Monday, October 23, 2017

বেলা অবেলায়

আমাদের প্রথম দেখাটা বেশ নাটকীয় ভাবেই হয়েছিল।

সেদিন ছিল শুক্রবার, তারিখটা আজ আর মনে নেই। তার দরকার ও নেই। এটাতো আর ইতিহাস নয় যে, সাল তারিখ সমেত লিখতে হবে।

তবে সেদিন যে শুক্রবার ছিল তা মনে আছে, কারণ ঐদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ছিল।বৃহস্পতি বার দুপুরে বাদশা এল আমার খোঁজে। বাদশা গ্রাম সম্পর্কে আমার ভাতিজা। এবার এইচএসসি পাশ করেছে। ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দেবে। আমার কাছে থাকবে।

সারা দিন ক্লাস আর নানান কাজে ব্যস্ত ছিলাম। রুমে ফিরে দেখি বাদশা বসে আছে।

প্রথমে চিনতে পারি নি। গ্রাম ছেড়ে ছোট শহরে বাস অনেক দিন। তারপর এই ঢাকা। এর মাঝে অনেকে ছোট থেকে বড় হয়েছে। না চিনতে পারাটাই স্বাভাবিক। পরিচয় পেয়ে চিনতে পারলাম।

বাড়ির সবার খবর তার কাছ থেকেই পেলাম। কে কোথায় কি করছে সব জানা হল। আমার গ্রামে চারটি পাড়া- পশ্চিম পাড়া, মসজিদ পাড়া, আকন্দ বাড়ি আর চড়াবাড়ি। মজার একটি বিষয় হল এই চারটি পাড়াতেই আমাদের আত্মীয় আছে। পশ্চিম পাড়ায় আমার বাবার নানীর বাড়ি, আকন্দ পাড়া আর চড়াপাড়ায় দাদির নানীর বাড়ি। তবে মাঝে মাঝে মনে হয় বাবা যদি গ্রামে বিয়ে করত তাহলে হয়ত আমারও নানীর বাড়ি থাকত এই গ্রামে। তা আর হয়নি।

বাদশা দাদির মামাত ভাইয়ের ছেলে। হয়ত দাদির নানীর বাড়ি যদি এই গ্রামেই না হত তাহলে এত দূরের আত্মীয়তার পরিচয়ই থাকত না, গ্রামে তার নানীর বাড়ি থাকায় আত্মীয়তার বন্ধন একটু দৃঢ়ই ছিল। আর এটা যে আমার জন্যে কাল হয়ে দাঁড়াবে তা কে জানত?

আত্মীয়তার এই ঘোর পেঁচাল কথায় হয়ত বিরক্ত হচ্ছেন, কিন্তু আমার কথা সবটা বুঝতে হলে এই টুকু পরিচয় প্রয়োজন আছে বৈকি।

যা হোক, বাদশার সিট পড়েছে কলা ভবনে, ওখানে বিচরণ খুব কম, তারপরও আমার এলাকার ছেলে হিসেবে তার সিট খুঁজে দেওয়ার দায়িত্ব আমারই। তাই ওর সাথে রওয়ানা হলাম, অবশ্য আরেকটা কারণ ছিলনা তা নয়।

বাদশার মামাত বোন বেলা, অনেক শুনেছি তার কথা, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ে, কিন্তু কখনও দেখা হয়নি। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া পর্যন্ত শুধু তার কথাই শুনেছি, কিন্তু দেখার সৌভাগ্য হয়নি।

গ্রামে গেলে বেলার মামারা প্রায়ই বলে, বেলার সাথে দেখা করিয়ে দিবে, একই ভার্সিটিতে যেহেতু পড়ি তাই পরিচয় থাকাটা দরকার। কিন্তু কেন জানি তার সাথে দেখা হয়না। যদিও সম্পর্কে আমরা মামা ভাগনী, কিন্তু ভার্সিটিতে পরিচিত কেউ থাকলে ভালই লাগবে।

এতদিন তার দেখা পাইনি এবার ভাবলাম দেখার একটা সুযোগ হয়ত হবে। আশা অপূর্ণ হল না, হল থেকে বের হয়ে দেখি রাস্তায় দাড়িয়ে আছে বেলা। বাদশা পরিচয় করিয়ে দিল। সেও সাবলীলভাবে কথা বলা শুরু করে দিল, মনেই হল না প্রথম দেখা। আমার যেমন তাকে দেখার, পরিচিত হওয়ার একটা ইচ্ছে ছিল তারও সেইরকম ইচ্ছে ছিল। তাই কথা জমতে বেশি সময় লাগে নি। আমরা দুইজন মিলে বাদশাকে হলে বসিয়ে দিয়ে মল চত্তরে বসলাম।

বেলা হলে সিট পায়নি। পলাশীতে একটা বাসায় আরও কয়েকটা মেয়ের সাথে ভাড়া নিয়ে থাকে। তবে ওর সাথে কথা বলে যা জানতে পারলাম তা হতাশা জনক।

বেলা ছোট থেকেই মেধাবী ছাত্রী হিসেবে পরিচিত। ওদের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে না, আর ও পড়ত আমাদের স্কুলের পাশের স্কুলে।

কলা বিভাগ থেকে এইচএসসি পাশ করার পর কোচিং করেছে ঢাবিতে ভর্তি হতে। তার জীবনের একটাই লক্ষ্য ছিল ঢাবিতে ভর্তি হওয়া। তার জন্যে সে দিনরাত খেটেছে। কিন্তু প্রথমবার ভর্তি হতে পারেনি।

দ্বিতীয় বার আমাদের সাথে আবার পরীক্ষা দেয়। এইবার তাকে ঠেকায় কে? তার স্বপ্নের ভার্সিটিতে ভর্তি হতে আর কোন ঝামেলা পোহাতে হয় না।

অনেকে হয়ত ভাবতে পারেন তাহলে তো সে আমার থেকে বড়, তা কিন্তু না। আমার আগেই একটা বড় গ্যাপ ছিল পড়াশোনায়। তাই একবার ড্রপ আউট দেওয়ার পরও সে প্রায় আমার সমবয়সীই ছিল অথবা কিছু ছোট হবে।

বেলার সাথে ঐ দিন কথা বলে যা পেলাম তা হল, হতাশা ওকে ছেয়ে ফেলেছে। ওর জীবনের একটাই হতাশা কেন প্রথমবার ভর্তি হতে পারল না। এই হতাশা তাকে এতটাই ছেয়ে ফেলেছে যে ভার্সিটির জীবনটা ও কাটাচ্ছে সেই মেস বাড়ির এক কোনে। ক্লাশ শেষ করে চলে যায় মেসে, ঘর অন্ধকার করে বসে থাকে। খায় ঘুমায় আবার ক্লাশে আসে আর মাঝে মাঝে ঢাকায় ওর এক মামা থাকে তার বাসায় বেড়াতে যায়। এই ওর জীবন। ওর কথা শুনে মনে হল, এটা কেমন জীবন? প্রথমবার আর শেষ বার বলে কিছু আছে নাকি? ভর্তি হয়েছে এটাই আসল কথা।

বাদশা পরীক্ষা দিয়ে বের হল, দুইজন মিলে তাকে ভার্সিটি ঘুরিয়ে দেখালাম। বিকেলে বাদশাকে বেলা নিয়ে গেল ওর মামার বাসায়। আমি হলে ফিরে এলাম। এর আগে অবশ্য নাম্বার আদানপ্রদান হয়েছিল।

এরপর বেশ কয়েকদিন হল, আমিও ক্লাশ নিয়ে ব্যস্ত। এমন একটা ডিপার্টমেন্টে পড়ি, নিজেকে মাঝে মাঝে মনে হয় কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থী। সকাল আটটায় ক্লাশ আবার শেষ হয় দুপুর দুইটায়। বিকেলে একটা টিউশনি। এর মাঝে বেলার স্থান নেই বললেই চলে। খাই-দাই, ক্লাশে যাই, ফিরে এসে একটু রেস্ট নিয়ে টিউশনি, ফিরে এসে পড়া, টিভি দেখা খাওয়া ঘুম আবার ক্লাশ।

তখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি তেমন একটা সুবিধার ছিল না, মাঝে মাঝেই হরতাল অবরোধ চলে, এই রকম একটা টানা বন্ধের কবলে পড়ল ভার্সিটি। ঢাকায় বসে থেকে আর কি হবে, রওয়ানা হলাম বাড়ির পথে।

একদিন সকালে বেলার ফোনে ঘুম ভাঙ্গল। আমি একটু ঘুমকাতুরে, তাই সকালে কারও ফোন পেলে বিরক্তই হই। আজ কেন যেন বিরক্ত বোধ আসল না। আমি বেলাকে যতটা চিনি তাতে অদরকারে ফোন দেয়নি।

ফোনে জানাল ওর ছোট ভাইকে আমাদের শহরে ভর্তি করিয়েছে। তার জন্যে থাকার মেস খুঁজতে আসবে। যেহেতু আমি এই শহরে অনেকদিন থাকি তাই আমার সহায়তা কামনা করছে।

বাড়িতে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম, তাই এমন একটা কাজে সহায়তা না করার কোন কারণই খুঁজে পেলাম না। জানালাম আমার ঘন্টা খানিক সময় লাগবে রেডি হতে।

বাসায় বাবা- মা কেউ নেই। আমাকে বাড়ি পাহারা দিতে রেখে তারা ঢাকায় গিয়েছে বেড়াতে। তাই কাউকে বলে যাওয়ার দরকারই নেই। হালকা কিছু মুখে দিয়ে চলে গেলাম বাসস্ট্যান্ডে। এর আগে পরিচয় হয়েছিল বেলার সাথে, এবার পরিচয় হল ওর ভাই বাবুর সাথে। নিষ্পাপ এক মুখ, গায়ে গতরে বেড়ে উঠেছে তবে চোখ দেখে বোঝা যায় এখনও বাচ্চা ছেলেই রয়ে গেছে। ভাবলাম, এই মুখই কয়েকদিন পর অপরিচিত ঠেকবে।

সারা শহর খুঁজে অবশেষে পাওয়া গেল মনের মতো একটা মেস। ওর বয়সী আরও কয়েকজন থাকে। পড়েও একই সাথে। বাবুকে মেসে রেখে আমরা দুইজন বের হলাম বাবুর প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে।

আমার একটা স্বভাব হল, মেয়েদের সাথে শপিংয়ে গেলে ব্যাগটা নিজেই বহন করি, হয়ত ওদের খুশি করতে অথবা দায়িত্ববোধ থেকে অথবা অন্য কিছু, কি সেটা আজও জানিনা, তবে এটা কেন যেন আমার স্বভাব হয়ে গেছে। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যা যা কেনা হচ্ছিল তা বেলার হাত থেকে নিয়ে নিজেই বহন করছিলাম।

সকালে ঘুরেছি একটা থাকার জায়গার জন্যে, এখন বের হয়েছি কেনাকাটার জন্যে। দোকানে দোকানে ঘুরে এটা সেটা কিনতে কিনতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। কেনাটাকা শেষ করে বেলাকে সাথে নিয়ে বাসায় এলাম। ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। বাসায় এসে যা ছিল তাই দিয়ে দুইজনে খাওয়া শেষ করলাম।

খাওয়া শেষ করার পর শুরু হল গল্প বলা, ওর পরিবারের অনেক গল্পই অনর্গল বলতে লাগল। কার কি পছন্দ, কে কি করতে ভালবাসে, ঈদে কি করে, কে কে তাকে জামা কাপড় দেয়, ও কাকে কাকে উপহার দেয়, কার পছন্দে শপিং হয়, কত কথাই যে বলতে লাগল, তার কিছু কানে গেল কিছু গেল না। তবে কেউ দেখে বুঝতে পারবে না, আমি সব শুনছি না, মনে হবে এক মনযোগী শ্রোতা।

এক সময় কথা শেষ হল। আমার চোখের দিকে চোখ রেখে বলল, এবার তোমার কথা বল, শুনি।

আমি বললাম আমার বলার মত কিছু নাই।

বেলা ছলছল চোখ নিয়ে বলল, কিছুই বলার নেই? আমি তো জানি বলার কত কি আছে, তোমার দুঃখের কথা শুনতে চাই, বল।

আমি আবারও তাকে জোড় দিয়ে বললাম, আমার কোন দুঃখের কথা নেই, আমি সব সময় সুখী।

বেলা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখল, কোন উত্তর করল না। এক সময় বেলাকে পৌঁছে দিলাম বাসস্ট্যান্ডে। ও চলে গেল বাড়ি আর আমিও চলে এলাম আমার বাসায়।

বাড়ি গিয়ে ফোন দিয়ে জানাল পৌঁছে গেছে, আমিও টুকিটাকি কয়েকটি কথা বলে ফোন রেখে দিলাম। ঘন্টা খানিক পর আবারও ফোন, রিসিভ করার পর বলল, তেমন কিছু না, মনে পড়ল তো তাই একটু কথা বললাম।

এবার আমার পালা, বাড়িতে থাকলে কোন কাজ থাকে না তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি, শুয়ে তাকে একটা কল দিলাম, ভাবলাম হয়ত রিসিভ করবে না, গ্রামে এখন অনেক রাত, কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে একবার কলবাজতেই ফোন রিসিভ করল।

ভাবিনি ফোন ধরবে তাই কি বলব সেটাও আগে থেকে ঠিক ছিল না, ওর মতই বললাম, মনে পড়ল তো তাই কল দিলাম। টুকি টাকি দুই একটি কথা বলে ফোন রেখে দিলাম। পাঁচ মিনিট পর বেলা ছোট করে মিস কল দিল, আমিও উত্তরে মিস কলই দিলাম।

সেই শুরু, ছুটিতে বাড়ি এসে অনেক দিন হল রাত জাগা হয়না, আজ রাত জাগার অভ্যাস যেন আবার ফিরে এল। ভোর রাত পর্যন্ত চলতে লাগল মিস কল মিস কল খেলা। আজানের একটু পর একটা মেসেস পেলাম, যত দিবে তার এক বেশি।

এক সময় রাত ভোর হল। ভোর গিয়ে সকালে রূপ নিল, সকাল গড়িয়ে দুপুর আবার বিকেল। কিন্তু কেন যেন মিসকল চলতেই লাগল।

সেই শুরু। এরপর ভার্সিটি খুলল, ঢাকায় চলে এলাম। আবার সেই যান্ত্রিক জীবন, সকালে ঘুম থেকে উঠে ক্লাশে যাওয়া। দুপুরে খাওয়া শেষ করে কাজ থাকলে লাইব্রেরীতে যাওয়া না থাকলে ঘুম। বিকেলে টিউশনি ওখান থেকে এসে টিভি দেখে রাতের খাওয়া শেষ করে রুমে এসে পড়তে বসা। কোনদিন বন্ধুর হলে গিয়ে আড্ডা দেওয়া, তাশ পেটানো, মধ্য রাত পেরিয়ে ঘুম। আবার সকাল.....

তবে এবার আর সেই রুটিন এক রকম থাকল না। এর মাঝে এসে দাড়ালো বেলা। সকালে ঘুম ভাঙ্গে বেলার ফোনে। কাজে ওকাজে চলে মিস কল। ক্লাশ শেষ করে প্রায়ই কলা ভবনে যাওয়া হয় বেলার সাথে দেখা করার জন্যে। কখনও দেখা হয় কখনও দেখা হয় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেকের কাছে স্বপ্নের কারখানা। এখানে ভর্তি হয়ে অনেকেই অনেক কিছু করে! নিজের ক্যারিয়ারকে তৈরী করার কত যে উপায় আছে তার ইয়াত্তা নেই। তবে বেলা যেটা করে সেটা হল হতাশার বাগান। পলাশীর একটা মেস বাড়ির ছোট্ট রুমে তার বাগান। বাগানের প্রথম গাছটা লাগিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবার ভর্তি হতে না পেরে। ওর কথা ছিল, আমার এত ভাল প্রস্তুতি থাকা স্বত্ত্বেও কেন ভর্তি হতে পারলাম না। ওকে অনেক বোঝাতাম, আমার নিজের কথাও বলতাম, কোথাও ভর্তি হতে না পারাটা জীবনের সব না, কিন্তু ও তা বুজতে চাইতো না। ক্লাশের সময় ছাড়া বেশিরভাগ সময়ই মেস বাড়িতে বসে থাকত।

একসময় হলে সিট পেল বেলা। আমার চাপাচাপিতেই সিটে উঠল। ওর জন্যে আমার রুটিনও পাল্টালাম। বিকেলে টিউশনি শেষ করে সরাসরি চলে যেতাম ওর হলে। হলের বাইরে বসার অনেক সুন্দর জায়গা। সেখানে বসে যতক্ষণ ও বাইরে থাকত পারত তার সবটা সময় গল্প করতাম।

বন্ধুরা আমাকে বেলাকে জড়িয়ে অনেক কথাই বলত। হাসি দিয়ে ওদের কথাগুলো উড়িয়ে দিতাম। তখন পর্যন্ত ওর প্রতি টানটা ছিল কেবলই আত্মীয়তার। ওর সাথে আড্ডা দিতে ভাল লাগত। আড্ডায় আড্ডায় জানতে পারতাম আমাকে ও ছোট বেলা থেকেই ভাবত। ও সব সময় ভাবত আমি হয়ত জানালার শিক ধরে উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি।

আসলে ব্যাপারটা হল, ছোট বেলায় মাকে হারিয়েছিলাম। আবার নতুন একজনকে মা হিসেবে পেয়েছি, সে অনেক কাহিনী। এখানে বলার সময় আর হবে না। বেলা ওর মাকে প্রচন্ড ভালবাসে, হয়ত সব ছেলেমেয়েরাই মাকে ভালবাসে। তাই ও মেনে নিতে পারত না কারও মা নেই। ওর বেশির ভাগ কথাতেই ব্যাপারটা চলে আসত। অথচ আমি মা ছাড়া নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছি। অভাববোধ করতাম তবে মাকে ছাড়া একা চলতেও শিখে নিতে হয়েছিল সময়ের প্রয়োজনে।

বেলা ব্যাপারটা মানতে পারত না, ওর ধারণা ছিল, মাকে ছাড়া আমি হয়ত অসহায়। আমি যতই বলতাম ও শুনতে চাইতো না, এতদিন হয়ত মাকে তেমন ফিল করতাম না, তবে ওর কথায় কেন যেন বেশি বেশি মনে হত মায়ের কথা।

টিউশনির বেতন প্রতিমাসে নিয়মিত পাইনা, তবে বাড়ি থেকে যে টাকা আনা হয় তাতেই আমার চলে যায়। এই যে এখন নিয়মিত বেলার সাথে দেখা হয় তাতেও খরচ একটা বাড়েনি। আমরা সন্ধার সময় নিয়মিত চিতই পিঠা খাই, বার্গার কিংবা পিজা খাওয়া হয়না। ফজিলাতুন্নেসা হলের পাশ দিয়ে নিউমার্কেটের কাঁচাবাজারের দিকে যে রাস্তা চলে গেছে তারপাশে সুন্দর সুন্দর পিঠার দোকান, চিতই পিঠার সাথে সর্ষে, শুটকি বা কঁচু ভর্তা। আহ কি মধুর খাবার, মনে হয় নিজের বাড়িতে বানানো পিঠে।

ঈদের আগে বলে কয়ে তিন মাসের বেতন একবারে নেওয়া গেল। বেশ অনেকটাই টাকা, কি করা যায় এত টাকা দিয়ে। বেলাকে বললাম। ও পরামর্শ দিল বাড়িতে ঈদের কেনাকাটা করার জন্য। ও হলে তাই করত। ঈদের সব কেনাকাটা ওই করে, ওর মা সরকারি চাকরি করেন। ঈদের আগে মেয়ের হাতে টাকা দেন সবার জন্য ঈদের বাজার করতে। ওর পছন্দই সবাই পছন্দ।

বেলাকে নিয়ে মার্কেটে গেলাম। বাবার জন্য পাঞ্জাবী, মায়ের জন্য শাড়ী, বোনদের জন্য থ্রিপিস। নিজের জন্য জুতা, শার্ট-প্যান্টের কাপড়। টুকিটাকি এটা ওটা।

বেলাও মা, বাবা, ভাইবোনদের জন্য কেনাকাটা করল। সব কেনাকাটাই হল বেলার পছন্দে, আমি আবার কাপড়চোপড় খুব একটা পছন্দ করতে পারি না। সব কাপড়েই মনে করি মানিয়ে যাবে। তবে বেলা নিজের জামাটা কিনল আমার পছন্দেই। কেনার আগেই বলেছিল, আমি পছন্দ না করে দিলে ও কিনবে না।

সব কেনা প্রায় শেষ এবার বেলা নিয়ে চলল এলিফেন্ট রোডের দিকে। বাটা সিগনালে একটা মার্কেটের দোতলায় একটা কাপড়ের দোকানের সামনে নিয়ে থামলো।

মার্কেটের নাম দেখলাম লাভ পয়েন্ট, এখানে আবার কি কাজ? একটা দোকানে গিয়ে গজ-কাপড় দেখানো শুরু করল। বললাম কার জন্য, কোন এক মামাত ভাইয়ের কথা বলল, তাকে গিফট করবে। আমি আর কিছু বললাম না।

অনেক দেখার পর কাপড় একটা পছন্দ হল, অনেক সুন্দর, ফতুয়ার কাপড়, একবার মনে হল আমিও একটা নেই, পরে ভাবলাম থাক, পরেই নেব। এখন নিলে কি না কি মনে করে।

কাপড় নিয়ে এবার রওয়ানা হল নিউমার্কেটের দিকে। নিউমার্কেটের তিনতলায় বাটিক- বুটিকের দোকান আছে জানতামই না। বেলা ঘরে আবদ্ধ থেকে যা জানে আমি দেখি বাইরে থেকেও তা জানিনা।

ডিজাইন বই থেকে ডিজাইন বাছাই করল, কোথায় কোথায় ডিজাইন বসাতে হবে, কি কি রং হবে সব বলে দিল বেলা। কাপড়ের মাপ নেওয়ার সময় আমাকে সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। যাকে গিফট করবে তার সাথে নাকি আমার বডির মাপ মিলে যায়। আমাকেই গিনিপিগ হতে হল। তা হোক, সারাদিন তো ও কত বারই গিনিপিগ হল, এবার না হয় ওর জন্য একটু হলাম।

ঈদের ছুটি হল, বেশ অনেকদিন ভার্সিটি বন্ধ থাকবে। ওদের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি খুব বেশি দূর না। অনেকবার ভেবেছি যাই দেখা করে আসি। কিন্তু কিভাবে যাই, ওদের বাড়ি গেলে কেউ কিছু বললে কি বলব এসব ভেবে আর যাওয়া হয় না। ফোনে কথা হয় প্রতিদিনই, ঈদে কি কি করব, কোথায় থাকব ইত্যাদি ইত্যাদি।

ঈদের দিন ও নানীর বাড়ি আসলো, আমাদের পাশের পাড়ায়। একফাঁকে গেলাম দেখা করতে। ওর মামী সম্পর্কে আমার ভাবী লাগে, তবে ওত বেশি কথা হয়না। তেমন যাওয়াও হয়না। আজ হঠাৎ দেখে কিছুটা অবাকও হল। তবে যত্নের অভাব হল না। ও বাড়ির সবাই জানে আমি আর বেলা একই ভার্সিটিতে পড়ি। তাই ওই বাড়িতে বসে গল্প করায় কেউ কিছু মনেও করলো না।

কতদিন পর দেখা, মনে হয় কত যুগ পার হয়ে গেছে। অনেক দিন পর আবার আগের মতো আড্ডায় মেতে উঠলাম। সন্ধের আজানে বুঝলাম অনেক বেলা হল, বাড়ি ফিরে এলাম।

দুইদিন পর আমার বোনদের নিয়ে ওদের বাড়ি বেড়াতে গেলাম। বিরাট বাড়ি। চারদিকে গাছপালায় পরিপূর্ণ। বাড়ির সামনে পুকুর পাড়। ঘাট বাধানো, বসার আলাদা ব্যবস্থা আছে।

এত বড় আর সুন্দর বাড়ির কথা শুধু বইয়ে পড়েছি কিন্তু কখনও দেখা হয়নি। আজ দেখে চোখ-মন দুইই ভরে গেল। ওদের বাড়ির সবার সাথে কথা হলো। কখনও আমাকে দেখেনি তারপরও আপন করে নিল সবাই। বিকেলে আর ফিরতে ইচ্ছে হল না মনে হল থেকেই যাই। কিন্তু তাই কি হয়??

ঈদের ছুটি শেষে আবার ঢাকায় ফিরে এলাম। কত দিন পর ঢাকায়। আবার সেই একই রুটিন-হল, ক্লাশ, টিউশনি, বেলা। বেলা-- এ কয়দিনে ও কেন যেন জীবন রুটিনের একটা অংশ হয়ে উঠেছে। কতবার ভেবেছি বেলা কি হয়? ওর সাথে সম্পর্ক কি? কেন ওর কাছে বারে বারে চলে যাই। একটা মেয়ে হতাশায় পরিপূর্ণ তাতে আমার কি? আমাকেই কেন তাকে ঠিক করতে হবে।

কতদিন ভাবছি বলব, বলা হয়নি। ওর যা মেজাজ যদি অন্য কিছু ভাবে। তবে ওর ব্যবহারে মনে হয় আমাকে হয়ত ভালবাসে। কিন্তু আমি তো ওরে এই নজরে দেখি না। ভাবছি ওর সাথে খোলাখুলি কথা বলতে হবে। এভাবে একটা সম্পর্ক চলতে দেওয়া যায় না।

কানে হেড ফোন লাগিয়ে এফএমে গান শোনা আমার একটা অভ্যাস। বিশেষ করে গাড়িতে যখন চলি আর ভিড়ের মাঝে যখন থাকি তখন কাজটা বেশি করি। আসলে এটা করার আরও একটা কারণও আছে। ভীড়ে মোবাইলের একটা নিরাপত্তা দেয় এটা। কেউ যদি মোবাইল চুরি করতে চায় তাহলে গান থেমে গেলেই বুঝতে পারবো।

টিউশনি শেষে বেলার হলের দিকে যাচ্ছি, চাঁদনী রাত, কানে হেড ফোনে অর্ণবের গান-



তোর জন্য আকাশ থেকে পেঁজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা

বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি দিয়ে ছাদ বানিয়ে শুই।

ছাদ ভেঙ্গে যেই বাষ্প হবে জল
বাষ্প দিয়ে করবি কি তুই বল?

তার চেয়ে চল এইবেলা মেঘ খুজে
দু’জন মিলে ঝাঁপ দিই চোখ বুজে।


কি রোমান্টিক পরিবেশ! এমন পরিবেশে সবাই যায় প্রেম করতে আর আমি যাচ্ছি প্রেম ভাঙ্গতে। কি করব? বেলাকে ভালো লাগে, মেয়ে হিসেবে অনেক ভালো, তাই বলে ভালবাসা। এর পরিণতি কখনও ভালো হবে না, কেউ আমাদের এই সম্পর্ক মেনে নিবে না। তার চেয়ে এখানেই সমাপ্ত হয়ে যাক সব।

হলের কাছে গিয়ে দেখি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। চাঁদের আলোর নিচে অন্য রকম লাগছে। কখনও এমন করে দেখা হয়নি। বেলাকে আজ যেন নতুন করে দেখলাম। এভাবে দেখে বুকটা কি একটু মোচড় দিয়ে উঠলো, না এটা শুধুই মনের ভুল।

প্রতিদিনের মতো চিতই পিঠা খেয়ে রাস্তায় বসলাম। আজ কেমন যেন চুপচাপ হয়ে আছে। প্রতিদিনের সেই উচ্ছাস নেই, বেশ গুরু গম্ভীর। ভয় হল, কি হল আবার, বাড়িতে কোন সমস্যা?

কিছু বললাম না, হয়ত ও নিজেই বলবে, তাই অপেক্ষায় থাকলাম।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমার দিকে তাকালো। সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই।

এই রোমান্টিক রাতে আজ কেন যেন একটু ভয়ও লাগল। মাথার মাঝে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, কি বলবে ও।

আমাদের এভাবে মেশাটা কি ঠিক, থেমে থেমে কান্নাটা আটকিয়ে বলতে শুরু করল, অনেকে অনেক কথা বলছে, তাদের কি উত্তর দেব। আর আমাদের সম্পর্কটা কেউ মেনে নিবে না। তার চেয়ে এই ভাল, আমরা আর দেখা করব না, আর কথাও হবে না। আজই শেষ দেখা। আর আসবে না, ফোনও দিবে না। আর দিলেও পাবে না, ফোন বন্ধ থাকবে।

আমাকে কোন কথা বলার সুযোগই দিল না। কথাগুলো বলেই দ্রুত চলে গেল। হঠাৎ খেয়াল হল, একাই বসে আছি। গেটের দিকে গেলাম দেখি গেট বন্ধ, ও নেই চলে গেছে উপরে।

ফোন দিলাম, বন্ধ। একবার বলেছে যে আর সম্পর্ক রাখবে না, তাহলে ও তাই করবে, এতদিন মিশে এটাই বুঝেছি। তারপরও মন মানছে না, বারে বারে ফোন দিয়েই যাচ্ছি আর মহিলা বলেই যাচ্ছে- আপনি যে নাম্বারে কল দিয়েছেন...

রাত বাড়ছে, হলের দিকে রওয়ানা হলাম। যত কদম হাঁটছি ততই মনে হচ্ছে বুকটা শূন্য হয়ে যাচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে। তাহলে কি আমি বেলাকে ভালবেসেছি। কি হবে এখন।

হলের খাওয়া সব সময়ই ভালো লাগত, আজ খেতে ইচ্ছে করছে না। একই খাবার দিয়ে পাশের টেবিলের ছেলেরা কত খাচ্ছে আর আমার মুখ দিয়ে খাওয়াই নামছে না। ভালোবাসা কি এমনই সব কেড়ে নেয়, খাওয়া- ঘুম।

এখন নিশ্চিত হলাম, এই যে না খেতে পারা, এই যে তাকে ক্ষণে ক্ষণে মনে হওয়া, এই যে শূন্যতা এটার নামই ভালবাসা। আমি বেলাকে ভালবেসে ফেলেছি। রাতের কথাগুলো আবার মনে করলাম, বুঝলাম বেলাও আমাকে ভালবাসে। এটাও বুঝলাম আবারও হতাশা তাকে ঘিরে ফেলেছে, এই হতাশাই কালকের ঐ রকম কথা বলার কারণ।

সেই যে ফোন বন্ধ আর খোলার নাম নেই। কতবার যে চেষ্টা করছি তার খবর শুধু ফোনই বলতে পারবে। কিন্তু ওর ফোন আর খুলে না। ক্লাশে বান্ধবী আছে ওদের হলে থাকে তাকে দিয়ে খবর নেওয়ালাম। হলেই আছে তবে ক্লাশ করে না। বাইরেও আসে না। একটু নাকি অসুস্থ।

ঘনিষ্ট বন্ধু জামানকে সব খুলে বললাম, ও আবার এই বিষয়গুলো ভালই বুঝে। বেলার সাথেও বেশ পরিচয় আছে। আমরা তিনজনই একই এলাকা থেকে এসেছি।

জামান সব শুনে বলল, দাঁড়া দেখি কি করা যায়।

জামানের উপর ভরসা রাখা যায়। জামান যখন বলেছে তখন কিছু একটা হবে। বুঝতে পারছি না বেলা এমন করছে।

শুক্রবার এমনিতেই ঘুম থেকে একটু দেরিতে উঠি, তবে আজ তাড়াতাড়ি উঠতে হল। জামান ফোন দিয়ে বলেছে কার্জন হলে আসতে। কি নাকি জরুরী কথা আছে। বললাম তুই চলে আয়, কাদেরের দোকানের নুডুলস খাওয়াবো, শুনলো না। বলল, ও আসতে পারবে না, আমাকেই যেতে হবে।

কি আর করা, কোন মতে হাতমুখ ধুয়ে রওয়ানা হলাম। কার্জন হল বেশ অনেকটা দূরে। জামান কেন ডাকছে ভাবতে ভাবতে যাচ্ছি। তাহলে কি বেলার সাথে যোগাযোগ করা গেছে। বেলা কি কিছু বলেছে। কতদিন বেলাকে দেখিনা, কোন খবরও পাইনা, মনটা কেমন যেন করে। কেন এমন হল, ভালবাসার অভিনয় করতে করতে এত ভালবেসে ফেললাম। কি হবে এখন।

কার্জন হলের গেটে যাকে দেখলাম তাকে এখানে এভাবে আশা করিনি। বেলা দাড়িয়ে আছে। সাথে জামান, মুখে বিজয়ীর হাসি। ও বন্ধু আমার, তুই আসলেই গ্রেট। মনে মনে বলা কথাগুলো মনেই রয়ে গেল। বেলার সামনে আর কিছু বলা হল না।

আমাদের কথা বলতে দিয়ে ও চলে গেল। কতদিন পর দেখা। মনে হয় অনন্ত কাল আমরা আলাদা। কি কথা বলবো, ওর চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। কান্না কান্না কণ্ঠে বলতে লাগল, আমি এটা কি করলাম। সবার কাছে ছোট হয়ে যাব। সবাই কত ভালো জানে, আর আমি এই কাজটা করলাম। এখন আমাদের কি হবে।

আমি অভয় দিয়ে বললাম, কি হবে সেটা পরে বোঝা যাবে। আমরা দুইজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি। পড়া শেষ হলে একটা না একটা চাকরি হয়েই যাবে। তখন আর কেউ কিছু বলতে পারবে না, যদি সম্পর্ক মানতে পারে তাহলে ভাল আর না হয় আমরা দুইজন মিলে সংসার করতে পারব, সবার থেকে আলাদা থাকতে পারব। তাহলে এখনই এত চিন্তার কি আছে।

কথাগুলো মনে হয় মনে ধরলো। এতদিন পর এই প্রথম আমার চোখের দিকে চেয়ে বলল, সকালের নাস্তা তো করা হয়নি, চল আগে নাস্তা করি। আচ্ছা আমি না খেয়ে থাকলে ও কি করে টের পায়।

জামান কাছাকাছিই ছিল, তিনজন মিলে অনেকদিন পর মজা করে নাস্তা করলাম। কথায় কথায় সময় অনেকটা পার হয়ে গেছে। ভাবলাম কোথাও বেড়াতে যাই। যেই কথা সেই কাজ। তিনজন রিক্সা নিয়ে পরিবিবির মাজার দেখতে গেলাম। অনেক আনন্দে একটা দিন কাটল। যাক এতদিন পর আমিও সবার মতো বলতে পারব আমার একটা প্রেমিকা আছে। আমার কথা ভাবার মতো কেউ না কেউ আছে।

শুরু হল এক নতুন জীবন। স্বপ্ন দেখার পালা। ভবিষ্যৎ কেমন হবে, কি কি করব, কিভাবে গোছাব এই সব ভাবতে ভাবতে এক রঙ্গীন জগতে চলতে শুরু করলাম। ক্লাশ শেষে, সন্ধায় টিউশনি করে যে সময়টুকু হাতে পাই তার বেশিরভাগ সময়ই ব্যয় হয় বেলার সাথে। তাও কথার শেষ হয়না। রাতেও চলে ফোনে কথা বলা। সময় যেন তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে যায় কিন্তু কথা শেষ হয় না।

সামনে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা। প্রতিদিন ক্লাশ করতে হয়, তাই পরীক্ষায় এতটা টেনশন নেই। তারপরও নোটপত্র জোগাড় করা, সব বই গুছিয়ে রাখা কত কাজ। আর কয়েকদিন পরই পিএল (প্রিপারেশন লিভ- পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে বেশ কয়েকদিন বন্ধ দেয়। তাই সব কাজ এখনই গুছিয়ে রাখতে হবে। এসাইমেন্টের কাজও গুছিয়ে রাখতে হবে। কত কাজ!!

বেলা দুইদিন হল বাড়িতে গেছে। ওদের এত ক্লাশ করার বাধ্যবাধকতা নেই, তাই মাঝে মাঝেই বাড়ি যায়। দুই একদিন থেকে চলে আসে। প্রতিবার বাড়িতে গেলে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায় ফোনে কথা বলে, এবার কেন যেন ব্যতিক্রম মনে হল যদিও আমার পরীক্ষা থাকায় সময়ও করে উঠতে পারছিনা এত কথা বলার। তারপরও কথা না বলতে পারলে কেমন যেন লাগে

দুইদিন পর যখন ফিরে এলো তখন ক্লাশ শেষ করেই ছুটলাম কলা ভবনের দিকে। ওর ডিপার্টমেন্টের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি আসবো শুনেছে, আমার অপেক্ষায়ই দাড়িয়ে আছে। দূর থেকে পর মুখটা দেখলাম। রবিঠাকুর বেঁচে থাকলে কৃষ্ণকলি কবিতা হয়ত বেলাকেই নিয়ে লিখত। বেলা ছিল কৃষ্ণকলির মতোই। তবে আমার চোখে অবশ্যই সুন্দর ছিল।

কলা ভবন থেকে বের হয়ে ও টিএসসির দিকে হাঁটতে লাগল। চুপচাপ কোন কথাই বলছে না, আমি বাচালের মতো অনেক কিছুই বলছি। এক সময় বুঝতে পারলাম ও কোন কথাই শুনছে না। কি যেন চিন্তা করছে। তাহলে বাড়িতে কিছু হয়েছে নাকি? জিজ্ঞেস করলাম, মনে হল কথাটা এড়িয়ে গেল।

হাঁটতে হাঁটতে টিএসসি পেরিয়ে কার্জন হলের দিকে চলতে লাগলো। অনেকদিন কার্জন হলে যাই না, আমাদের প্রেম শুরু হয়েছিল কার্জনে তাই আমার প্রিয় একটা জায়গা এটা। অনেক দিন পর আসতে পেরে ভালই লাগছে।

যে গাছের নিচে বসে আমাদের প্রেমের শুরু সে গাছের নিচেই বসলাম। বেলার দিকে তাকিয়ে বললাম কি হয়েছে?

এতক্ষণে মনে হয় ওর কথা বলার সময় হল। দুর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার বিয়ের কথা আলোচনা চলছে।

বিয়ে করে ফেল- সংগে সংগে উত্তর দিলাম।

ও হয়ত এই রকম উত্তর আশা করেনি। আমার দিকে তাকাল, ওর চোখ ভর্তি পানি।

আমাকে তুমি তাই করতে বল? এবার কিছুটা রাগত স্বরে বলল।

তা ছাড়া আর কি করবে? এবার আমার বলার পালা, আমি বললাম, আরে পরিবার থেকে যদি বিয়ের কথা চলে তাহলে বিয়ে করে ফেল, তবে তা ঐ ছেলেকে না, আমাকে।

তোমার পরিবার কি মানবে। আর তোমাকে এখন বিয়ে করাবে না। আমাকে বিয়ে দিবে কারণ আমার ছোট বোনটার বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। আমার বিয়ে হলে আমাদের পড়ানোর খরচও কমে যাবে, তুমি তো জানই, বাবার আয় কি হারে কমে গেছে। একা মায়ের আয় দিয়ে তিনজনের পড়ালেখা চালাতে হচ্ছে। ওরা ভাবছে, আমার বিয়ে হলে খরচের হাত থেকে বাঁচবে। বেলা একটানা কথাগুলো বলে গেল। 

ওর কথায় যুক্তি আছে। ওর ছোট বোন প্রায় ওর সমবয়সী, জাতীয় ভার্সিটির অধীনে একটা কলেজে পড়ে। দেখতে ওর থেকে থেকে সুন্দরী। অনেক বিয়ের সম্বন্ধ আসে, বড় বোন রেখে ছোট বোনের বিয়ের কথা কি করে আলোচনা হয়, তাই বিয়ে হয় না। কিন্তু এভাবে কতদিন। মেয়েদের একটা বয়সে অনেক বিয়ের প্রস্তাব আসে, সেই বয়সে বিয়ে না দিতে পারলে পরে বিয়ে দিতে একটু ঝামেলাই হয়।

কিন্তু এই সময়ে আমাকে বিয়ে করাবে না। তার মাঝে আছে আত্মীয়তার বন্ধন, বাবা আবার এই বিষয়গুলো ভালই মানেন। লতায় পাতায় জড়ানো আত্মীয় স্বজনের খবর তার কাছে থাকে, নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন, সবাই তাকে চিনে, সামাজিক বিভিন্ন কাজে অংশ নিতেও আমন্ত্রন জানায়।

আমি জানি বাবা কিছুতেই এই বিয়ে মেনে নিবে না।তার উপর এখনও বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলতে হয়, বাবার উপর কিছু বলার মতো শক্তি, সাহস কোনটাই এই মূহুর্তে নেই। কি করব এখন। মনে হল ছাদ ভেঙ্গে পড়ল মাথায়।

এতদিন ধরে আমরা প্রেম করে বেড়াচ্ছি, কখনও সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া হয়নি। আশেপাশে কত কি নজরে পড়ে, তার কিছুই করা হয়নি। আজ এতদিনে এই প্রথম বেলা আমার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে শুরু করল। তবে বেশ কিছুটা দূরুত্ব বজায় রেখে। কি বলে বা কি করে সান্তনা দিব বুঝতে পারছি না। আমারও কান্না পাচ্ছে। কিন্তু ওর সামনে কাঁদলে ওর আরও কষ্ট হবে। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে কান্না থামাল। কান্না থামিয়ে হঠাৎ রাস্তায় চলে গিয়ে রিক্সায় উঠে বসল। এভাবে চলে যাবে ভাবতেও পারিনি, ভ্যাবলা কান্তের মতো দাঁড়িয়েই থাকলাম।

সেই না খাওয়ার রোগটা আবার ফিরে এলো। কি করব, কোথায় যাবো, কার কাছে কি বুদ্ধি নেব কিছুই মাথায় আসছে না। ভোর বেলায় ঘুম ভেঙ্গে মনে পড়ল এক বড় ভাইয়ের কথা, তার সাথে অনেক দিনের আলাপ আমাদের, বাসার কাছেই থাকে, খুব ভাল সম্পর্ক তাদের সাথে আমাদের পরিবারের। বাবা অনেক বিষয়েই তার পরামর্শ গ্রহণ করে।

সব শুনে ভাইয়া বলল, মামা এই সম্পর্ক কখনও মেনে নিবে না, আমার বাবাকে মামা বলে ডাকে উনি। তার যুক্তি হল, বাবা যেহেতু আত্মীয় বিষয়টাকে গুরুত্ব দেয় তাই তার পক্ষে সম্ভব না এই সম্পর্ক মেনে নিতে। আর যদিও সম্পর্ক মেনে নেয় তাহলে গ্রামে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। তার থেকে আমার উচিত ঐ মেয়েকে ভুলে যাওয়া।

সবাই খালি ভুলে যাওয়ার পরামর্শ দেয়, ভুলে যাওয়া কি এতই সহজ। আপনি পারবেন ছোটবেলায় শেখা নামতা ভুলে যেতে। সেই নামতা যা সুর করে পড়ে মুখস্ত করেছিলেন, আজ তা কি করে ভুলে যাবেন।

আমার অবস্থা বুঝে সে বলল, দেখি মামাকে বলে, কি বলেন।

সারাদিন অপেক্ষায় থাকলাম, ভাইয়া কখন ফোন করে, অপেক্ষার প্রহর যেন কাটে না। শেষ বিকেলে তার ফোন পেলাম। আমাকে অনেক কিছু বোঝাল, যার মর্মার্থ বাবা কিছুতেই এই সম্পর্ক মেনে নিবেন না। মেয়ে কাল না সুন্দর, গরীব না ধনী তা শুনতে চাচ্ছে না তার একটাই কথা সে আমাদের আত্মীয়। এই আত্মীয়তার মাঝে সে কিছুতেই বিয়ে করাবে না। তাও যদি বোন সম্পর্কীয় হতো তাহলে একটা কথা ছিল। তার কথা হল, বেশি কিছু করতে চাইলে সম্পর্ক পিতা-পুত্রের সম্পর্ক ছেদ করেই করতে হবে।

এত কঠিন শর্ত আমি মানি কি করে। শর্ত ভঙ্গ করার সাহস, শক্তি, সামর্থ্য কোনটাই নেই। মাত্র তৃতীয় বর্ষে পা দিয়েছি। এখনও ফাইনাল ইয়ার, মাস্টার্স চাকরি কত সময় পড়ে আছে। এখন কিছু করলে কে সহায়তা করবে। কে ঘরে বসিয়ে খাওয়াবে।

সারাদিন ঘোরের মাঝে কাটল, কত কি ভাবলাম কিন্তু কোনটাই কাজের না। সেদিনের পর বেলার সাথেও ঠিকমতো কথা হচ্ছে না। ফোন দিলে বেশির ভাগ সময় ফোন ধরে না, যাও ধরে কথার বদলে শুধু কান্না শুনতে পাই। একবার ফোন ধরতে আচ্ছা মতো ঝাড়লাম। বিকেলে বের হওয়ার জন্য বলায় কিছু বলল না।

ভেবেছিলাম হয়ত বিকেলে বের হবে না, অপেক্ষায় ছিলাম, শেষ পর্যন্ত বের হল। আবার সেই কার্জন হলে গিয়ে বসলাম। ওর দিকে তাকানো যায় না, কেঁদে কেঁদে মুখ-চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে, চেনাই যায় না। বুঝলাম কি মানসিক চাপে আছে।

হালকা কিছু কথা বলে স্বাভাবিক হতে চাইলাম। ও যেন পাত্তাই দিল না। জানতে চাইল বাবার মতামত আছে কিনা, এ কথা ও কথায় ভুলিয়ে দিতে চাইলে জোড় দিয়ে বলল, বাবার মত কি।

মিথ্যে বলতে পারিনা, সত্যিটাই বললাম, বাবা রাজি না আর এই বয়সে আমার পক্ষে সম্ভব না বিয়ে করা। অন্তত পক্ষে মাস্টার্স শেষ করার আগে আমি কিছুই করতে পারব না।

বেলাকে বোঝাতে চাইলাম, ও বুঝতেই চাইছে না। ওর এক কথা, ছোট বোন বড় হয়ে যাচ্ছে, ওকে বিয়ে দিতে হবে। বড় বোনের আগে ছোট বোনের বিয়ে হলে পরে আর বড় বোনের বিয়ে হয় না। আমি আশ্বাস দিলাম মাস্টার্স শেষ হলে তার আর চিন্তা করতে হবে না। ও কিছুতেই শুনতে চাইল না। সামনের শুক্রবার পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে, আজই হয়ত আমাদের এভাবে শেষ দেখা, হয়ত এরপরও দেখা হবে, তবে তা অন্য রূপে।

রাত বাড়ছে, এখানে এভাবে বসে থাকার কোন মানেই হয় না, হল পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আমার হলের দিকে রওয়ানা হলাম। রাস্তায় চলতে চলতে কত কি মনে হল, কত পরিকল্পনা করলাম, কাকে দিয়ে কি বলাতে হবে, সব পরিকল্পনা একে একে ভেস্তে যেতে লাগল। আমার পরিকল্পনাগুলোর পরীরা উড়ে যেতে লাগল, থাকল শুধু কল্পনা।

সেই যে চলে গেল তারপর আর দেখা হয়নি, ফোন বন্ধ, কতবার ভেবেছি ওদের বাড়িতে গিয়ে ওর সাথে দেখা করি কিন্তু কোন মুখে দেখা করব, কি বলব? আমি যে কিছুই করতে পারিনি। আমার আর কি বলার থাকতে পারে। কানে এসেছে ওর বিয়ে হয়েছে। ছেলে লন্ডন থাকে, হয়ত সাথে নিয়েও যাবে।

কয়েকমাস পর জানলাম বেলাও চলে গেছে, দূরে বহু দূরে।

আমার এই সংক্ষিপ্ত জীবনে বেলা এসেছিল ঝড়ের বেগে। আমার সব উলট -পালট করে আবার চলেও গেল। ও আসার আগে জানতাম না, ভাবতাম না ভালোবাসা কি, ভালোবাসা পেলে কেমন লাগে। কত স্বপ্ন ছিল, আমরা একটা সংসার করব, যেখানে হয়ত অনেক কিছুর অভাব থাকবে কিন্তু ভালবাসার অভাব থাকবে না। উজার করে দেব সব কিছু। আমাদের বংশধররা বলতে পারবে না ভালবাসার অভাব কি জিনিস?

ও কিছু জিনিস শিখিয়েছিল, কি করে ভালবাসতে হয় পরিবারকে, সমাজকে, দেশকে, দায়িত্ববোধ বিষয়টা কি, কি করে পালন করতে হয়।

ছোট বেলায় মাকে হারিয়ে যে ক্ষতি হয়েছিল তার বেশ কিছুটা পূরণ হয়েছিল বেলাকে পেয়ে। ও আমাকে সামাজিক জীব করে তুলেছিল।

সেই বেলাকে ধরে রাখতে পারলাম না। রাখব কি করে, সময়টাই ছিল গোলমেলে। ও যখন আমার জীবনে আসে তখন আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তখন কিছু করার মতো সাহস, শক্তি, সামর্থ্য, সুযোগ কোনটাই ছিল না।  

তাই এখনও ভাবি,

বেলা এসেছিল

অবেলায়।

১৭-০৪-১৬ ইং, মোহনগঞ্জ

আপনার মন্তব্য লিখুন

ফেসবুক লাইক ও শেয়ার