকে ১৯৭১ নানান ঘাত-প্রতিঘাত,
মিছিল-মিটিং,
রক্তক্ষয়,
মুক্তির সংগ্রাম,
আত্মত্যাগ,
অতঃপর আমরা একটি
স্বাধীন দেশ হিসাবে মাথা তুলে
দাঁড়াতে পেরেছি।
১৯৭১
থেকে ২০১১ স্বাধীনতার বীজ
থেকে অঙ্কুরিত হওয়া বাংলাদেশ
নামক চারাটি আজ দীর্ঘ চল্লিশ
বছরের বৃক্ষে পরিনত হয়েছে।
চল্লিশ বছর অনেক দীর্ঘ সময়।
দেশকে যদি আমরা মানব জীবনের
সাথে তুলনা করি তবে বলা যেতে
পারে দেশ আজ স্বয়ংসম্পন্ন
ধীরস্থির এবং প্রতিষ্ঠিত
অন্তত বয়সের দিক থেকে।
একটি
শিশু যখন জন্ম নেয় তখন থাকে
সে অসহায়, নিতান্তই
এক মাংসপিণ্ড। ধীরে ধীরে মায়ের
আদর-ভালোবাসা,
সেবা-যত্নে
বড় হতে থাকে। বয়স বাড়তে বাড়তে
মানব শিশু ক্রমান্বয়ে শিশু
থেকে কৈশোর (০-১৮),
কৈশোর থেকে যুবকে
(১৮-৪০+)
পরিনত হয়। সাথে
সাথে বাড়তে থাকে জ্ঞান,
দক্ষতা,
মানবিকতা ইত্যাদি
মানবিক গুণাবলী। একসময় অর্জিত
জ্ঞান বাস্তবক্ষেত্রে কাজে
লাগিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় স্ব-স্ব
ক্ষেত্রে। প্রস্ফুটিত হয়
পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসাবে।
সেই
হিসাবে আমরা বলতে পারি আমাদের
দেশ বয়সের দিক থেকে আজ যৌবন
কালে এসে পড়েছে। কিন্তু ঐ যে
আগেই বলেছি “বড় তো হচ্ছি,
মানুষ হবো কবে?”
আমাদের দেশ সেই
মানুষই হতে পারছেনা। আজও আমরা
দেখতে পাই, রাস্তায়
গাড়ি এক্সিডেন্টের পর কয়েকজন
লোক অসহায়ের মতো পথে পড়ে থাকে
তাদের পাশ দিয়ে চলে যায় শতশত
গাড়ি, গাড়ীতে
বসে থাকা যাত্রী। কিন্তু কেউ
তাদের সহায়তার জন্য এগিয়ে
আসে না (মিশুক মনির-তারেক মাসুদের ঘটনা দ্রষ্টব্য)।
আমাদের মানবতা আজও সেই স্থানে
পৌঁছাতে পারেনি,
যেখানে পৌঁছালে
একজন বিপন্ন মানুষকে অন্য
আরেকজন মানুষ সাহায্য করে।
আজও
আমরা আমাদের শত্রু কারা তা
চিহ্নিত করতে পারিনি। স্টেডিয়ামে
বসে শত্রুদেশের পতাকা উড়িয়ে
গর্ববোধ করি। আমরা দেশপ্রেমকে
ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার
দিয়ে প্রকাশ করতে চাই কিন্তু
হৃদয়ে ধারণ করতে পারিনা।
আমরা
আজও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস
জানতে পারিনা,
খুঁজে খুঁজে
হয়রান হই, কিন্তু
সঠিক ইতিহাস কেউ বলে না। যেখানে
আমরা প্রস্তর যুগ,
তাম্রযুগ,
লৌহ যুগ ইত্যাদি
নানান যুগের ইতিহাস সঠিক ভাবে
জানতে পারি (ভলগা
থেকে গঙ্গা দ্রষ্টব্য)
কিন্তু ১৯৪৭ থেকে
২০১১ সালের সঠিক ইতিহাস পাইনা।
অনেকের
মুখে বলতে শুনি আমাদের নাকি
সম্পদের অভাব। সত্যিই কি তাই?
আমাদের আছে বিশ্বের
দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। কিন্তু
এ থেকে আমরা কতটুকু উপকার
গ্রহণ করতে পারছি?
এই দীর্ঘতম সৈকতে
পা দুইবার পা ফেলার সৌভাগ্য
হয়েছিল। দুইবারই ভেবেছিলাম
সারা রাত্রি সৈকতের ধারে বসে
রাতের সমুদ্রকে উপভোগ করবো।
কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি,
রাতের বেলা সমুদ্র
সৈকত নিরাপদ না। যেকোন সময়
যে কোন অঘটন ঘটতে পারে। নেই
প্রয়োজনীয় সংখ্যক নিরাপত্তাকর্মী।
যে অঘটনের কথা বললাম তা প্রাকৃতিক
না, মনুষ্য
সৃষ্টি। তবে এর সাথে আছে
প্রাকৃতিক দূর্ঘটনা (যেমন আবিদের ডুবে যাওয়া
)। তাহলে কোন কারণে
একজন বিদেশি এত অর্থ ব্যয় করে
আমাদের এখানে আসবে?
সে যদি রাতের
বেলায় সৈকতে বসে জোৎস্নাই
উপভোগ করতে না পারে তবে কিসের
টানে এখানে আসবে। আর তারা না
আসলে আমাদের এই দীর্ঘতম সৈকতের
সম্পদ কিভাবে কাজে লাগবে।
আমরা
আজ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে
স্বয়ংসম্পন্ন (ল্যাপটপ
এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে,
তথ্য ও যোগাযোগ
প্রযুক্তি যদি শুধুমাত্র
ফেসবুকে আটকে থাকে তবে একথা
বলাই যেতে পারে)।
পাশের দেশ যেখানে তথ্য ও যোগাযোগ
প্রযুক্তির টুল ব্যবহার করে
সফটওয়্যারের ফার্ম গড়ে তুলতে
পারে,
আউটসোর্সিং
করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলতে
পারে,
কল সেন্টারের
রমরমা ব্যবসা গড়তে পারে,
সেখানে আমরা
ফেসবুকে ক্লিকের পর ক্লিক
করে মার্ক জুকারবার্গের সম্পদ
বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান
রাখছি। আমাদের আউটসোর্সিং
আটকা পড়ে থাকছে সরকারি আমলাদের
লাল রংয়ের ফাইলে।
আর
কবে আমরা মানুষ হবো?
আমরা হাজার
হাজার টাকা ব্যয় করে এক একটি
ইট কিনছি
আমার নামে
কিংবা আমার প্রতিষ্ঠানের
জন্য (মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘর প্রতিষ্ঠায়)
কিন্তু আমার
পাশের বাড়ির যে মুক্তিযোদ্ধা
বা তাদের পরিবার ভিক্ষা করে সংসার চালায়
তাদের জন্য
ব্যয় করতে পারছিনা সামান্য
কিছু অর্থ। আমরা কোটি কোটি
টাকা ব্যয় করছি মুক্তিযোদ্ধাদের
অবদানকে পরবর্তী প্রজন্মের
কাছে তুলে ধরতে অথচ আজও অনেক
মুক্তিযোদ্ধা অসহায়,
সম্বলহীন হয়ে
পড়ে আছে তাদের খোঁজও নিচ্ছি
না।
আমাদের
দেশের বয়স তো অনেক হলো (স্বাধীন
জাতি হিসাবে চল্লিশ বছর)
কিন্তু আমরা
মানুষ হবো কবে?
বিজ্ঞাপনে বলা
বিশেষ খাবারের মতো এমন কিছু
কি আমাদের দেশের জন্যও আসবে
না, যার
প্রভাবে আমরা বড় হওয়ার সাথে
সাথে মানুষও হতে পারবো।