শংকরপুর মন্ডল পাড়া থেকে বদরগঞ্জ বেশ অনেকটা পথ। তবে ভরসা এই যে রাস্তাটা পিচঢালা আর রাতের বেলায় অটো-ভ্যানও পাওয়া যায়।
তানহার একহাতে মাঝারি একটা ব্যাগ আরেক হাতে মোবাইল। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে এরই মাঝে দুইবার হোঁচট খেয়েছে। রাস্তাটা তার এতই পরিচিত যে চোখ বেঁধে দিলেও চলে আসতে পারবে কিন্তু আজ যেন কি হয়েছে। পথ চলতে গিয়ে পা টলমল করছে। তানহাদের বাড়ি থেকে বের হলে বেশ কিছুটা রাস্তা কাঁচা। রাস্তাটা মিশেছে তেমাথায় ব্রিজের কাছে। সেখানে দাঁড়ালে অটো, ভ্যান সবই পাওয়া যায়। অটোভ্যান পেলে খুব বেশি হলে ২০ মিনিট সময় লাগে বদরগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে আসতে।
তানহার একহাতে মাঝারি একটা ব্যাগ আরেক হাতে মোবাইল। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে এরই মাঝে দুইবার হোঁচট খেয়েছে। রাস্তাটা তার এতই পরিচিত যে চোখ বেঁধে দিলেও চলে আসতে পারবে কিন্তু আজ যেন কি হয়েছে। পথ চলতে গিয়ে পা টলমল করছে। তানহাদের বাড়ি থেকে বের হলে বেশ কিছুটা রাস্তা কাঁচা। রাস্তাটা মিশেছে তেমাথায় ব্রিজের কাছে। সেখানে দাঁড়ালে অটো, ভ্যান সবই পাওয়া যায়। অটোভ্যান পেলে খুব বেশি হলে ২০ মিনিট সময় লাগে বদরগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে আসতে।
সময়টা এখন হেমন্তকাল। বিকেলের দিকে হালকা কুয়াশা পড়ে। এদিকে শীত একটু বেশিই। তানহা গায়ের পাতলা চাদরে নিজেকে আরও একটু ঢেকে নিল। চাদর যে শুধু শীত থেকে বাঁচাবে তা না, আশেপাশের লোকের নানান প্রশ্ন থেকেও বাঁচাবে। তেমাথায় একটাই দোকান, তানহা জানে করিম চাচার এই দোকানটা এই সময়ে বন্ধ থাকে। চাচা এই সময়ে মসজিদে যায়। নামাজ শেষ করে বাড়িতে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে এসে দোকান খুলে। দোকানের সামনে বেঞ্চ পাতা আছে। অনেক সময় এখানে অনেকেই বসে থাকে, আজ ভাগ্য ভাল কেউ নেই। দোকান বন্ধ থাকায় এখানে কিছুটা অন্ধকার। তানহা বেঞ্চে বসল।
এমনিতে সব সময় এই রাস্তায় ভ্যান পাওয়া যায়। আজ কেন যেন একটা ভ্যানও দেখা যাচ্ছে না। বারে বারে তানহা মোবাইলের ঘড়ি দেখছে। তার মুখে টেনশনের ছাপ ফুটে উঠেছে। টের পেল এই শীতেও তার শরীর বেয়ে ঘাম ঝরে পড়ছে। একটু পর পর সে বেঞ্চ থেকে উঠে রাস্তায় আসে দেখে কোন অটো ভ্যান আসে কিনা। আবার গিয়ে বেঞ্চে বসে, তাকে দেখলে যে কেউ বুঝবে যে কোন একটা সমস্যা আছে।
সে যে বাড়ি থেকে বের হয়ে এখানে এসেছে তা কারও জানার কথা না। গতকাল কৌশলে ব্যাগে কাপড়চোপড় গুছিয়ে বান্ধবী শিউলিদের বাড়ি রেখে এসেছিল। বাড়ি থেকে বিকেলে বের হয়েছে তানহা। আগেই সব ঠিক করা ছিল, সেই অনুযায়ী বিকেলে তানহা ফোন বন্ধ রাখে। শিউলির ছোট বোন বিকেলে তানহার বাবার ফোনে ফোন দেয়। কাতর কণ্ঠে জানায় শিউলির ভীষন জ্বর। বাড়িতে মা নেই। এখন ও কি করবে বুঝতে পারছে না। তানহাকে কি একটু পাঠিয়ে দিবেন?
শিউলি তানহার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী, ছোট বেলা থেকে কলেজ পর্যন্ত একই সাথে পড়াশোনা করেছে, বড় হয়েছে। কলেজ শেষ করে তানহা গেছে ঢাকায় পড়তে আর শিউলি কারমাইকেলে পড়ছে। শিউলির কথা শুনে তানহার বাবা এই সময়েও তানহাকে বাড়ি থেকে বের হতে দিয়েছে।
তানহার এভাবে বের হয়ে যাওয়াকে মা সায় দিতে চায়নি। তার মনে কু-ডাক ডাকছে। আজ বাদে কাল যে মেয়ের বিয়ে সে বাড়ির বাইরে যাবে এটা কোন মাই সইতে পারবে না। তানহার বাবা তালেব মাস্টার শিউলির জ্বরের কথা শুনে মেয়েকে আটকায়নি। আর এই বাড়িতে তার কথাই শেষ কথা।
তানহা একবার ভাবল হেঁটেই রওয়ানা দিবে কিনা। অনেক সময় বিবাড়িয়ায় অটো পাওয়া যায়। হাঁটলে পনেরো মিনিট লাগতে পারে। তবে এই ব্যাগ নিয়ে হাঁটাও মুশকিল। এখন বাজে ছয়টা, আটটায় গাড়ি। অনেক সময় হাতে আছে। তাও ভয় হয়, যদি কিছু না পায়। ভাবল, সাতটা পর্যন্ত দেখবে কিছু না পেলে হেঁটেই রওয়ানা দিবে।
গাড়ির কথায় তার মনে পড়ল টিকেটের কথা। হানিফ পরিবহনের একটাই নাইটকোচ বদরগঞ্জ থেকে ঢাকায় যায়। রাত আটটার গাড়িতে দুইটা টিকেট গতকালই কেনা হয়েছে। টিকিটগুলো ভ্যানিটি ব্যাগের সাইড পকেটে রেখেছিল। সাইড পকেট খুলে দেখে টিকিট দুইটা ওখানেই আছে।
টিকিটগুলো তাহের গতকালই শিউলির বোনের কাছে কিনে পাঠিয়ে দিয়েছে। তাহেরের সব দিকেই খেয়াল আছে। কীভাবে বাড়ি থেকে বের হতে হবে, কোন জায়গা থেকে বাসে উঠতে হবে, সে কোথায় উঠবে সব ঠিক করে বিস্তারিত প্ল্যান বানিয়ে তানহাকে শুনিয়েছে।
সেই মতো রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ভ্যান বা অটো না পেলে তো সব প্ল্যান নষ্ট হবে। প্ল্যানমতো সব কিছু ঠিকঠাক না হলে কি হবে ভাবতেই একটা ভয়ের ঠাণ্ডা স্রোত মাথা থেকে পা পর্যন্ত বয়ে গেল।
তানহা এতো টেনশন নিতে পারছে না। রাত বেড়ে যাচ্ছে। যে কোন সময় পরিচিত কেউ আসতে পারে। একবার ভাবছে ফিরে যাবে কিনা, আবার ভাবছে তা কি করে হয়। এতদিনের প্রেম, ভালোবাসা সব জলাঞ্জলি দিয়ে তাহেরকে ঠকাতে পারবে না। কিছু একটা তাকে করতেই হবে। প্রেমের জন্য অষ্টম এডওয়ার্ড সিংহাসন ছেড়ে ছিল। এইতো সেদিনের ঘটনা, ১৯৩৬ সালে প্রেমিকা ওয়ালিস ওয়ারফিল্ড সিম্পসনকে বিয়ে করতে চাইলে না করা হয়। শেষে প্রেমকে টিকিয়ে রাখতে সিংহাসনই ছেড়ে দেয়। আর তানহা সামান্য এই কষ্টটুকু করতে পারবে না?
ব্যাগ হাতে হাঁটতে যাবে এই সময়ে টুং টাং শুনে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালো। যা ভেবেছিল তাই। একটা খালি ওটো-রিক্সা আসছে। এটাকে থামিয়ে দরদাম করে উঠে বসলো। ভয় কিছুটা কমে গেল। পৌঁছাতে আর বেশি সময় লাগবে না।
ভয় কমে যাওয়ার মনে যা জায়গা করে নিল তা হলো খারাপ লাগা। বাড়ির জন্য মন কেমন করছে। বাবা-মা এতো ভালোবাসে তাকে, তাদের এই ভাবে আঘাত দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে? একবার ভাবে ফিরে যায়। তখনই মনে পড়ে তাহেরের মায়া ভরা প্রেমময় মুখ। বাবা তাহেরের সাথে তার সম্পর্ক কোন দিনই মেনে নিবে না। মা কিছুটা জানতো, সব জানে না। শুধু জানে মেয়ে একটা ছেলেকে পছন্দ করে। মেয়ের হয়ে তার স্বামীকে বলতেও গিয়েছিল। বাবা কোন কথাই শুনতে চাননি। তার পছন্দ মতো মেয়েকে বিয়ে করতে হবে। এই নিয়ে যেন দ্বিতীয়বার কোন কথা না হয়।
তানহা কোন কিছুই বলেনি। উত্তর পাড়ার রফিক ভাইয়ের পরিবার থেকে যেদিন দেখতে এসেছে সেদিনও বাধ্য মেয়ের মতো তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তানহা দেখতে গড়পড়তা মেয়েদের চেয়ে একটু বেশিই সুন্দর। বাঙ্গালী মেয়েরা খুব একটা লম্বা হয়না। তবে তানহা তাদের চেয়ে একটু ভাগ্যবান। ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি লম্বা তানহা যখন শাড়ি পড়ে তখন আরেকটু লম্বাও লাগে।
কিছু কিছু মেয়ে থাকে যারা শাড়ী পড়লে মনে হয় শাড়িতে তাকে মানিয়েছে, না শাড়ী তাকে পেয়ে মানিয়েছে। যেন সোনার হাতে সোনার চুড়ি, কেকার অলঙ্কার। তানহা সেই রকম। খুব বেশি মোটা নয় আবার একেবারে পাটকাঠিও নয়। ছিপছিপে মেয়েটি যখন হেঁটে যায় তখন দ্বিতীয় বার দেখতে যে কেউ অজুহাত খুঁজে।
তাহের তানহার শাড়ী পড়াটাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। যেদিন প্রথম দেখা হয়, সেদিনই বলেছিল আপনি শাড়ী পড়েন না কেন? শাড়ী পড়লে আপনাকে রাজকন্যার মতো লাগবে জানেন এটা?
তাহেরের সাথে দেখা হওয়ার সময় প্রথম কথাই ছিল এটা। তানহা অবাক হয়েছিল, এই সুরে কেউ কাউকে প্রথম দর্শনে বলে? শিউলি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। তার দূর সম্পর্কে কেমন যেন ভাই লাগে। ঢাবিতে ভর্তির ফরম পূরণ করে জমা দেওয়ার দিন কলাভবনে তাদের সাথে দেখা হয়। তাহের তখন তৃতীয় বর্ষে পড়ে। হলে থাকে। সারা সকাল তানহাদের সঙ্গ দিয়েছিল। কলাভবন, টিএসসি কার্জন হল সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল।
ভর্তি পরীক্ষায় কি কি পড়তে হবে, কিভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে তার বিষয়ে অনেক খুঁটিনাটিও জানিয়েছিল। তাহেরের কথায় লোভ লাগে তানহার, ভাবে এখানে ভর্তি হতে না পারলে জীবন বৃথা। তাহেরের কথায়, তার ব্যবহার আর এই হালকা দুষ্টামিকেও ভালো লাগে। একটা মুগ্ধতা কাজ করে তার মাঝে। সেই একই মুগ্ধতা আজ তাকে ঘর ছেড়ে বাইরে নিয়ে এসেছে।
তানহা যেদিন ঢাবিতে চান্স পায় সেদিন সব চেয়ে বেশি খুশি হয় তানহার বাবা।স্কুল শিক্ষক তালেব মাস্টার সারা জীবন অনেক শিক্ষার্থীকে পড়িয়েছে। তারা আজ অনেকে খুব বড় বড় জায়গায় আছে, তার একটা সুপ্ত ইচ্ছে ছিল নিজের কেউ যদি এমন একটা জায়গা নিতে পারতো। তার ছেলেকে দিয়ে চেষ্টা করেছে হয়নি। ইন্টার পাশ করে আর পড়তেই পারেনি, তার নাকি পড়া ভাল লাগে না। টাকার জোগাড় করে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছে। মেয়েকে নিয়ে আশা করেছিল, কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিল, মেয়ে হয়ত কিছু একটা করবে। আজ তার আশা পূরণ হয়েছে।
তবে তানহার মন খারাপ, বাবা-মাকে রেখে চলে যেতে হবে। আবার ভালো লাগাও আছে। শেষ পর্যন্ত ভর্তি হতে পারলো। এই কয়দিনে অনেক স্বপ্ন দেখেছে ভার্সিটিকে নিয়ে। আরেকটা গোপন আনন্দও আছে। তাহেরের সাথে আবার দেখা হবে। ফরম জমা দেওয়ার সময় দেখা হয়েছিল, এরপর আবার দেখা হয় পরীক্ষা দিতে গিয়ে। পরীক্ষার আগে যে টেনশন ছিল তা পরীক্ষা দেওয়ার পর মিটে যায়। কেন যেন ওর মন বলে এখানে চান্স হবে। প্রস্তুতিও ছিল, পরীক্ষাও ভালো হয়, তাই পরীক্ষার পর আড্ডাটাও জমে ভালো। প্রথম বার যে জড়তা ছিল দ্বিতীয় বার সেটা থাকেনি। কথায় কথায় জেনেছে তাহেরের বাসা রংপুর। তবে আদি বাড়ি ছিল আরও দূরে। ছোট বেলায় ওরা রংপুর এসেছে। জেলা স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে ঢাকায় চলে আসে। ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ভর্তি হয় ঢাবিতে। হলে থাকে।
তাহেরের যে জিনিসটা বেশি ভালো লাগে তা হলো ওর ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা এক টুকরো হাসি। গল্প করার ফাঁকে তানহা বেশ কয়েকবার এটা লক্ষ্য করেছে। তবে তাহেরের চোখকে ফাঁকি দিয়ে দেখতে হয়েছে। আজ তাহেরের কয়েকজন বন্ধুও আছে আড্ডায়। তারাও অনেক মজার মানুষ। কত যে গল্প শুনিয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। তানহা ভাবে ভার্সিটি কত মজার জীবন।
তানহার গাড়ি রাত দশটায়। বিকেলের গাড়িতে আসতে পারতো, তাহলে অনেক ভোরে বা রাতে গাড়ি থেকে নামতে হতো। তাই কষ্ট করে হলেও রাতের গাড়িতে রওয়ানা হওয়া ভালো। তানহার মামা থাকে ঢাকায় সেও আজ বাড়ি যাবে। একসাথেই যাবে। মামার অফিস ছুটি হবে বিকেল পাঁচটায়। কথা হয়েছে, তানহা আর শিউলি সন্ধের দিকে কাউন্টারে চলে যাবে। মামা পরে আসবে।
দুপুরের খাওয়া হলো নীলক্ষেতের মামা হোটেলে। বাড়ির বাইরে বেশি আসেনি, বাইরে বেশি কোথাও খায়নি তানহার। ভেবেছিল খেতে পারবে কিনা। তবে এখানের খাওয়া খারাপ লাগেনি। খাওয়া শেষে আবার আড্ডা। মল চত্ত্বরে বসে সারাটা বিকেল কীভাবে কেটে গেল বুঝতেও পারলো না।
সন্ধায় সবাই মিলে চলে এল কল্যাণপুর। বাস কাউন্টারে পৌঁছে দিল ওদের। নিউমার্কেট থেকে রিক্সা এতদূরে যেতে চায়না। একটা রিক্সা কোন মতে রাজি হলো। তিনজন এক রিক্সায় যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। এর আগে রিক্সায় কোন ছেলের সাথে উঠেনি তানহা। আজ এভাবে যেতে একটু একটু খারাপও লাগছিল। কিছু না বললেও হয়ত ওর মুখে এটা ফুটে উঠেছিল। বিষয়টি দেখে তাহের কিছুটা ইতস্ততবোধ করছিল কি করবে সেটা নিয়ে। তানহাই সমাধান দিল। বলল, তিনজন যেতে আপত্তি নেই তার।
হালকা হালকা বাতাস বইছে। রিক্সা চলছে তার নিজস্ব গতিতে। তবে মাঝে মাঝেই থামতে হচ্ছে। তানহার কানে আসে গুনগুন করে গাওয়া তাহেরের মুখের গান। তানহা সাহস নিয়ে বলে ভাইয়া, আরেকটু জোড়ে গাওয়া যায় না? আমরাও শুনি। তাহের গলার আওয়াজটা একটু বাড়িয়ে দেয়-
আমার সারাটি দিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম,
শুধু শ্রাবণ সন্ধা টুকু তোমার কাছে চেয়ে নিলাম।
তানহার প্রিয় একটা গান। তাহের জানল কি করে এটা ওর প্রিয় গান। কি করে মিলে গেল?
খুব খারাপ একটা ঝাঁকুনিতে বাস্তবে ফিরে এল তানহা। না সে এখন ঢাকায় নেই। অন্ধকার রাস্তায় বদরগঞ্জের দিকে যাচ্ছে। রাস্তাটার অনেক অংশই ভেঙ্গে গেছে, তার উপর অন্ধকার রাস্তা। ঝাঁকুনিটা বেশ জোরেই লেগেছে। তানহার মনটা কেমন যেন করছে। এতক্ষণে কি বাড়ির সবাই জেনে গেছে? শিউলিকে বলে এসেছে মাকে ফোন দিয়ে যেন বলে রাতে ও ফিরতে পারবে না। ওর অসুখ কমেনি।
মায়ের মন কি মানবে? যদি এখনই বাবাকে পাঠিয়ে দেয়, তাহলে তো ধরা পড়তে হবে। আর বাবা জানলে তার সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে। কখন যে আটটা বাজবে গাড়ি ছাড়বে সেটাই চিন্তা তানহার। গাড়ি একবার ছেড়ে দিলে আর চিন্তা কিছু থাকবে না। মডার্ণ মোড় থেকে তাহের উঠবে। এইটুকু রাস্তা তাকে একাই যেতে হবে। অসুবিধা নেই, ঢাকায় একা একা এই গাড়িতে এর আগেও কয়েকবার গিয়েছে। আর আজ তো রংপুর পর্যন্ত একা একা যেতে হবে। রংপুর থেকে দেখা পাবে তার মনের মানুষের। ঢাকায় গিয়ে তারা একটা সংসার পাতবে।
আসলে এভাবে একা একা বিয়ে করার কোন স্বপ্ন, ইচ্ছে কোনটাই ছিল না তানহার। ইচ্ছে ছিল বউ সেজে থাকবে, লাল টুকটুকে একটা শাড়ী পড়ে বসে থাকবে আর বর এসে নিয়ে যাবে। স্বপ্ন ছিল সাজানো গোছানো একটি বাসর ঘর হবে। রাত জেগে গাইবে প্রেমের গান। সেটা আর হল না।
এবারই মাস্টার্স শেষ হল, এখন বিয়ে দেবেনা তো আর কবে দিবে। এর আগে যতবার বিয়ের কথা উঠছে ততবার বলেছে পড়াশোনা শেষ করি তারপর। সেই পড়াশোনা যেহেতু শেষ তাহলে আর অপেক্ষা কেন? মেয়ে ঢাবি থেকে পাশ করেছ। অনেক ছেলেই দেখতে আসে।
তানহা এটা ওটা বলে কাটিয়ে দিতে চায়। কিন্তু এভাবে আর কত? এক সময় মাকে বলে সে এখন বিয়ে করবে না। একথায় ওকথায় জানাতে হয়, একটা ছেলেকে সে পছন্দ করে। তাকেই বিয়ে করবে। ছেলেটি চাকরীর চেষ্টা করছে। হয়ত চাকরী হয়েই যাবে। চাকরী হলেই বিয়ে করতে পারবে। মাকে বলে যেন, কথাটা বাবার কানে দিয়ে দেয়।
মা কথাটা বাবার কানে পুরোটা দিতে পারেনি। বাবা অর্ধেক কথা শুনেই বলেছে এই বাড়িতে এই রকম কাজ কেউ করেনি তাই তানহাও করতে পারবে না। দ্বিতীয় বার যেন এই বিষয়ে আর কথা না হয়।
প্রেম ভালোবাসা বিষয়গুলো বাবা একদমই শুনতে চায় না। তালেব মাস্টারের খ্যাতি ছিল শিক্ষার্থী শাসনের। একবার সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে এমন মার দিয়েছিল যে সাতদিন পর্যন্ত তাকে বিছানায় থাকতে হয়েছিল। অথচ ঐ শিক্ষার্থী ছিল তার প্রিয় পাত্র। পরে অবশ্য জানতে পারে যে কারণে মেরেছিল তার দোষ ঐ শিক্ষার্থী করেনি। এই নিয়ে সারাজীবন তার আক্ষেপ ছিল। ঐ ছেলেটি অবশ্য আর থাকেনি স্কুলটিতে। কোথায় যে হারিয়ে গেছে জানতেও পারে নাই।
তানহা চোখের সামনে তার বাড়ির সব কিছু দেখতে পারছে। এই কয়দিনে অনেক ভেবেছে। সে এভাবে চলে গেলে কি হতে পারে। বাবা অনেক কষ্ট পাবে, কিন্তু কি করবে ও। তাহের কোন অংশে কম না, চাকরী একটা হয়ে যাবে হয়ত এই কয়দিনে। কথাবার্তা কিছুটা ফাইনাল। ছেলে হিসেবে ভাল, দেখতেও ভাল। এমন ছেলেকে বাদ দিয়ে কেন যে বাবা-মা মাথায় মাথা ভর্তি টাক তবে পকেটে টাকা ওয়ালা বয়স্ক ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দেয় তাই সে বুঝে না।
অটো চলতে থাকে, রাত বাড়তে থাকে, আর তানহার সব ঘটনা আজ একের পর এক চোখের সামনে আসতে থাকে। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকে তাহেরের সাথে প্রতিদিন দেখা হয়। আড্ডাও চলে আগের মতো। তবে পার্থক্য এখন আর শিউলি থাকে না। ও ভর্তি হতে পারেনি। পরিচয়ের পর কেটে যায় দুই বছর। এর মাঝে কোন চারিত্রিক দুর্বলতা দেখতে পায়নি তানহা। সব সময় একটা ভদ্র আচরণ তাকে মুগ্ধ করেছে। সেই মুগ্ধতা এক সময়ে ভালবাসায় রূপান্তরিত হয়। কিন্তু চিরায়িত সংস্কৃতিতে পারেনা নিজে কিছু বলতে।
চতুর্থ বর্ষ ফাইনাল দিয়ে তাহের জানায় সে তানহাকে ভালবাসে। এতদিন বুঝতে বুঝতে কেটে যায়, সে শিওর হতে চায় তানহা কতটা ভালবাসে। এই কয়দিনে বুঝেছে। তানহাও তাকে পাগলের মতো ভালবাসে। তাইতো ভালবাসার সাগরে দুইজনের ভাসতে আর সময় লাগে না।
ঢাকায় দুইজনেরই কেউ নেই। নিজেরা স্বাধীনমতো ঘুরে বেড়াতে পেরেছে কেউ কিছু বলতে পারেনি। তবে তারা স্বাধীনতার কোন বরখেলাপ করেনি। এমন কিছু করেনি যাতে নিজেকে অপরাধী লাগে। একারণে তাহেরকে আরও বেশি ভালোবেসে ফেলেছে।
প্রতিদিনই বাবা একের পর এক ছেলের খোঁজ নিয়ে আসে। তাহেরের চাকরিও হচ্ছে না। বাড়ি থেকে বাবা মাকে নিয়ে আসবে কোন মুখে, যদি বলে ছেলে কি করে তাহলে জবাব তো দিতেই হবে। এই সেই করতে করতে শেষে ফেঁসে যায় তানহা। এবার যে পাত্র এসেছে সবদিক দিয়েই একদম পারফেক্ট। তাকে না করার কিছুই নেই। পাত্র বুয়েট থেকে পাশ করে এখন একটা বড় নামী প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করে। এমন পাত্র কি হাতছাড়া করা যায়। তাও আবার ঐ পরিবারের একমাত্র ছেলে।
এর মাঝে কথা হয় তাহেরের সাথে। বিস্তারিত পরিকল্পনা শুনিয়ে আশ্বস্ত করে। কীভাবে তানহা বাড়ি থেকে বের হবে। কয়টা সময় কোন রাস্তায় থাকবে, কোন পথ দিয়ে যাবে, কোন গাড়িতে উঠবে, কয়টার গাড়িতে টিকেট কাটা থাকবে, টিকেট কোথায় কার কাছে থাকবে, কার কাছ থেকে নিতে হবে। গাড়ি কয়টায় ছাড়বে সে কোথায় উঠবে সব জানায়। ওরা প্রথমে ঢাকায় যাবে। সেখানে বিয়ের কাজটা সেরে চলে যাবে সরাসরি কক্সবাজার। ওখানে রুম বুকিং দেওয়া আছে। তিনদিন থাকবে ওখানে। তারপর আসবে ঢাকায়। তাহের জানায় এক রুমের বাসাও নেওয়া হয়েছে। আসবাব কিছু কেনা হয়নি। একসাথে দুইজন মিলে কিনবে।
এতক্ষণ যা যা হচ্ছিল তার সবই প্ল্যান মতোই হচ্ছে। অটোরিক্সা চলে যাচ্ছে বাস বাসস্ট্যান্ডের দিকে। আটটা বাজতে এখনও আধা ঘন্টা বাকি। ভয়টা আর নেই।
কাউন্টারে আরও কিছু যাত্রীর মতোই তানহা একজন। তাহের বলে দিয়েছে কাউন্টারে কারও সাথে তেমন কোন আলাপ না করতে, যতদুর পারা যায় দূরে দূরে থাকতে। একটু আড়ালে থাকতে।
গাড়িতে উঠার জন্য তাগাদা দিয়ে গেল গাড়ির সুপার ভাইজার। সুপারভাইজারের হাতে বেগ দিয়ে টোকেন নিয়ে নিল তানহা। জানিয়ে দিল টেকনিক্যালে নামবে। অন্যান্য যাত্রীদের সাথে তানহাও গাড়িতে উঠে গেল।
গাড়িতে উঠতে উঠতে একটু থামলো তানহা। একটু পেছন ফিরে দেখে নিল চিরচেনা সেই পথকে, যে পথ দিয়ে একটু আগেই সে এসেছে। এই পথ দিয়ে সে কতকাল এসেছে তার ইয়াত্তা নেই কিন্তু আজ কেন যেন অন্য রকম লাগছে। এই পথে কি আর এভাবে আসতে পারবে? সে কি কাজটা ভুল করছে? তার কি এটা করা উচিত? এমন আরও কত কি যে ভাবল তার ঠিক নেই। চোখের কোণে জমা হওয়া দুই ফোটা জলকে সবার চোখের আড়ালে সযত্নে মুছে নিল।
গাড়ি যথাসময়েই চলতে শুরু করল। তানহা ভাবছে, এতক্ষণে হয়ত তার চিঠি মায়ের কাছে পৌঁছে গেছে। তাহের এই বিষয়টি নিয়ে কিছু জানে না। তানহার কাছে মা অনেক বড় আপন। মাকে ছাড়া কোন কিছু ভাবতে পারে না। এতবড় সিদ্ধান্ত মাকে না জানিয়ে নিতে তার মনে পীড়ন দিচ্ছিল। শিউলিকে একটা মুখ বন্ধ খাম ধরিয়ে দিয়ে বলে এসেছিল, রাত সাড়ে আটটার পর যেন এটা মায়ের কাছে পৌঁছে দেয়। বাবা যেন না জানে।
মা হয়ত এতক্ষণে চিঠি হাতে পেয়েছে। কি করবে চিঠি পেয়ে? অসুস্থ হয়ে পড়বে, ভেঙ্গে পড়বে, বাবাকে জানাবে? বাবাকে জানাতে না করেছে। বাবা পরেই জানুক বা নিজের মতো করেই জানুক, মা জানালে ভাববে মায়ের হাত আছে এতে।
মাকে জানিয়েছে, তাদের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করতে পারবে না। তাহের ছাড়া আর কাউকে সে বিয়ে করতে পারবে না। আর তাহেরের কি নেই? হয়ত চাকরিটা এখনও হয়নি। তবে হয়ে যাবে। যতদুর জানে রংপুর শহরে তাদের নিজস্ব বাসাও আছে। দেখতে শুনতেও খারাপ না। দোষ তার একটাই সে তানহাকে ভালবাসে। বাবা ভালোবাসা একদমই সহ্য করতে পারেন না। তার কথা হল ভালোবাসাবাসি হবে বিয়ের পর আগে না।
ভাবতে ভাবতে গাড়ি চলে এল মডার্ন মোড়। কাউন্টারের সামনে গাড়ি এসে দাঁড়ালো। রংপুর বদরগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডের কাছে আসার আগেই তানহা ফোনে বলেছে গাড়ি প্রায় চলে এসেছে। তাহের যেন রেডি থাকে। মডার্ণ মোড়ে গাড়ি দাঁড়ালে তানহা ফোন বের করল তাহেরকে ফোন দেওয়ার জন্য। কল দিয়ে কানের কাছে রাখতে শুনতে পেল যান্ত্রিক গলায় বলছে, এই মূহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব না, অনুগ্রহপূর্বক আবার চেষ্টা করতেও বলল। সুইচড অফ। কি হলো তাহেরের। গাড়ি তো বেশি সময় দাঁড়াবে না। এখন বাইরে না থেকে ভেতরে এসে বসা দরকার।
তানহা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। তাহেরের দেখা নেই। কোথাও নেই, এদিক ওদিক তাকিয়ে যতদুর পারা যায় খোঁজ নিল। নেই। একবার ভাবল বাইরে গিয়ে দেখবে কিনা। এখন এভাবে বাইরে নামা কি ঠিক হবে? এত সব ভাবছে এমন সময় সুপারভাইজার একটা খাম দিয়ে বলল, তাহের ভাই পরের স্টেশন থেকে উঠবে। উনার মোবাইল চুরি হয়ে গেছে। সেটার খোঁজে গেছেন।
গাড়ি ছেড়ে দিল। তানহার হাতে একটা হলুদ খাম। তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। কি হতে কি হল? পরের স্টেশন মানে কোথায় সেটা জানা হল না। এই গাড়ির পরের কাউন্টার কোথায় তাও জানা নেই।
তানহা খামের দিকে দিকে মনোযোগ দিল। হলুদ খামটা কি হতে পারে ভাবছে, উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখতে পেল খামের উপর তার নাম লেখা। গাড়ী মাত্র ছেড়েছে এখনও ভেতরের লাইট অফ করেনি। সেই আলোতে দেখল খামটায় প্রাপকের নামে তার নাম, প্রেরকের নামের ঘরে তাহেরের নাম। তাহলে কি এটা তানহার চিঠি?
তানহা কি মনে করে খুলে ফেলল খামটা। ভেতর থেকে বের হয়ে এলো চিঠি। উপরে লেখা তানহা। সে দ্রুত শেষ পৃষ্ঠায় চলে গেল ওখানে লেখা তাহের। বিষয়টা কি হতে পারে। এভাবে খাম ধরিয়ে দেওয়ার মানে কি? তার তাহেরই বা কেন পরের স্টেশনে উঠবে? তানহা সব কিছু ভুলে আগে চিঠি পড়া শুরু করলো-
তানহা,
এভাবে তোমাকে পত্র লিখতে হবে কখনও ভাবিনি। তোমার সাথে গাড়িতে উঠতে পারিনি তুমি অপেক্ষায় ছিলে, আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম গাড়ি ছেড়ে দিল, কিন্তু আমার মন আমাকে উঠতে দিল না। উঠতে দিল না আমার এই শরীর।
তুমি হয়ত ভাবছ কি আবোলতাবোল বকছি। তুমি হয়ত আমাকে কখনও ক্ষমা করতে পারবে না, এভাবে দূরে সরে গেলাম বলে। কি করব বল, একটা চরম প্রতিশোধ নেওয়ার ছিল, গত ১০-১২ বছর ধরে একটা কষ্টকে লালন করে এসেছি, সেই কষ্টকে ভুলতে আমাকে এভাবে চরম আঘাত হানতে হলো।
জানি তোমার এতে কোন দোষ ছিল না, কিন্তু কি করব বল, যাকে আঘাত দেব তাকে আঘাত দিতে গেলে এর চেয়ে বিকল্প কোন রাস্তা আমার জানা নেই। হয়ত ভাবছ কি বলছি এসব? তাহলে তোমাকে যেতে হবে আরও কয়েক বছর আগের কিছু সময়ে। তখন সবে মাত্র আমি ক্লাশ সেভেনে পড়ি। ভালো ছাত্র হিসাবে একটা আলাদা সুনাম ছিল আমার। তোমার বাবা ছিল আমাদের প্রধান শিক্ষক। আমাকে ছেলের মতোই ভালবাসতো। বলত আমি নাকি এই স্কুলের গর্বের কারণ হব। জানি না তিনি আমার মাঝে কি দেখেছিল।
তখন তুমি ক্লাশ ফাইভ শেষ করে সিক্স এ ভর্তি হয়েছ। তোমাকে চেনার কোন কারণই ছিল না আমার। একটু দুষ্ট হয়ত ছিলাম, কিন্তু মেয়েদের থেকে শত হাত দূরে থাকতাম। আমাদের ক্লাসের মারুফ ছিল হয়ত তার কথা তোমার মনে নেই। সে তোমাকে অনেক পছন্দ করতো। কারণে অকারণে তোমার সাথে কথা বলতে চাইতো। ও ছিল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওর সাথে আমি বেশি মিশতাম, ও যখন তোমার সাথে দেখা করতে যেত আমাকে জোর করেই নিয়ে যেত।
একদিন মারুফ বলল, তোমাকে নাকি ও পত্র দিবে। ওর নাকি ঘুম হয়না। তোমাকে না পেলে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার হাতের লেখা ভাল, এছাড়া আমি বই পড়তাম প্রচুর। আমাদের স্কুল লাইব্রেরিতে যত সাহিত্যের বই আছে তার অনেকগুলোই আমার পড়া হয়েছে। ও আমাকে বলল, একটা চিঠি লিখে দিতে। এমন ভাবে লিখতে হবে যেন চিঠি পড়েই তুমি পাগলের মতো ছুটে এসে বল, মারুফ আমিও তোমাকে...
ভাবলেও অবাক লাগে, কি হাস্যকর ছিল বিষয়টা। মেয়েদের থেকে দূরে থাকতাম, কিন্তু সাহিত্য পড়ে পড়ে মনে হত আমারও যদি এমন কোন স্বপ্নের মানুষ থাকত। তবে তা মনেই ছিল বাইরে আনার সাহসও পেতাম না। বন্ধুর আবদার না মেনে উপায় কি? রাত জেগে লিখলাম আমার জীবনের প্রথম প্রেম পত্র। তবে তা অন্যের জন্য। সাহিত্যের যত রোমান্টিক ডায়লগ ছিল তার সবই ঢেলে দিয়ে লিখলাম সেই চিঠি। লেখা শেষ হলে যখন পুনরায় দেখলাম তখন চিঠি পড়ে নিজেই নিজের প্রেমে পড়ে গেলাম।
পরদিন মারুফকে দিলাম সেই চিঠি। বিনিময়ে মারুফ আমাকে শহীদের দোকান থেকে চানাচুর খাওয়ালো। সেটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম লিখে আয় করা। মারুফ সেই চিঠি কিভাবে তোমাকে দিল, কি হল কিছুই জানি না। টিফিন পিরিয়ডের আগের পিরিয়ডে মফিজ স্যার আমাদের গণিত পড়াচ্ছিল। সেই ক্লাশে বিমল দপ্তরী এসে মফিজ স্যারকে কি যেন বলল। মফিজ স্যার আমাকে বলল, হেড স্যার দেখা করতে বলেছে।
আমি ক্লাশের পড়া অসমাপ্ত রেখে স্যারের রুমের দিকে গেলাম। সালাম দিয়ে প্রবেশ করলাম স্যারের রুমে। আমাদের স্কুলের সবচেয়ে ঠাণ্ডা শীতল কক্ষ হল হেড স্যারের রুম। প্রাইমারিতে থাকতে অনেকবার এসেছি স্যারের রুম দেখতে। এই রুমে একটা কঙ্কাল ছিল, যেটা জানালা দিয়ে দেখা যেত, এটা দেখতে অনেক শিক্ষার্থীর সাথে আমিও আসতাম।
এই স্কুলে ভর্তি হয়ে অনেকবার দেখেছি এখন আর এভাবে দেখা হয় না, এই রুমের পাশের রুমে লাইব্রেরি ওখানে প্রায়ই আসি পড়তে বই নিতে। স্যারের রুমে আসার পর স্যার বসতে বলল। আমি স্যারের বিপরীত দিকের চেয়ারে বসলাম। স্যার একটা পাতা এগিয়ে দিল, সেখানে কিছু শব্দ লেখা, শব্দ গুলো কেন যেন পরিচিত লাগছে। কোথায় যেন দেখেছি মনে পড়ছে না। কাগজটা হাতে নিলাম, স্যার বলল, এই শব্দের নিচে শব্দগুলো আবার লিখত।
পকেট থেকে কলম বের করে আমি লিখতে শুরু করলাম। লেখা শেষে দেখি স্যারের হাতে আরেকটা কাগজ। ওটা চিনতে পারলাম। মারুফকে যেটা লিখে দিয়েছিলাম সেটাই ওটা। স্যারের হাতে এল কি করে? স্যার এবার চিঠিটা আমার সামনে রেখে বলল, এটা তোর হাতের লেখা?
মিথ্যা বলতে পারি না, তাই বললাম, জ্বি স্যার। কিন্তু ওটা...
আমাকে আর কোন কথাই বলতে দিল না স্যার। টেবিলের উপর জোড়া বেত ছিল সেটা কখন যে উঠিয়ে এনে আমার পিঠে বসাচ্ছিলেন বলতেও পারব না। স্যার সচরাচর কাউকে মারেন না, তবে কাউকে বিচার করতে গিয়ে যদি মারের প্রয়োজন হয় সেটা হয় ঐ বছরের স্মরণীয় ঘটনা। তুমি এটা ভালই জানো। তোমার বাবাকে তুমি ছাড়া আর কেই বা ভালো করে চিনতে পারে?
সেদিন স্যারও আমাকে মেরেছিল। তার কিছু দাগ আজও আমার পিঠে রয়ে গেছে। স্যার মারতে মারতে আমাকে স্কুলের মাঠে নিয়ে আসে। অপরাধ তো কম না, দুইটা- ভালবেসে প্রেম পত্র দেওয়া, তাও আবার তার মেয়েকে। স্কুলের সব শিক্ষার্থী মাঠে চলে আসে। মনে হয় সার্কাস দেখছে। হেড স্যারের রাগ সবাই জানে। তাই কোন স্যারও এগিয়ে আসে না আমাকে বাঁচাতে। টানা ঘন্টা খানেকের মাঝে দুই জোড়া বেত আমার পিঠে ভেঙ্গে স্যার শান্ত হয়।
কিছুক্ষণ পর আমার বাবা আসে স্কুলে। তাকে আগেই খবর দেওয়া হয়েছিল, তার ছেলের অপরাধের বিস্তারিত জানিয়ে। বাবা এসে আমাকে নিয়ে যায় সাথে একটা সার্টিফিকেট। আমাকে স্কুল থেকে টিসি দেওয়া হয়েছে। তবে এই টুকু করুণা করেছিল যে রাস্টিকেট দিয়ে বের করে দেয়নি।
বাবা আমাকে এনে রংপুর হাসপাতালে ভর্তি করায়। অনেকে জানতে চেয়েছে কি হয়েছে বলেনি। এই কথা কি বলা যায়? ছেলে প্রেম করে চিঠি দিতে গিয়ে মেয়ের বাবার হাতে মার খেয়েছে। এই বয়সে প্রেম।
বাবা আমাকে এই বিষয়ে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি কখনও। হাসপাতালের দিনগুলোতে আমাকে সেবা করেছেন, সুস্থ করেছেন। বাবা চাকরী করতেন রংপুর। তবে গ্রামের স্কুলটি ভাল লাগত তার, সেও পড়েছেন এখানে আর কিছু জমাজমি ছিল সেগুলো দেখাশোনার ব্যাপার ছিল তাই শহরে যাননি, কিন্তু এই ঘটনার পর আমাকে ভর্তি করান রংপুর জেলা স্কুলে। শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করি আমরা। তোমার আমাকে মনে নেই সেটা যেদিন প্রথম দেখলাম সেদিনই বুঝতে পেরেছি। মনে থাকারও কথা না। আমি এক অপরাধী। তাকে মনে রাখার কি আছে?
তবে আমার মনে আছে সব, কিছুই ভুলতে পারিনি কখনও। আমি তোমার সব খবর রাখতাম। কখন কি হচ্ছে কোথায় আছ সব। তোমার বান্ধবীর কাছে খবর নিতাম, ও এতকিছু জানতো না। ভাবত আমি তোমাকে পছন্দ করি। তাই ও সহায়তা করত। এত কিছু জানলে হয়ত তোমাকে সাবধান করত।
তানহা আমি আজ স্বার্থক। ঐ দিন থেকে ইচ্ছে ছিল আমি হেড স্যারকে নাড়িয়ে দেব। আমি যে কষ্ট পেয়েছি কিছু না করেই সেই একই কষ্ট তিনিও পান আমি এটা চেয়েছি। বুঝুক সে কেমন লেগেছে আমার। জানি তুমি আমাকে খারাপ ভাববে। জগৎ আমাকে মন্দ বলবে। কিন্তু আমি চেয়েছি তুমি বাড়ি থেকে বের হয়ে আসো। তোমার বাবা যেন কাউকে মুখ দেখাতে না পারে। আমি যেমন এলাকা ছাড়া হয়েছি, বন্ধু-বান্ধব, আমার শৈশব হারিয়েছি, মন্দ ছেলে উপাধি পেয়েছি সেই রকম কিছু সেও যেন পায় তার পরিকল্পনা আমি সেই তখন থেকেই করেছি। আজ আমার পরিকল্পনা সফল হল।
তানহা আমাকে ক্ষমা করবে না, জানি। তোমার জন্যেও ভাবনা হয়। তোমাকে ভালোবাসার ইচ্ছে ছিল না, তবে অভিনয় করতে করতে কখন যে ভালোবেসে ফেলেছি নিজেও জানি না। চিন্তা কর না, কখনও সামনে দাঁড়াবো না। যে অপরাধ করেছি তার শাস্তি স্বরূপ এটা আমার প্রাপ্য। সিটের উপর দেখবে একটা ছোট একটা ব্যাগ আছে, ওখানে তোমার সব কাগজপত্র আছে। ভার্সিটিতে যে গুলো তোলার জন্য আবেদন করেছিলে। তা আমি এই কয়দিনে তুলে রেখেছি। ঢাকায় নেমে সরাসরি আজিমপুর কলোনিতে চলে যেও। ওখানে ২৬/২ নম্বর বাসার তিন তলায় তোমার জন্য একটা সিট নেওয়া হয়েছে ওখানে থাকতে পারবে। যে চিঠি তুমি মায়ের কাছে দিয়ে এসেছ, তাতে কয়েক মাস বা বছর বাড়িতে যেতে পারবে না। ফোন দিবে কোন মুখেও সেটাও ভাবনা। ব্যাগে দেখবে কিছু টাকাও আছে। ওগুলো খরচ করবে নিঃসংকোচে।
তোমার কি মনে আছে? প্রথম থেকেই তোমার একটা একাউন্ট করেছিলাম পোস্ট অফিসে। সেই একাউন্টের কার্ডও আমার কাছে ছিল, একাউন্টের সব টাকা তুলে ব্যাগে রেখেছি, কয়েক মাস চলতে পারবে। আশা করি কয়েকমাস পর বাড়ির পরিবেশ শান্ত হবে। তখন বাড়িতে চলে যেও। বাবা-মা কখনও ফেলতে পারবে না।
আর আমাকে ভুলে যেও। আমি তোমার প্রেমের যোগ্য না। আমি আসলে ভালই বাসতে পারি না। সবার দ্বারা তো সব হয় না।
ভালো থেক আর আমায় খুঁজো না। আমাকে ধুমকেতু মনে করে ভুলে যেও হঠাৎ এসেছিলাম আবার হঠাৎ চলেও গেলাম। ভালো থেক সব সময়।
ইতি
অপরাধী একজন ধুমকেতু।
তানহার চিঠি পড়া শেষ হল। ওর চোখের কোণে জলের ধারা ফুটে উঠেছে। পারছে না হাউমাউ করে কাঁদতে। দুঃখ, রাগ, কষ্ট সব যেন একেবারে খুবলে ধরেছে। বুঝতে পারছে না কার উপর রাগ করা উচিত। বাবা, তাহের না নিজের প্রতি।
ওর সব মনে আছে। তবে তাহেরই যে ছিল সেই ঘটনায় জড়িত তা মনে করতে পারেনি কখনও। এই কয় বছরে তাহেরের চেহেরা অনেক পরিবর্তন হয়েছে। চেনার কথা না। তখন তানহা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ত।
সেদিনের কথা আজও মনে আছে। মারুফ তার সামনে এসে দাঁড়ায়। কি যে বলে তার কিছুই কানে যায় না। হঠাৎ একটা কাগজ বাড়িয়ে বলে এটা তোমার জন্য। তানহা চিঠিটা হালকা পড়ে। কিছু বুঝে কিছু বোঝেনা। ফেলে দিতে যায় তখনই বাবার চোখে পড়ে। বাবা চিঠি নিয়ে অফিস ঘরে যায়। তানহাকে কিছুই বলে না বা জিজ্ঞাসা করে না। এরপর তো সব ইতিহাস।
তবে বাড়িতে গিয়ে বাবা অনেক কাঁদে সেদিন। তাহের ছিল তার প্রিয় ছাত্র। তাকে নিয়ে অনেক আশা ভরসা করতো। মাঝে মাঝেই ওর গল্প করত বাবা। সেই ছেলে এমন একটা কাজ করবে ভাবতেও পারেনি। তার রাগও অনেক বেশি। বাড়িতে এসে অপরাধ বোধে ভুগতে থাকে সে। তানহাও ভয়ে বলতেও পারেনি যে চিঠিটা তাহের না মারুফ দিয়েছিল।
এর এক সপ্তাহ বাড়ির বাইরে যায়নি বাবা। কতবার ভেবেছে তাহেরের বাড়ি গিয়ে কথা বলবে। কিন্তু সংস্কার তাকে হয়ত বাঁধা দিয়েছে। এখনও মাঝে মাঝেই বলে তাহেরের কথা। আজও সে অপরাধ বোধ থেকে মুক্তি পায়নি।
তানহা মনে মনে বলতে থাকে তাহের তুমি এটা কি করলে? তুমি জানো না, বাবা কতটা মনোকষ্টে ভুগে এটা মনে করে। ভাবে তোমার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে।
তানহা চোখ মুছে আশে পাশে তাকায়, এতক্ষণ একটানা চিঠি পড়তে পড়তে ভুলেই গিয়েছিল সে এখন গাড়িতে আছে। বাইরে তাকালো। শো শো করে গাড়ি ছুটে চলছে। কেউ কাউকে সাইড দিতে চায়না, পাল্লাপাল্লি করে চলছে গাড়ি। একেবারে কাছে এসে সাইড দিচ্ছে এই মনে হচ্ছে লেগে যাবে আবার দেখা যায় লাগেনি।
কতক্ষণ যে এভাবে চলছিল জানা নেই। তানহার চোখ দুটো লেগে এসেছিল হয়ত ঘুমিয়েও ছিল। গাড়ি বন্ধ হওয়ায় চোখ খুলে যায়। বাইরে দেখে গোবিন্দগঞ্জ। যাত্রী তুলবে। সুপারভাইজার একজন যাত্রী এনে এই সিটে বসিয়ে দিয়ে যায়। ছেলেটিকে দেখলে মনে হয় হয়ত এবার কলেজ পাশ করেছে। তাহের তো উঠবে না, আশায় ছিল হয়ত এই স্টেশনে এসে বলবে আমি এসেছি। তা আর হল না। গাড়ি আবার ছেড়ে দিয়েছে।
ঘুম আসছে না, সামনের দিনগুলো নিয়ে ভাবতে বসল, কি করা উচিত তার? বাড়ি ফিরে যাবে? কি করে। বাবা হয়ত আর ঘরেই তুলবে না। তার চেয়ে ঢাকায় চলে যাই সেই ভাল। সব ছেড়ে হারিয়ে যাবে সে সবার থেকে দূরে। সামনে তাকালো তানহা। সব সিট প্রায় নামানো, সামনের রাস্তার গাড়িগুলোকে দেখছে। কি গতিতে আসছে ভয় লাগে। কতক্ষণ চেয়ে ছিল মনে নেই শুধু মনে আছে একটা তীব্র আলো সরাসরি এসে ধাক্কা দিল তাদের গাড়িকে।
তারপর আর কিছুই মনে নেই তানহার। শুধু কিছু হইচইয়ের আওয়াজ শুনতে পায়। বুঝতে পারে দূর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সে কেমন আছে কিছুই বুঝতে পারে না, শুধু বুঝতে পারে তার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে, ঘুম, আহা কি শান্তির ঘুম দু চোখ জুড়ে আসছে। সে নিশ্চিন্তে চোখ দুটো বন্ধ করে দিল।।
এমনিতে সব সময় এই রাস্তায় ভ্যান পাওয়া যায়। আজ কেন যেন একটা ভ্যানও দেখা যাচ্ছে না। বারে বারে তানহা মোবাইলের ঘড়ি দেখছে। তার মুখে টেনশনের ছাপ ফুটে উঠেছে। টের পেল এই শীতেও তার শরীর বেয়ে ঘাম ঝরে পড়ছে। একটু পর পর সে বেঞ্চ থেকে উঠে রাস্তায় আসে দেখে কোন অটো ভ্যান আসে কিনা। আবার গিয়ে বেঞ্চে বসে, তাকে দেখলে যে কেউ বুঝবে যে কোন একটা সমস্যা আছে।
সে যে বাড়ি থেকে বের হয়ে এখানে এসেছে তা কারও জানার কথা না। গতকাল কৌশলে ব্যাগে কাপড়চোপড় গুছিয়ে বান্ধবী শিউলিদের বাড়ি রেখে এসেছিল। বাড়ি থেকে বিকেলে বের হয়েছে তানহা। আগেই সব ঠিক করা ছিল, সেই অনুযায়ী বিকেলে তানহা ফোন বন্ধ রাখে। শিউলির ছোট বোন বিকেলে তানহার বাবার ফোনে ফোন দেয়। কাতর কণ্ঠে জানায় শিউলির ভীষন জ্বর। বাড়িতে মা নেই। এখন ও কি করবে বুঝতে পারছে না। তানহাকে কি একটু পাঠিয়ে দিবেন?
শিউলি তানহার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী, ছোট বেলা থেকে কলেজ পর্যন্ত একই সাথে পড়াশোনা করেছে, বড় হয়েছে। কলেজ শেষ করে তানহা গেছে ঢাকায় পড়তে আর শিউলি কারমাইকেলে পড়ছে। শিউলির কথা শুনে তানহার বাবা এই সময়েও তানহাকে বাড়ি থেকে বের হতে দিয়েছে।
তানহার এভাবে বের হয়ে যাওয়াকে মা সায় দিতে চায়নি। তার মনে কু-ডাক ডাকছে। আজ বাদে কাল যে মেয়ের বিয়ে সে বাড়ির বাইরে যাবে এটা কোন মাই সইতে পারবে না। তানহার বাবা তালেব মাস্টার শিউলির জ্বরের কথা শুনে মেয়েকে আটকায়নি। আর এই বাড়িতে তার কথাই শেষ কথা।
তানহা একবার ভাবল হেঁটেই রওয়ানা দিবে কিনা। অনেক সময় বিবাড়িয়ায় অটো পাওয়া যায়। হাঁটলে পনেরো মিনিট লাগতে পারে। তবে এই ব্যাগ নিয়ে হাঁটাও মুশকিল। এখন বাজে ছয়টা, আটটায় গাড়ি। অনেক সময় হাতে আছে। তাও ভয় হয়, যদি কিছু না পায়। ভাবল, সাতটা পর্যন্ত দেখবে কিছু না পেলে হেঁটেই রওয়ানা দিবে।
গাড়ির কথায় তার মনে পড়ল টিকেটের কথা। হানিফ পরিবহনের একটাই নাইটকোচ বদরগঞ্জ থেকে ঢাকায় যায়। রাত আটটার গাড়িতে দুইটা টিকেট গতকালই কেনা হয়েছে। টিকিটগুলো ভ্যানিটি ব্যাগের সাইড পকেটে রেখেছিল। সাইড পকেট খুলে দেখে টিকিট দুইটা ওখানেই আছে।
টিকিটগুলো তাহের গতকালই শিউলির বোনের কাছে কিনে পাঠিয়ে দিয়েছে। তাহেরের সব দিকেই খেয়াল আছে। কীভাবে বাড়ি থেকে বের হতে হবে, কোন জায়গা থেকে বাসে উঠতে হবে, সে কোথায় উঠবে সব ঠিক করে বিস্তারিত প্ল্যান বানিয়ে তানহাকে শুনিয়েছে।
সেই মতো রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ভ্যান বা অটো না পেলে তো সব প্ল্যান নষ্ট হবে। প্ল্যানমতো সব কিছু ঠিকঠাক না হলে কি হবে ভাবতেই একটা ভয়ের ঠাণ্ডা স্রোত মাথা থেকে পা পর্যন্ত বয়ে গেল।
তানহা এতো টেনশন নিতে পারছে না। রাত বেড়ে যাচ্ছে। যে কোন সময় পরিচিত কেউ আসতে পারে। একবার ভাবছে ফিরে যাবে কিনা, আবার ভাবছে তা কি করে হয়। এতদিনের প্রেম, ভালোবাসা সব জলাঞ্জলি দিয়ে তাহেরকে ঠকাতে পারবে না। কিছু একটা তাকে করতেই হবে। প্রেমের জন্য অষ্টম এডওয়ার্ড সিংহাসন ছেড়ে ছিল। এইতো সেদিনের ঘটনা, ১৯৩৬ সালে প্রেমিকা ওয়ালিস ওয়ারফিল্ড সিম্পসনকে বিয়ে করতে চাইলে না করা হয়। শেষে প্রেমকে টিকিয়ে রাখতে সিংহাসনই ছেড়ে দেয়। আর তানহা সামান্য এই কষ্টটুকু করতে পারবে না?
ব্যাগ হাতে হাঁটতে যাবে এই সময়ে টুং টাং শুনে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালো। যা ভেবেছিল তাই। একটা খালি ওটো-রিক্সা আসছে। এটাকে থামিয়ে দরদাম করে উঠে বসলো। ভয় কিছুটা কমে গেল। পৌঁছাতে আর বেশি সময় লাগবে না।
ভয় কমে যাওয়ার মনে যা জায়গা করে নিল তা হলো খারাপ লাগা। বাড়ির জন্য মন কেমন করছে। বাবা-মা এতো ভালোবাসে তাকে, তাদের এই ভাবে আঘাত দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে? একবার ভাবে ফিরে যায়। তখনই মনে পড়ে তাহেরের মায়া ভরা প্রেমময় মুখ। বাবা তাহেরের সাথে তার সম্পর্ক কোন দিনই মেনে নিবে না। মা কিছুটা জানতো, সব জানে না। শুধু জানে মেয়ে একটা ছেলেকে পছন্দ করে। মেয়ের হয়ে তার স্বামীকে বলতেও গিয়েছিল। বাবা কোন কথাই শুনতে চাননি। তার পছন্দ মতো মেয়েকে বিয়ে করতে হবে। এই নিয়ে যেন দ্বিতীয়বার কোন কথা না হয়।
তানহা কোন কিছুই বলেনি। উত্তর পাড়ার রফিক ভাইয়ের পরিবার থেকে যেদিন দেখতে এসেছে সেদিনও বাধ্য মেয়ের মতো তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তানহা দেখতে গড়পড়তা মেয়েদের চেয়ে একটু বেশিই সুন্দর। বাঙ্গালী মেয়েরা খুব একটা লম্বা হয়না। তবে তানহা তাদের চেয়ে একটু ভাগ্যবান। ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি লম্বা তানহা যখন শাড়ি পড়ে তখন আরেকটু লম্বাও লাগে।
কিছু কিছু মেয়ে থাকে যারা শাড়ী পড়লে মনে হয় শাড়িতে তাকে মানিয়েছে, না শাড়ী তাকে পেয়ে মানিয়েছে। যেন সোনার হাতে সোনার চুড়ি, কেকার অলঙ্কার। তানহা সেই রকম। খুব বেশি মোটা নয় আবার একেবারে পাটকাঠিও নয়। ছিপছিপে মেয়েটি যখন হেঁটে যায় তখন দ্বিতীয় বার দেখতে যে কেউ অজুহাত খুঁজে।
তাহের তানহার শাড়ী পড়াটাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। যেদিন প্রথম দেখা হয়, সেদিনই বলেছিল আপনি শাড়ী পড়েন না কেন? শাড়ী পড়লে আপনাকে রাজকন্যার মতো লাগবে জানেন এটা?
তাহেরের সাথে দেখা হওয়ার সময় প্রথম কথাই ছিল এটা। তানহা অবাক হয়েছিল, এই সুরে কেউ কাউকে প্রথম দর্শনে বলে? শিউলি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। তার দূর সম্পর্কে কেমন যেন ভাই লাগে। ঢাবিতে ভর্তির ফরম পূরণ করে জমা দেওয়ার দিন কলাভবনে তাদের সাথে দেখা হয়। তাহের তখন তৃতীয় বর্ষে পড়ে। হলে থাকে। সারা সকাল তানহাদের সঙ্গ দিয়েছিল। কলাভবন, টিএসসি কার্জন হল সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল।
ভর্তি পরীক্ষায় কি কি পড়তে হবে, কিভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে তার বিষয়ে অনেক খুঁটিনাটিও জানিয়েছিল। তাহেরের কথায় লোভ লাগে তানহার, ভাবে এখানে ভর্তি হতে না পারলে জীবন বৃথা। তাহেরের কথায়, তার ব্যবহার আর এই হালকা দুষ্টামিকেও ভালো লাগে। একটা মুগ্ধতা কাজ করে তার মাঝে। সেই একই মুগ্ধতা আজ তাকে ঘর ছেড়ে বাইরে নিয়ে এসেছে।
তানহা যেদিন ঢাবিতে চান্স পায় সেদিন সব চেয়ে বেশি খুশি হয় তানহার বাবা।স্কুল শিক্ষক তালেব মাস্টার সারা জীবন অনেক শিক্ষার্থীকে পড়িয়েছে। তারা আজ অনেকে খুব বড় বড় জায়গায় আছে, তার একটা সুপ্ত ইচ্ছে ছিল নিজের কেউ যদি এমন একটা জায়গা নিতে পারতো। তার ছেলেকে দিয়ে চেষ্টা করেছে হয়নি। ইন্টার পাশ করে আর পড়তেই পারেনি, তার নাকি পড়া ভাল লাগে না। টাকার জোগাড় করে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছে। মেয়েকে নিয়ে আশা করেছিল, কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিল, মেয়ে হয়ত কিছু একটা করবে। আজ তার আশা পূরণ হয়েছে।
তবে তানহার মন খারাপ, বাবা-মাকে রেখে চলে যেতে হবে। আবার ভালো লাগাও আছে। শেষ পর্যন্ত ভর্তি হতে পারলো। এই কয়দিনে অনেক স্বপ্ন দেখেছে ভার্সিটিকে নিয়ে। আরেকটা গোপন আনন্দও আছে। তাহেরের সাথে আবার দেখা হবে। ফরম জমা দেওয়ার সময় দেখা হয়েছিল, এরপর আবার দেখা হয় পরীক্ষা দিতে গিয়ে। পরীক্ষার আগে যে টেনশন ছিল তা পরীক্ষা দেওয়ার পর মিটে যায়। কেন যেন ওর মন বলে এখানে চান্স হবে। প্রস্তুতিও ছিল, পরীক্ষাও ভালো হয়, তাই পরীক্ষার পর আড্ডাটাও জমে ভালো। প্রথম বার যে জড়তা ছিল দ্বিতীয় বার সেটা থাকেনি। কথায় কথায় জেনেছে তাহেরের বাসা রংপুর। তবে আদি বাড়ি ছিল আরও দূরে। ছোট বেলায় ওরা রংপুর এসেছে। জেলা স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে ঢাকায় চলে আসে। ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ভর্তি হয় ঢাবিতে। হলে থাকে।
তাহেরের যে জিনিসটা বেশি ভালো লাগে তা হলো ওর ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা এক টুকরো হাসি। গল্প করার ফাঁকে তানহা বেশ কয়েকবার এটা লক্ষ্য করেছে। তবে তাহেরের চোখকে ফাঁকি দিয়ে দেখতে হয়েছে। আজ তাহেরের কয়েকজন বন্ধুও আছে আড্ডায়। তারাও অনেক মজার মানুষ। কত যে গল্প শুনিয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। তানহা ভাবে ভার্সিটি কত মজার জীবন।
তানহার গাড়ি রাত দশটায়। বিকেলের গাড়িতে আসতে পারতো, তাহলে অনেক ভোরে বা রাতে গাড়ি থেকে নামতে হতো। তাই কষ্ট করে হলেও রাতের গাড়িতে রওয়ানা হওয়া ভালো। তানহার মামা থাকে ঢাকায় সেও আজ বাড়ি যাবে। একসাথেই যাবে। মামার অফিস ছুটি হবে বিকেল পাঁচটায়। কথা হয়েছে, তানহা আর শিউলি সন্ধের দিকে কাউন্টারে চলে যাবে। মামা পরে আসবে।
দুপুরের খাওয়া হলো নীলক্ষেতের মামা হোটেলে। বাড়ির বাইরে বেশি আসেনি, বাইরে বেশি কোথাও খায়নি তানহার। ভেবেছিল খেতে পারবে কিনা। তবে এখানের খাওয়া খারাপ লাগেনি। খাওয়া শেষে আবার আড্ডা। মল চত্ত্বরে বসে সারাটা বিকেল কীভাবে কেটে গেল বুঝতেও পারলো না।
সন্ধায় সবাই মিলে চলে এল কল্যাণপুর। বাস কাউন্টারে পৌঁছে দিল ওদের। নিউমার্কেট থেকে রিক্সা এতদূরে যেতে চায়না। একটা রিক্সা কোন মতে রাজি হলো। তিনজন এক রিক্সায় যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। এর আগে রিক্সায় কোন ছেলের সাথে উঠেনি তানহা। আজ এভাবে যেতে একটু একটু খারাপও লাগছিল। কিছু না বললেও হয়ত ওর মুখে এটা ফুটে উঠেছিল। বিষয়টি দেখে তাহের কিছুটা ইতস্ততবোধ করছিল কি করবে সেটা নিয়ে। তানহাই সমাধান দিল। বলল, তিনজন যেতে আপত্তি নেই তার।
হালকা হালকা বাতাস বইছে। রিক্সা চলছে তার নিজস্ব গতিতে। তবে মাঝে মাঝেই থামতে হচ্ছে। তানহার কানে আসে গুনগুন করে গাওয়া তাহেরের মুখের গান। তানহা সাহস নিয়ে বলে ভাইয়া, আরেকটু জোড়ে গাওয়া যায় না? আমরাও শুনি। তাহের গলার আওয়াজটা একটু বাড়িয়ে দেয়-
আমার সারাটি দিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম,
শুধু শ্রাবণ সন্ধা টুকু তোমার কাছে চেয়ে নিলাম।
তানহার প্রিয় একটা গান। তাহের জানল কি করে এটা ওর প্রিয় গান। কি করে মিলে গেল?
খুব খারাপ একটা ঝাঁকুনিতে বাস্তবে ফিরে এল তানহা। না সে এখন ঢাকায় নেই। অন্ধকার রাস্তায় বদরগঞ্জের দিকে যাচ্ছে। রাস্তাটার অনেক অংশই ভেঙ্গে গেছে, তার উপর অন্ধকার রাস্তা। ঝাঁকুনিটা বেশ জোরেই লেগেছে। তানহার মনটা কেমন যেন করছে। এতক্ষণে কি বাড়ির সবাই জেনে গেছে? শিউলিকে বলে এসেছে মাকে ফোন দিয়ে যেন বলে রাতে ও ফিরতে পারবে না। ওর অসুখ কমেনি।
মায়ের মন কি মানবে? যদি এখনই বাবাকে পাঠিয়ে দেয়, তাহলে তো ধরা পড়তে হবে। আর বাবা জানলে তার সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে। কখন যে আটটা বাজবে গাড়ি ছাড়বে সেটাই চিন্তা তানহার। গাড়ি একবার ছেড়ে দিলে আর চিন্তা কিছু থাকবে না। মডার্ণ মোড় থেকে তাহের উঠবে। এইটুকু রাস্তা তাকে একাই যেতে হবে। অসুবিধা নেই, ঢাকায় একা একা এই গাড়িতে এর আগেও কয়েকবার গিয়েছে। আর আজ তো রংপুর পর্যন্ত একা একা যেতে হবে। রংপুর থেকে দেখা পাবে তার মনের মানুষের। ঢাকায় গিয়ে তারা একটা সংসার পাতবে।
আসলে এভাবে একা একা বিয়ে করার কোন স্বপ্ন, ইচ্ছে কোনটাই ছিল না তানহার। ইচ্ছে ছিল বউ সেজে থাকবে, লাল টুকটুকে একটা শাড়ী পড়ে বসে থাকবে আর বর এসে নিয়ে যাবে। স্বপ্ন ছিল সাজানো গোছানো একটি বাসর ঘর হবে। রাত জেগে গাইবে প্রেমের গান। সেটা আর হল না।
এবারই মাস্টার্স শেষ হল, এখন বিয়ে দেবেনা তো আর কবে দিবে। এর আগে যতবার বিয়ের কথা উঠছে ততবার বলেছে পড়াশোনা শেষ করি তারপর। সেই পড়াশোনা যেহেতু শেষ তাহলে আর অপেক্ষা কেন? মেয়ে ঢাবি থেকে পাশ করেছ। অনেক ছেলেই দেখতে আসে।
তানহা এটা ওটা বলে কাটিয়ে দিতে চায়। কিন্তু এভাবে আর কত? এক সময় মাকে বলে সে এখন বিয়ে করবে না। একথায় ওকথায় জানাতে হয়, একটা ছেলেকে সে পছন্দ করে। তাকেই বিয়ে করবে। ছেলেটি চাকরীর চেষ্টা করছে। হয়ত চাকরী হয়েই যাবে। চাকরী হলেই বিয়ে করতে পারবে। মাকে বলে যেন, কথাটা বাবার কানে দিয়ে দেয়।
মা কথাটা বাবার কানে পুরোটা দিতে পারেনি। বাবা অর্ধেক কথা শুনেই বলেছে এই বাড়িতে এই রকম কাজ কেউ করেনি তাই তানহাও করতে পারবে না। দ্বিতীয় বার যেন এই বিষয়ে আর কথা না হয়।
প্রেম ভালোবাসা বিষয়গুলো বাবা একদমই শুনতে চায় না। তালেব মাস্টারের খ্যাতি ছিল শিক্ষার্থী শাসনের। একবার সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে এমন মার দিয়েছিল যে সাতদিন পর্যন্ত তাকে বিছানায় থাকতে হয়েছিল। অথচ ঐ শিক্ষার্থী ছিল তার প্রিয় পাত্র। পরে অবশ্য জানতে পারে যে কারণে মেরেছিল তার দোষ ঐ শিক্ষার্থী করেনি। এই নিয়ে সারাজীবন তার আক্ষেপ ছিল। ঐ ছেলেটি অবশ্য আর থাকেনি স্কুলটিতে। কোথায় যে হারিয়ে গেছে জানতেও পারে নাই।
তানহা চোখের সামনে তার বাড়ির সব কিছু দেখতে পারছে। এই কয়দিনে অনেক ভেবেছে। সে এভাবে চলে গেলে কি হতে পারে। বাবা অনেক কষ্ট পাবে, কিন্তু কি করবে ও। তাহের কোন অংশে কম না, চাকরী একটা হয়ে যাবে হয়ত এই কয়দিনে। কথাবার্তা কিছুটা ফাইনাল। ছেলে হিসেবে ভাল, দেখতেও ভাল। এমন ছেলেকে বাদ দিয়ে কেন যে বাবা-মা মাথায় মাথা ভর্তি টাক তবে পকেটে টাকা ওয়ালা বয়স্ক ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দেয় তাই সে বুঝে না।
অটো চলতে থাকে, রাত বাড়তে থাকে, আর তানহার সব ঘটনা আজ একের পর এক চোখের সামনে আসতে থাকে। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকে তাহেরের সাথে প্রতিদিন দেখা হয়। আড্ডাও চলে আগের মতো। তবে পার্থক্য এখন আর শিউলি থাকে না। ও ভর্তি হতে পারেনি। পরিচয়ের পর কেটে যায় দুই বছর। এর মাঝে কোন চারিত্রিক দুর্বলতা দেখতে পায়নি তানহা। সব সময় একটা ভদ্র আচরণ তাকে মুগ্ধ করেছে। সেই মুগ্ধতা এক সময়ে ভালবাসায় রূপান্তরিত হয়। কিন্তু চিরায়িত সংস্কৃতিতে পারেনা নিজে কিছু বলতে।
চতুর্থ বর্ষ ফাইনাল দিয়ে তাহের জানায় সে তানহাকে ভালবাসে। এতদিন বুঝতে বুঝতে কেটে যায়, সে শিওর হতে চায় তানহা কতটা ভালবাসে। এই কয়দিনে বুঝেছে। তানহাও তাকে পাগলের মতো ভালবাসে। তাইতো ভালবাসার সাগরে দুইজনের ভাসতে আর সময় লাগে না।
ঢাকায় দুইজনেরই কেউ নেই। নিজেরা স্বাধীনমতো ঘুরে বেড়াতে পেরেছে কেউ কিছু বলতে পারেনি। তবে তারা স্বাধীনতার কোন বরখেলাপ করেনি। এমন কিছু করেনি যাতে নিজেকে অপরাধী লাগে। একারণে তাহেরকে আরও বেশি ভালোবেসে ফেলেছে।
প্রতিদিনই বাবা একের পর এক ছেলের খোঁজ নিয়ে আসে। তাহেরের চাকরিও হচ্ছে না। বাড়ি থেকে বাবা মাকে নিয়ে আসবে কোন মুখে, যদি বলে ছেলে কি করে তাহলে জবাব তো দিতেই হবে। এই সেই করতে করতে শেষে ফেঁসে যায় তানহা। এবার যে পাত্র এসেছে সবদিক দিয়েই একদম পারফেক্ট। তাকে না করার কিছুই নেই। পাত্র বুয়েট থেকে পাশ করে এখন একটা বড় নামী প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করে। এমন পাত্র কি হাতছাড়া করা যায়। তাও আবার ঐ পরিবারের একমাত্র ছেলে।
এর মাঝে কথা হয় তাহেরের সাথে। বিস্তারিত পরিকল্পনা শুনিয়ে আশ্বস্ত করে। কীভাবে তানহা বাড়ি থেকে বের হবে। কয়টা সময় কোন রাস্তায় থাকবে, কোন পথ দিয়ে যাবে, কোন গাড়িতে উঠবে, কয়টার গাড়িতে টিকেট কাটা থাকবে, টিকেট কোথায় কার কাছে থাকবে, কার কাছ থেকে নিতে হবে। গাড়ি কয়টায় ছাড়বে সে কোথায় উঠবে সব জানায়। ওরা প্রথমে ঢাকায় যাবে। সেখানে বিয়ের কাজটা সেরে চলে যাবে সরাসরি কক্সবাজার। ওখানে রুম বুকিং দেওয়া আছে। তিনদিন থাকবে ওখানে। তারপর আসবে ঢাকায়। তাহের জানায় এক রুমের বাসাও নেওয়া হয়েছে। আসবাব কিছু কেনা হয়নি। একসাথে দুইজন মিলে কিনবে।
এতক্ষণ যা যা হচ্ছিল তার সবই প্ল্যান মতোই হচ্ছে। অটোরিক্সা চলে যাচ্ছে বাস বাসস্ট্যান্ডের দিকে। আটটা বাজতে এখনও আধা ঘন্টা বাকি। ভয়টা আর নেই।
কাউন্টারে আরও কিছু যাত্রীর মতোই তানহা একজন। তাহের বলে দিয়েছে কাউন্টারে কারও সাথে তেমন কোন আলাপ না করতে, যতদুর পারা যায় দূরে দূরে থাকতে। একটু আড়ালে থাকতে।
গাড়িতে উঠার জন্য তাগাদা দিয়ে গেল গাড়ির সুপার ভাইজার। সুপারভাইজারের হাতে বেগ দিয়ে টোকেন নিয়ে নিল তানহা। জানিয়ে দিল টেকনিক্যালে নামবে। অন্যান্য যাত্রীদের সাথে তানহাও গাড়িতে উঠে গেল।
গাড়িতে উঠতে উঠতে একটু থামলো তানহা। একটু পেছন ফিরে দেখে নিল চিরচেনা সেই পথকে, যে পথ দিয়ে একটু আগেই সে এসেছে। এই পথ দিয়ে সে কতকাল এসেছে তার ইয়াত্তা নেই কিন্তু আজ কেন যেন অন্য রকম লাগছে। এই পথে কি আর এভাবে আসতে পারবে? সে কি কাজটা ভুল করছে? তার কি এটা করা উচিত? এমন আরও কত কি যে ভাবল তার ঠিক নেই। চোখের কোণে জমা হওয়া দুই ফোটা জলকে সবার চোখের আড়ালে সযত্নে মুছে নিল।
গাড়ি যথাসময়েই চলতে শুরু করল। তানহা ভাবছে, এতক্ষণে হয়ত তার চিঠি মায়ের কাছে পৌঁছে গেছে। তাহের এই বিষয়টি নিয়ে কিছু জানে না। তানহার কাছে মা অনেক বড় আপন। মাকে ছাড়া কোন কিছু ভাবতে পারে না। এতবড় সিদ্ধান্ত মাকে না জানিয়ে নিতে তার মনে পীড়ন দিচ্ছিল। শিউলিকে একটা মুখ বন্ধ খাম ধরিয়ে দিয়ে বলে এসেছিল, রাত সাড়ে আটটার পর যেন এটা মায়ের কাছে পৌঁছে দেয়। বাবা যেন না জানে।
মা হয়ত এতক্ষণে চিঠি হাতে পেয়েছে। কি করবে চিঠি পেয়ে? অসুস্থ হয়ে পড়বে, ভেঙ্গে পড়বে, বাবাকে জানাবে? বাবাকে জানাতে না করেছে। বাবা পরেই জানুক বা নিজের মতো করেই জানুক, মা জানালে ভাববে মায়ের হাত আছে এতে।
মাকে জানিয়েছে, তাদের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করতে পারবে না। তাহের ছাড়া আর কাউকে সে বিয়ে করতে পারবে না। আর তাহেরের কি নেই? হয়ত চাকরিটা এখনও হয়নি। তবে হয়ে যাবে। যতদুর জানে রংপুর শহরে তাদের নিজস্ব বাসাও আছে। দেখতে শুনতেও খারাপ না। দোষ তার একটাই সে তানহাকে ভালবাসে। বাবা ভালোবাসা একদমই সহ্য করতে পারেন না। তার কথা হল ভালোবাসাবাসি হবে বিয়ের পর আগে না।
ভাবতে ভাবতে গাড়ি চলে এল মডার্ন মোড়। কাউন্টারের সামনে গাড়ি এসে দাঁড়ালো। রংপুর বদরগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডের কাছে আসার আগেই তানহা ফোনে বলেছে গাড়ি প্রায় চলে এসেছে। তাহের যেন রেডি থাকে। মডার্ণ মোড়ে গাড়ি দাঁড়ালে তানহা ফোন বের করল তাহেরকে ফোন দেওয়ার জন্য। কল দিয়ে কানের কাছে রাখতে শুনতে পেল যান্ত্রিক গলায় বলছে, এই মূহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব না, অনুগ্রহপূর্বক আবার চেষ্টা করতেও বলল। সুইচড অফ। কি হলো তাহেরের। গাড়ি তো বেশি সময় দাঁড়াবে না। এখন বাইরে না থেকে ভেতরে এসে বসা দরকার।
তানহা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। তাহেরের দেখা নেই। কোথাও নেই, এদিক ওদিক তাকিয়ে যতদুর পারা যায় খোঁজ নিল। নেই। একবার ভাবল বাইরে গিয়ে দেখবে কিনা। এখন এভাবে বাইরে নামা কি ঠিক হবে? এত সব ভাবছে এমন সময় সুপারভাইজার একটা খাম দিয়ে বলল, তাহের ভাই পরের স্টেশন থেকে উঠবে। উনার মোবাইল চুরি হয়ে গেছে। সেটার খোঁজে গেছেন।
গাড়ি ছেড়ে দিল। তানহার হাতে একটা হলুদ খাম। তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। কি হতে কি হল? পরের স্টেশন মানে কোথায় সেটা জানা হল না। এই গাড়ির পরের কাউন্টার কোথায় তাও জানা নেই।
তানহা খামের দিকে দিকে মনোযোগ দিল। হলুদ খামটা কি হতে পারে ভাবছে, উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখতে পেল খামের উপর তার নাম লেখা। গাড়ী মাত্র ছেড়েছে এখনও ভেতরের লাইট অফ করেনি। সেই আলোতে দেখল খামটায় প্রাপকের নামে তার নাম, প্রেরকের নামের ঘরে তাহেরের নাম। তাহলে কি এটা তানহার চিঠি?
তানহা কি মনে করে খুলে ফেলল খামটা। ভেতর থেকে বের হয়ে এলো চিঠি। উপরে লেখা তানহা। সে দ্রুত শেষ পৃষ্ঠায় চলে গেল ওখানে লেখা তাহের। বিষয়টা কি হতে পারে। এভাবে খাম ধরিয়ে দেওয়ার মানে কি? তার তাহেরই বা কেন পরের স্টেশনে উঠবে? তানহা সব কিছু ভুলে আগে চিঠি পড়া শুরু করলো-
তানহা,
এভাবে তোমাকে পত্র লিখতে হবে কখনও ভাবিনি। তোমার সাথে গাড়িতে উঠতে পারিনি তুমি অপেক্ষায় ছিলে, আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম গাড়ি ছেড়ে দিল, কিন্তু আমার মন আমাকে উঠতে দিল না। উঠতে দিল না আমার এই শরীর।
তুমি হয়ত ভাবছ কি আবোলতাবোল বকছি। তুমি হয়ত আমাকে কখনও ক্ষমা করতে পারবে না, এভাবে দূরে সরে গেলাম বলে। কি করব বল, একটা চরম প্রতিশোধ নেওয়ার ছিল, গত ১০-১২ বছর ধরে একটা কষ্টকে লালন করে এসেছি, সেই কষ্টকে ভুলতে আমাকে এভাবে চরম আঘাত হানতে হলো।
জানি তোমার এতে কোন দোষ ছিল না, কিন্তু কি করব বল, যাকে আঘাত দেব তাকে আঘাত দিতে গেলে এর চেয়ে বিকল্প কোন রাস্তা আমার জানা নেই। হয়ত ভাবছ কি বলছি এসব? তাহলে তোমাকে যেতে হবে আরও কয়েক বছর আগের কিছু সময়ে। তখন সবে মাত্র আমি ক্লাশ সেভেনে পড়ি। ভালো ছাত্র হিসাবে একটা আলাদা সুনাম ছিল আমার। তোমার বাবা ছিল আমাদের প্রধান শিক্ষক। আমাকে ছেলের মতোই ভালবাসতো। বলত আমি নাকি এই স্কুলের গর্বের কারণ হব। জানি না তিনি আমার মাঝে কি দেখেছিল।
তখন তুমি ক্লাশ ফাইভ শেষ করে সিক্স এ ভর্তি হয়েছ। তোমাকে চেনার কোন কারণই ছিল না আমার। একটু দুষ্ট হয়ত ছিলাম, কিন্তু মেয়েদের থেকে শত হাত দূরে থাকতাম। আমাদের ক্লাসের মারুফ ছিল হয়ত তার কথা তোমার মনে নেই। সে তোমাকে অনেক পছন্দ করতো। কারণে অকারণে তোমার সাথে কথা বলতে চাইতো। ও ছিল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওর সাথে আমি বেশি মিশতাম, ও যখন তোমার সাথে দেখা করতে যেত আমাকে জোর করেই নিয়ে যেত।
একদিন মারুফ বলল, তোমাকে নাকি ও পত্র দিবে। ওর নাকি ঘুম হয়না। তোমাকে না পেলে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার হাতের লেখা ভাল, এছাড়া আমি বই পড়তাম প্রচুর। আমাদের স্কুল লাইব্রেরিতে যত সাহিত্যের বই আছে তার অনেকগুলোই আমার পড়া হয়েছে। ও আমাকে বলল, একটা চিঠি লিখে দিতে। এমন ভাবে লিখতে হবে যেন চিঠি পড়েই তুমি পাগলের মতো ছুটে এসে বল, মারুফ আমিও তোমাকে...
ভাবলেও অবাক লাগে, কি হাস্যকর ছিল বিষয়টা। মেয়েদের থেকে দূরে থাকতাম, কিন্তু সাহিত্য পড়ে পড়ে মনে হত আমারও যদি এমন কোন স্বপ্নের মানুষ থাকত। তবে তা মনেই ছিল বাইরে আনার সাহসও পেতাম না। বন্ধুর আবদার না মেনে উপায় কি? রাত জেগে লিখলাম আমার জীবনের প্রথম প্রেম পত্র। তবে তা অন্যের জন্য। সাহিত্যের যত রোমান্টিক ডায়লগ ছিল তার সবই ঢেলে দিয়ে লিখলাম সেই চিঠি। লেখা শেষ হলে যখন পুনরায় দেখলাম তখন চিঠি পড়ে নিজেই নিজের প্রেমে পড়ে গেলাম।
পরদিন মারুফকে দিলাম সেই চিঠি। বিনিময়ে মারুফ আমাকে শহীদের দোকান থেকে চানাচুর খাওয়ালো। সেটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম লিখে আয় করা। মারুফ সেই চিঠি কিভাবে তোমাকে দিল, কি হল কিছুই জানি না। টিফিন পিরিয়ডের আগের পিরিয়ডে মফিজ স্যার আমাদের গণিত পড়াচ্ছিল। সেই ক্লাশে বিমল দপ্তরী এসে মফিজ স্যারকে কি যেন বলল। মফিজ স্যার আমাকে বলল, হেড স্যার দেখা করতে বলেছে।
আমি ক্লাশের পড়া অসমাপ্ত রেখে স্যারের রুমের দিকে গেলাম। সালাম দিয়ে প্রবেশ করলাম স্যারের রুমে। আমাদের স্কুলের সবচেয়ে ঠাণ্ডা শীতল কক্ষ হল হেড স্যারের রুম। প্রাইমারিতে থাকতে অনেকবার এসেছি স্যারের রুম দেখতে। এই রুমে একটা কঙ্কাল ছিল, যেটা জানালা দিয়ে দেখা যেত, এটা দেখতে অনেক শিক্ষার্থীর সাথে আমিও আসতাম।
এই স্কুলে ভর্তি হয়ে অনেকবার দেখেছি এখন আর এভাবে দেখা হয় না, এই রুমের পাশের রুমে লাইব্রেরি ওখানে প্রায়ই আসি পড়তে বই নিতে। স্যারের রুমে আসার পর স্যার বসতে বলল। আমি স্যারের বিপরীত দিকের চেয়ারে বসলাম। স্যার একটা পাতা এগিয়ে দিল, সেখানে কিছু শব্দ লেখা, শব্দ গুলো কেন যেন পরিচিত লাগছে। কোথায় যেন দেখেছি মনে পড়ছে না। কাগজটা হাতে নিলাম, স্যার বলল, এই শব্দের নিচে শব্দগুলো আবার লিখত।
পকেট থেকে কলম বের করে আমি লিখতে শুরু করলাম। লেখা শেষে দেখি স্যারের হাতে আরেকটা কাগজ। ওটা চিনতে পারলাম। মারুফকে যেটা লিখে দিয়েছিলাম সেটাই ওটা। স্যারের হাতে এল কি করে? স্যার এবার চিঠিটা আমার সামনে রেখে বলল, এটা তোর হাতের লেখা?
মিথ্যা বলতে পারি না, তাই বললাম, জ্বি স্যার। কিন্তু ওটা...
আমাকে আর কোন কথাই বলতে দিল না স্যার। টেবিলের উপর জোড়া বেত ছিল সেটা কখন যে উঠিয়ে এনে আমার পিঠে বসাচ্ছিলেন বলতেও পারব না। স্যার সচরাচর কাউকে মারেন না, তবে কাউকে বিচার করতে গিয়ে যদি মারের প্রয়োজন হয় সেটা হয় ঐ বছরের স্মরণীয় ঘটনা। তুমি এটা ভালই জানো। তোমার বাবাকে তুমি ছাড়া আর কেই বা ভালো করে চিনতে পারে?
সেদিন স্যারও আমাকে মেরেছিল। তার কিছু দাগ আজও আমার পিঠে রয়ে গেছে। স্যার মারতে মারতে আমাকে স্কুলের মাঠে নিয়ে আসে। অপরাধ তো কম না, দুইটা- ভালবেসে প্রেম পত্র দেওয়া, তাও আবার তার মেয়েকে। স্কুলের সব শিক্ষার্থী মাঠে চলে আসে। মনে হয় সার্কাস দেখছে। হেড স্যারের রাগ সবাই জানে। তাই কোন স্যারও এগিয়ে আসে না আমাকে বাঁচাতে। টানা ঘন্টা খানেকের মাঝে দুই জোড়া বেত আমার পিঠে ভেঙ্গে স্যার শান্ত হয়।
কিছুক্ষণ পর আমার বাবা আসে স্কুলে। তাকে আগেই খবর দেওয়া হয়েছিল, তার ছেলের অপরাধের বিস্তারিত জানিয়ে। বাবা এসে আমাকে নিয়ে যায় সাথে একটা সার্টিফিকেট। আমাকে স্কুল থেকে টিসি দেওয়া হয়েছে। তবে এই টুকু করুণা করেছিল যে রাস্টিকেট দিয়ে বের করে দেয়নি।
বাবা আমাকে এনে রংপুর হাসপাতালে ভর্তি করায়। অনেকে জানতে চেয়েছে কি হয়েছে বলেনি। এই কথা কি বলা যায়? ছেলে প্রেম করে চিঠি দিতে গিয়ে মেয়ের বাবার হাতে মার খেয়েছে। এই বয়সে প্রেম।
বাবা আমাকে এই বিষয়ে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি কখনও। হাসপাতালের দিনগুলোতে আমাকে সেবা করেছেন, সুস্থ করেছেন। বাবা চাকরী করতেন রংপুর। তবে গ্রামের স্কুলটি ভাল লাগত তার, সেও পড়েছেন এখানে আর কিছু জমাজমি ছিল সেগুলো দেখাশোনার ব্যাপার ছিল তাই শহরে যাননি, কিন্তু এই ঘটনার পর আমাকে ভর্তি করান রংপুর জেলা স্কুলে। শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করি আমরা। তোমার আমাকে মনে নেই সেটা যেদিন প্রথম দেখলাম সেদিনই বুঝতে পেরেছি। মনে থাকারও কথা না। আমি এক অপরাধী। তাকে মনে রাখার কি আছে?
তবে আমার মনে আছে সব, কিছুই ভুলতে পারিনি কখনও। আমি তোমার সব খবর রাখতাম। কখন কি হচ্ছে কোথায় আছ সব। তোমার বান্ধবীর কাছে খবর নিতাম, ও এতকিছু জানতো না। ভাবত আমি তোমাকে পছন্দ করি। তাই ও সহায়তা করত। এত কিছু জানলে হয়ত তোমাকে সাবধান করত।
তানহা আমি আজ স্বার্থক। ঐ দিন থেকে ইচ্ছে ছিল আমি হেড স্যারকে নাড়িয়ে দেব। আমি যে কষ্ট পেয়েছি কিছু না করেই সেই একই কষ্ট তিনিও পান আমি এটা চেয়েছি। বুঝুক সে কেমন লেগেছে আমার। জানি তুমি আমাকে খারাপ ভাববে। জগৎ আমাকে মন্দ বলবে। কিন্তু আমি চেয়েছি তুমি বাড়ি থেকে বের হয়ে আসো। তোমার বাবা যেন কাউকে মুখ দেখাতে না পারে। আমি যেমন এলাকা ছাড়া হয়েছি, বন্ধু-বান্ধব, আমার শৈশব হারিয়েছি, মন্দ ছেলে উপাধি পেয়েছি সেই রকম কিছু সেও যেন পায় তার পরিকল্পনা আমি সেই তখন থেকেই করেছি। আজ আমার পরিকল্পনা সফল হল।
তানহা আমাকে ক্ষমা করবে না, জানি। তোমার জন্যেও ভাবনা হয়। তোমাকে ভালোবাসার ইচ্ছে ছিল না, তবে অভিনয় করতে করতে কখন যে ভালোবেসে ফেলেছি নিজেও জানি না। চিন্তা কর না, কখনও সামনে দাঁড়াবো না। যে অপরাধ করেছি তার শাস্তি স্বরূপ এটা আমার প্রাপ্য। সিটের উপর দেখবে একটা ছোট একটা ব্যাগ আছে, ওখানে তোমার সব কাগজপত্র আছে। ভার্সিটিতে যে গুলো তোলার জন্য আবেদন করেছিলে। তা আমি এই কয়দিনে তুলে রেখেছি। ঢাকায় নেমে সরাসরি আজিমপুর কলোনিতে চলে যেও। ওখানে ২৬/২ নম্বর বাসার তিন তলায় তোমার জন্য একটা সিট নেওয়া হয়েছে ওখানে থাকতে পারবে। যে চিঠি তুমি মায়ের কাছে দিয়ে এসেছ, তাতে কয়েক মাস বা বছর বাড়িতে যেতে পারবে না। ফোন দিবে কোন মুখেও সেটাও ভাবনা। ব্যাগে দেখবে কিছু টাকাও আছে। ওগুলো খরচ করবে নিঃসংকোচে।
তোমার কি মনে আছে? প্রথম থেকেই তোমার একটা একাউন্ট করেছিলাম পোস্ট অফিসে। সেই একাউন্টের কার্ডও আমার কাছে ছিল, একাউন্টের সব টাকা তুলে ব্যাগে রেখেছি, কয়েক মাস চলতে পারবে। আশা করি কয়েকমাস পর বাড়ির পরিবেশ শান্ত হবে। তখন বাড়িতে চলে যেও। বাবা-মা কখনও ফেলতে পারবে না।
আর আমাকে ভুলে যেও। আমি তোমার প্রেমের যোগ্য না। আমি আসলে ভালই বাসতে পারি না। সবার দ্বারা তো সব হয় না।
ভালো থেক আর আমায় খুঁজো না। আমাকে ধুমকেতু মনে করে ভুলে যেও হঠাৎ এসেছিলাম আবার হঠাৎ চলেও গেলাম। ভালো থেক সব সময়।
ইতি
অপরাধী একজন ধুমকেতু।
তানহার চিঠি পড়া শেষ হল। ওর চোখের কোণে জলের ধারা ফুটে উঠেছে। পারছে না হাউমাউ করে কাঁদতে। দুঃখ, রাগ, কষ্ট সব যেন একেবারে খুবলে ধরেছে। বুঝতে পারছে না কার উপর রাগ করা উচিত। বাবা, তাহের না নিজের প্রতি।
ওর সব মনে আছে। তবে তাহেরই যে ছিল সেই ঘটনায় জড়িত তা মনে করতে পারেনি কখনও। এই কয় বছরে তাহেরের চেহেরা অনেক পরিবর্তন হয়েছে। চেনার কথা না। তখন তানহা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ত।
সেদিনের কথা আজও মনে আছে। মারুফ তার সামনে এসে দাঁড়ায়। কি যে বলে তার কিছুই কানে যায় না। হঠাৎ একটা কাগজ বাড়িয়ে বলে এটা তোমার জন্য। তানহা চিঠিটা হালকা পড়ে। কিছু বুঝে কিছু বোঝেনা। ফেলে দিতে যায় তখনই বাবার চোখে পড়ে। বাবা চিঠি নিয়ে অফিস ঘরে যায়। তানহাকে কিছুই বলে না বা জিজ্ঞাসা করে না। এরপর তো সব ইতিহাস।
তবে বাড়িতে গিয়ে বাবা অনেক কাঁদে সেদিন। তাহের ছিল তার প্রিয় ছাত্র। তাকে নিয়ে অনেক আশা ভরসা করতো। মাঝে মাঝেই ওর গল্প করত বাবা। সেই ছেলে এমন একটা কাজ করবে ভাবতেও পারেনি। তার রাগও অনেক বেশি। বাড়িতে এসে অপরাধ বোধে ভুগতে থাকে সে। তানহাও ভয়ে বলতেও পারেনি যে চিঠিটা তাহের না মারুফ দিয়েছিল।
এর এক সপ্তাহ বাড়ির বাইরে যায়নি বাবা। কতবার ভেবেছে তাহেরের বাড়ি গিয়ে কথা বলবে। কিন্তু সংস্কার তাকে হয়ত বাঁধা দিয়েছে। এখনও মাঝে মাঝেই বলে তাহেরের কথা। আজও সে অপরাধ বোধ থেকে মুক্তি পায়নি।
তানহা মনে মনে বলতে থাকে তাহের তুমি এটা কি করলে? তুমি জানো না, বাবা কতটা মনোকষ্টে ভুগে এটা মনে করে। ভাবে তোমার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে।
তানহা চোখ মুছে আশে পাশে তাকায়, এতক্ষণ একটানা চিঠি পড়তে পড়তে ভুলেই গিয়েছিল সে এখন গাড়িতে আছে। বাইরে তাকালো। শো শো করে গাড়ি ছুটে চলছে। কেউ কাউকে সাইড দিতে চায়না, পাল্লাপাল্লি করে চলছে গাড়ি। একেবারে কাছে এসে সাইড দিচ্ছে এই মনে হচ্ছে লেগে যাবে আবার দেখা যায় লাগেনি।
কতক্ষণ যে এভাবে চলছিল জানা নেই। তানহার চোখ দুটো লেগে এসেছিল হয়ত ঘুমিয়েও ছিল। গাড়ি বন্ধ হওয়ায় চোখ খুলে যায়। বাইরে দেখে গোবিন্দগঞ্জ। যাত্রী তুলবে। সুপারভাইজার একজন যাত্রী এনে এই সিটে বসিয়ে দিয়ে যায়। ছেলেটিকে দেখলে মনে হয় হয়ত এবার কলেজ পাশ করেছে। তাহের তো উঠবে না, আশায় ছিল হয়ত এই স্টেশনে এসে বলবে আমি এসেছি। তা আর হল না। গাড়ি আবার ছেড়ে দিয়েছে।
ঘুম আসছে না, সামনের দিনগুলো নিয়ে ভাবতে বসল, কি করা উচিত তার? বাড়ি ফিরে যাবে? কি করে। বাবা হয়ত আর ঘরেই তুলবে না। তার চেয়ে ঢাকায় চলে যাই সেই ভাল। সব ছেড়ে হারিয়ে যাবে সে সবার থেকে দূরে। সামনে তাকালো তানহা। সব সিট প্রায় নামানো, সামনের রাস্তার গাড়িগুলোকে দেখছে। কি গতিতে আসছে ভয় লাগে। কতক্ষণ চেয়ে ছিল মনে নেই শুধু মনে আছে একটা তীব্র আলো সরাসরি এসে ধাক্কা দিল তাদের গাড়িকে।
তারপর আর কিছুই মনে নেই তানহার। শুধু কিছু হইচইয়ের আওয়াজ শুনতে পায়। বুঝতে পারে দূর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সে কেমন আছে কিছুই বুঝতে পারে না, শুধু বুঝতে পারে তার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে, ঘুম, আহা কি শান্তির ঘুম দু চোখ জুড়ে আসছে। সে নিশ্চিন্তে চোখ দুটো বন্ধ করে দিল।।
মহসীন হল
২০০৪
২০০৪