Tuesday, October 10, 2017

অপরাজিতা

আমাদের প্রথম পরিচয় একটা জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
আমি যতটা না অন্তর্মুখী ততটাই বহির্মুখী। এটাকে উভয়মুখী বলা যায় কিনা কে জানে? যাই হোক, আমি বাইরে কারও সাথে তেমন মিশতে পারি না তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুব সহজে মিশতে পারি। সেই সুবাধে রাস্নার সাথে পরিচয়।

রাস্না একটা স্কুলে পড়ায়। প্রথম দিকে হাই হেলো
দিয়ে পরিচয়। মাঝে মাঝে মেসেজ আদান প্রদান চলত। আমার স্টাটাসে তার লাইক বা তার স্ট্যাটাসে আমার লাইকও পড়ত। এভাবেই চলছিল। একবার একটা স্ট্যাটাসে সে বিশাল বড় একটি কমেন্ট করে। তবে কমেন্টটা ছিল আমার লেখার বিষয়বস্তুর বিরোধী। আমিও সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নই। এত সহজে হাল ছেড়ে দিতে রাজি নই। তাই তর্ক চলতেই থাকলো।

তর্ক হয়ত অনাদিকাল চলতো তবে কেন যেন দুজনই একসময় হঠাৎ থেমে গেলাম। কিন্তু মেসেজ চালাচালি আগের চেয়ে বেশি হতে লাগল। এখন যেন সম্পর্কটা আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়ে গেছে। কথা প্রসংগে এখন অনেক ব্যক্তিগত কথাই চলে আসছিল। ভালো লাগা মন্দ লাগা, অতীতের কথা সবই চলে আসলো।

রাস্নার অতীতের গল্পটা সাদামাঠা। সব সময় পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। সব সময় ভাবতো কি করে তাদের খুশি করা যায়। তারা কখনও কষ্ট পাবে এমন কাজ করতে তার বিবেকে বাজতো।

এই করতে গিয়ে যে বয়সে যা করার কথা তা আর করা হয়ে উঠেনি। দেখা গেছে যখন বান্ধবীরা সিনেমা দেখতে যেত তখন রাস্না ভাবতো বাবা শুনলে রাগ করবে। বিয়ের পর বরের সাথে দেখব। যে বয়সে বান্ধবীদের প্রায় সবার প্রেমিক ছিল সেই বয়সে রাস্না কাটাতো বই পড়ে। তখনও ভাবতো তার বিয়ে হবে রাজপুত্রের সাথে আর তাকে সকল ভালোবাসা উজার করে দিবে।

বই পড়ে পড়ে তার কল্পনায় ভবিষ্যতের ছবি ভেসে উঠতো। একটা সংসার হবে, ছেলে মেয়ে থাকবে। স্বামী কাজে যাবে, কাজ শেষে দ্রুত বাসায় ফিরে আসবে। অফিস থেকে ফিরে আবার পরের দিন অফিসে যাওয়া পর্যন্ত সময়টা তাদের সুন্দর কাটবে। বাকি সময়টা তার ফেরার অপেক্ষায় কাটবে।

তখন কলেজে পড়ে। ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরে শুনল আজ তাকে দেখতে আসবে। মায়ের দেওয়া শাড়ী পড়ে তৈরি হলো। তাকে না সাজলেও সুন্দর লাগে, তাই কোন সাজ তার প্রয়োজন হয় না, মাথার কেশ বিন্যস্ত করে বসে রইল তাদের আসার অপেক্ষায়।

তখন শীতের শেষ দিক। পড়ন্ত বিকেলে একটা হালকা সোনালী রংয়ের আলো পৃথিবীতে এসে পড়ে। সেই আলোতে কাউকে দেখলে সেদিক থেকে চোখ ফেরানো যায় না। এটাকে অনেকে কনে দেখা আলোও বলে। সেই আলোতে রাস্নাকে পাত্রপক্ষ দেখলো। পরে জানাবো এমন কিছু বলার অবকাশ না রেখে একেবারে বিয়ের তারিখ ঠিক করেই তারা উঠলো।

কল্পনার জগত যেন চোখের সামনেই ধরা দিল। নিজের একটা সংসার। স্বামী আছে, তাদের বাবা-মা আছে। যারা এখন থেকে নিজের বাবা মা হিসেবে গণ্য হবেন। নিজের বাবা-মাকে যেমন ভালোবাসত যত্ন করতো এখন থেকে উনাদেরও সেই মতো যত্ন নিতে হবে।

তবে কল্পনায় ছেদ পড়ল এ বাড়িতে পা দিয়েই। রাস্নাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসা হলো বিকেলে। তারপর থেকে বাদলের খবর নেই। নতুন মাত্র আজই এসেছে। এই অবস্থায় স্বামী বাদলের কথা কাউকে জিজ্ঞেস করা বেমানান। তাই চুপচাপ বসে না থেকে উপায় কি? কতো লোক এসেছে নতুন বউকে দেখতে তারা একেক জন একেক কথা বলছে, কিন্তু বাদলের খোঁজ নেই।

মহাশয় ফিরলেন রাত্রি দশটায়। উনি স্থানীয় একটি কলেজে পড়ান। এলাকাতে বন্ধুবান্ধবদের অভাব নেই। কালকে এই বাড়িতে বউভাতের আয়োজন করা হবে। সেই আয়োজনে কিভাবে কি করা হবে তা নিয়ে বন্ধুবান্ধবদের সাথে আলোচনা করে তবেই ঘরে ফিরলেন।

যুক্তি ঠিক আছে, আজই বিয়ে হল, এখনও আনুষ্ঠানিক কোন কথাই হয়নি। তাকে আর এই বিষয়ে কি বলা যায়?

এখন মনে হয়, সেদিন কিছু বলা উচিত ছিল। সেই বিয়ের প্রথম দিন যেমন রাত দশটা- এগারোটার দিকে বাসায় এসেছিল, এখনও তাই। বিয়ের মাস খানেক পর থেকেই দশটা আর দশটা থাকেনি, এগারোটা থেকে বারোটায় গিয়ে পৌঁছায় সেই সময়টা।

বাসায় শ্বশুর থাকেন, শাশুড়ী নেই আর থাকে ননদ তাদের জন্য কাজ করতে করতে কখন যে রাত এগারোটা হয়ে যায় খেয়ালই থাকে না। আগে রাস্না ওর বরের জন্য বসে থাকতো। রাতে ঘরে ফিরলে একসাথে খাওয়া দাওয়া করে নিত। তবে সেই অভ্যাস আর থাকলো না। কলেজ পাশ করার পর অনার্সে ভর্তি হয়েছিল। এক সময় সেটাও শেষ হলো। এরমাঝে দুইজন ছেলেও সংসারে আসলো। কিন্তু বাদলের অভ্যাসটা পাল্টালো না।

ঘরে বসে না থেকে রাস্না নিজের ইচ্ছেয় একটা স্কুলের চাকুরি জুটিয়ে নিল। এখন তার সময়টাও মন্দ কাটে না। সারাদিন স্কুল, সেখান থেকে এসে সংসারের টুকিটাকি কাজ করতে করতে কখন যে মধ্য রাত হয়ে যায় তা টের পায় না। এখন আর বাদলের জন্য রাত জাগে না। ছেলেদের খাইয়ে, নিজে খেয়ে ওদের ঘুম পাড়াতে পাড়াতে কখনও কখনও নিজেও ঘুমিয়ে যায়। বাদল এসে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। খাবার রেডিই থাকে। তাই দরজা খুলে আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে রাস্না। এক ফাঁকে ঘুমিয়ে যায়। তার কল্পনার সাথে বাস্তব যেন যোজন যোজন দূরে।

রাস্না তার অনেক ভালোলাগা তুলে রেখেছিল স্বামীর সাথে শেয়ার করবে কিংবা তাকে নিয়ে করবে বলে। কোথাও ঘুরতে যাওয়া, কেনাকাটা, সিনেমা দেখা সব জমিয়ে রেখেছিল ভবিষ্যতের জন্যে। স্বামীর সাথে উপভোগ করবে বলে। কিন্তু তা আর হলো কই। ৮ বছর সংসারে একবার মাত্র ঘুরতে যাওয়া হয়েছিল। সেটাও ছিল বাদলের কলেজের পিকনিক। কক্সবাজার সফর। এই একটি স্মৃতি ছাড়া তার আর কোন বেড়ানোর স্মৃতি নেই।

এসবই রাস্নার সাথে কথায় কথায় জানা হয়ে গিয়েছে। বেকার মানুষ হাতে কাজ কম থাকায় সারাদিন রাস্নার সাথে কথা হতো। ওর স্বপ্নের কথা জানা হতো। এত কথা বলে দিয়ে যেন ও আমার অনেক কাছে চলে এসেছে। তবে দেখা করার ইচ্ছে ওরও হয়নি আমারও না। আমি জানতাম ও ওর স্বামীকে কত ভালোবাসতো। এই ভালোবাসাকে আমি শ্রদ্ধা করতাম। ভাবতাম আমার যদি এই রকম একটা বউ থাকতো থাকতো। যে আমাকে প্রচুর ভালোবাসতো।

ওরে যখন বলতাম আমার এই রকম একটি বউ থাকতো, সেটা শুনে রাস্না বললো, এক কাজ করি চলো। আমরা প্রেম করি। তবে সেটা শুধু অনলাইনেই। অফলাইনে কখনও আমাকে পাবে না, পাওয়ার চেষ্টাও করো না।

কেন যেন ওর কথা মেনে নিলাম। দিনগুলো যেন অন্য রকমভাবে কাটতে লাগলো। ইদানিং রাস্নার কথা বলার পরিমান বেড়ে গেছে। আগে যেখানে রাত দশটা বাজলেই চলে যেত অফলাইনে এখন তা হয় না। ওরে বলতাম, এভাবে রাতে চ্যাট কর, তোমার স্বামী কিছু বলবে না? ওর উত্তর খুব সাধারণ। ইদানিং ওর স্বামী ওরে অনেক কথাই শোনাতে চায়। ও শুধু বলে, তুমি যে রাত করে বাড়ি ফিরো আমি কিছু বলি? তাহলে আমি কি করব সেটা তুমি বলবে কেন?

এভাবেই চলছিল। হঠাৎ একদিন একটা অপরিচিত আইডি থেকে রিকুয়েস্ট এলো। নামটাও সুন্দর, অপরাজিতা। এড করলাম, আমাকে ধন্যবাদ জানালো। এরপর যেন অনেকটা উপযাজক হয়েই মেসেজ পাঠাতে লাগলো। কথা যেন থামেই না। প্রথম দিনই এমনভাবে কথা বলতে লাগলো, যেন কত দিনের চেনা। পরিচয় পুরোপুরি দিতে চায় না, আবার যাও দেয় তা ঠিক মনে হয়। আগেই বলে রাখলো সে পুরো পরিচয় দিবে না, তবে কথা বলে আমাকে ভালো লাগছে তাই যোগাযোগ রাখতে চায়।
হঠাৎ যেন মনে হলো, এটা হয়ত রাস্নার আরেকটা আইডি। প্রতিটি মানুষের কথা বলার একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকে। আগে মানুষ চিঠি লিখত, চিঠিতে হাতের লেখা বোঝা যেত এখন আর তা হয় না, তারপরও কথা বলা বা কথা মেসেজ আকারে লিখতে গেলেই কিছু বৈশিষ্ট থাকে যা সহজেই চিহ্নিত করা যায়। দুইজনের লেখাগুলো একজায়গায় করে দেখলাম দুজনের বাক্য গঠনে একই রকম মিল আছে।

আমার ধারণা যেন পাকা হলো। রাস্নাকে বললাম, আমাকে একজন তো রীতিমত পছন্দ করে, দেখতো তাকে খুঁজে পাও কিনা। এরপর রাস্নাকে অপরাজিতার আইডির লিংক দিয়ে দিলাম।

দিন যায় রাস্না আর খুঁজে দেয় না, দিবে কি করে? ওরা যে দুজন একজনই। একই সময়ে অনলাইনে দেখায়। একই সেটে দুইটা এপস দিয়ে চালালে এমনই হয়। আমাকে নানান বাহানা দেয়। আমি মনে মনে হাসি।

আমি বুঝতে দেইনি যে তাকে চিনেছি। রাস্না অপরাজিতা হয়ে কত কি জেনে নিল তার ঠিক নেই।

মাঝে মাঝে যে ধোঁকা লাগে না তা না, তখন মনে হয় আমি কি ভুল করছি, সেই কি আসলে রাস্না? নাকি অপরাজিতা অন্য কেউ? একদিন খুব কষ্ট হচ্ছিল, এর বিহিত করতে হবে। আমার অনুমান শক্তি অনেক প্রখর বলে জানতাম। সেই আমি কি ভুল করছি? এটা জানতেই হবে। খুব করে ধরলাম রাস্নাকে। তাকে যে সন্দেহ করি তা কয়েকবার বলেছি। ও হালকাভাবে নিয়েছে। উড়িয়ে দিয়েছে।

চ্যাটে বসে রাস্নাকে শক্ত করে ধরলাম। আজ জানতেই হবে অপরাজিতা কে? প্রথমে মোলায়েম করে বললাম, ধীরে ধীরে শক্ত করে ধরলাম। তাকে জানালাম অপরাজিতা যে তারই আইডি এটা আমি নিশ্চিত। নানান কথায় সে পিছলে যেতে লাগলো। আমি আরও শক্ত করে ধরলাম। এক পর্যায়ে রাস্না বলল, সে নাকি ভালো অভিনয় করতে পারে না, তাই ধরা পড়ে গেল। আসলে আমার সাথে একটু ফান করতে একটু দুস্টামি করতে, কিংবা আমাকে পরীক্ষা করতে এই কাজটি করেছে। আরও বলল, সে বেশি ভালো অভিনয় করতে পারে না তাই ধরা পড়ে গেছে।

সত্যি জানার আগে নিশ্চিত ছিলাম অপরাজিতাই রাস্না, এখন সত্যি জানার পর কেন যেন বিশ্বাস করতে পারছি না, আসলেই কি আমি ঠিক ছিলাম, নাকি আমার অবস্থা দেখে রাস্না মিথ্যা বলছে।

ওরে বললাম আমি বিশ্বাস করি না, তখন রাস্না অপরাজিতা হয়ে কথা বলা শুরু করলো। কি আর করার বিশ্বাস করতেই হলো।

রাস্নাকে বললাম, তুমি অপরাজিতা এটা জানার আগেও কষ্ট হত কে তা জানতে পারছি না বলে, এখন জানি তাও কষ্ট পাই, একজনের সাথে কথা হতো সে আর নেই বলে, তুমি আর সে তো একজনই। মানব চরিত্র আসলেই বিচিত্র।

এভাবে বেশ চলছিল। কখনও রাস্না কখনও অপরাজিতার সাথে কথা বলে ভালোই চলে যাচ্ছিল। তবে কথা বলতে বলতে বুঝতে পারছিলাম কি পরিমান ভালোবাসে রাস্না তার স্বামীকে। আজও যার অপেক্ষায় থাকে। রাস্না আজও ভাবে হয়ত একদিন তার স্বামী তাকে বলবে, আমার ভুল হয়েছে তোমাকে এত অবহেলা করে।

ভাবলাম কিছু করতে হবে ওর জন্যে, হঠাৎ করেই আইডিয়াটা আসলো মাথায়। রাস্নার কাছ থেকে জেনে নিলাম বাদলের একটা ফেসবুক আইডি আছে। আমি বললাম তুমি অপরাজিতা হয়ে রিকুয়েস্ট পাঠাও। রাস্না প্রথমে না করলেও আমার চাপে পড়ে পাঠাতে বাধ্য হলো।
পরদিন রাস্না জানালো রিকুয়েস্ট একসেপ্ট হয়েছে। এবার রাস্নাকে বললাম তুমি এখন থেকে অপরাজিতা হয়ে তার সাথে কথা বলবে। মেসেজ পাঠাও, দেখ কি রিপ্লে আসে।

রাস্না বলল, আমার জামাই মেসেজের উত্তর দিবে না। আমি এবারও জোড় দিলাম। তবে এও বলে দিলাম, এখন থেকে অপরাজিতা অন্য মেয়ে, ধর তুমি বাদলের বউ কিন্তু তুমি জান না অপরাজিতা মেসেজ পাঠায় বা তার সাথে কথা হয়। তাদের মাঝে এখন থেকে যাই কথা হোক না কেন, কখনও কিছু মনে করা যাবে না, যে ধরনের কথাই হোক না কেন তুমি কিছু মনে করতে পারবে না। রাস্নাকে আরও বললাম, সে যেন অপরাজিতা হয়ে তার স্বামীকে প্রেমে পড়াতে সহায়তা করে। নিজেকে যেন সেইভাবে উপস্থাপন করে, যাতে বাদল সহজেই প্রেমে পড়ে।

বাদল রাস্নার চিন্তাকে ভুল প্রমাণিত করে অপরাজিতার মেসেজের উত্তর দিল। শুধু উত্তর না প্রতিদিন তাদের অনেক কথাই হতো। দুদিন পর রাস্না আমাকে বলল, বাদল অপরাজিতার সাথে বন্ধুত্বের প্রস্তাব দিয়েছে। বাদলের বউ আছে সন্তান আছে তবে বন্ধু নেই। তার সাথে বউয়ের সম্পর্কে বেশি ভালো চলছে না। তবে বাইরে থেকে দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না।

বাদল তাকে এও বলেছে, রাস্না তাকে পছন্দ করে না।
আমি বললাম প্রস্তাব গ্রহণ কর। রাস্না তাই করলো। ওর নাকি এখন ভালোই লাগছে, নিজের বরের সাথে অপরিচিত হয়ে কথা বলার মজাই নাকি আলাদা। ও আরো অবাক হয়েছে, যে মানুষটি ঘরে একদম কথা বলে না, রোমান্টিক কোন ডায়লাগ কখনও দেয়নি তার মুখেই অপরাজিতার জন্য কত কি বের হয়। শুনে রাস্না 'থ' বাদল এত কথা বলতে পারে?

দিনগুলো ভালই চলছিল। একদিন হঠাৎ রাস্না আমাকে বলল, আমার সাথে দেখা করবে, অনেক কথা আছে যা ফোনে বলা যাবে না, মুখোমুখি বলতে হবে।

আজ অনেক খুশির একটা দিন, রাস্নার সাথে এই প্রথম দেখা হবে। এতবেশি কথা হয়েছে যে কেন যেন কেউ কাউকে অপরিচিত লাগবে না বলে মনে হলো। পৌর উদ্যানে দেখা করব বলে ঠিক হলো। আসার সময় কিছু ফুল নিয়ে ব্যাগে ভরলাম, প্রথম দেখায় কিছু ফুল দেওয়াই যায়। তবে হাতে নিতে কেমন যেন লজ্জা লাগছে তাই ব্যাগেই রয়ে গেল।

দুর থেকে যে নীল শাড়ি পড়া মেয়েটাকে দেখলাম তার সাথে রাস্নার ছবির মিল আছে। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না কে হতে পারে। সামনে গিয়ে বললাম আপনি তো রাস্না?

পার্কের বেঞ্চিতে বসে আছি। রাস্নার চোখ ছলছল। ফুল দেওয়ার কথা মাথাতেই এলো না। একটু শান্ত হতে দিয়ে বললাম, কি হয়েছে?

ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ধন্যবাদ, তুমি এভাবে না বললে হয়ত আমি চিরকালই দুঃখী থেকে যেতাম। এ দুইদিনে অনেক কিছুই জানতে পারলাম বাদলের। ওর কষ্টগুলো অপরাজিতাকে জানিয়েছে। একজন মানুষ যে এত দুঃখ নিয়ে থাকতে পারে, তা জানতাম না। জানই তো আমার শাশুড়ী মারা গিয়েছেন তখন বাদল ছোট ছিল। সেই ছোট বেলা থেকে ও শাসন কি তা জানে না, ভালোবাসাও জানেনা। ওর অনেক ইচ্ছে হতো, কেউ ওরে শাসন করুক, জানই তো যার শাসন করার কেউ নেই তার মতো অভাগা কেউ নেই। মা না থাকায় বাবা কখনও ধমক দিয়ে কথা বলতো না, সব সময় আদরে আদরে রাখতো। তাই ভালোবাসা পেলেও শাসনটা পেত না। একসময় ভেবেছিল বিয়ে করলে বউয়ের শাসন মেনে নিবে।

তা আর হলো কোথায়? বাদল বিয়ের রাতে ইচ্ছে করেই দেরি করে আসে। ভেবেছিল দেরি দেখে বউ তাকে কিছু বলবে। এতদিনের ইচ্ছেটা পূরণ হবে। তা আর হল না। বউ তাকে কিছুই বলেনি। সেই থেকে প্রতিদিন দেরি করেই ফিরত। ভাবত হয়ত আজ কিছু বলবে। হয়না, কেমন যেন নিরুত্তাপ থাকে। যেন বাদল সব জায়গায় অনুপস্থিত। বাদলের থাকা না থাকায় যেন রাস্নার কিছুই আসে যায় না।

এই করতে করতে এক সময় অভ্যাসেই পরিনত হয়ে যায় এটা। এখনতো তারা দুইজন দুই প্রান্তের মানুষ। তবে বাদল আশা করে একদিন রাস্না তাকে শাসন করবে। যেদিন শাসন করবে সেদিন থাকে আর কাজের সময় ছাড়া আড্ডা দিতে বাইরে যাবেনা।

এই পর্যন্ত বলে রাস্না থামলো। আমি চুপ করে রইলাম, আমার আর কি বলার আছে? রাস্না নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলল, আজ চলি আবার কখনও কোথাও দেখা হতে পারে। অনেক ভাবলাম, আমার কি করা উচিত ভেবে বের করলাম, তোমাকে ধন্যবাদ দেই, তোমার জন্যেই আমি আমার হারানো সুর ফিরে পেলাম, দেখি সেই সুরে নতুন করে গান বাঁধা যায় কিনা।

বিদায় নিলাম রাস্নার কাছ থেকে। বাড়ির পথ ধরে হাঁটছি, কত কি মনে আসলো। আমার অনেক সময় সুখ দুঃখ একসাথে আসে। আজও ব্যতিক্রম হল না, রাস্না হয়ত আমার জন্যে তার হারানো সুর ফিরে পাবে, একটা ভালো লাগা কাজ করলো।

রাস্না যদি হারানো সুর ফিরে পায় তাহলে আমার অবস্থান কোথায় থাকবে? আমি কি তাকে আগের মতো তাকে সাথে পাবো? দুঃখ হলো, হারানোর কষ্ট যে অনেক গভীর।

ব্যাগে রাখা ফুলগুলো একসময় অপেক্ষায় থাকতে থাকতে শুকিয়ে গেল। একসময় হয়ত ঝরেও যাবে, কারও খোপায় যাওয়ার সাধ্য তার হল না।

১০-১০-১৭
রংপুর
আপনার মন্তব্য লিখুন

ফেসবুক লাইক ও শেয়ার