বিকেলটা প্রতিদিন লাইব্রেরিতেই কাটায় পাভেল। আজ সারাদিন তার কি যেন হয়েছে। কোন কাজেই মন বসাতে পারছে না। কলেজে গিয়ে ঠিক মত ক্লাশও করতে পারেনি। অবশ্য সে এখন বি.এ ক্লাশের ছাত্র। ক্লাশ না করলেও চলে। ক্লান্ত দুপুর ঘুমিয়ে কাটিয়েছে, এখন এই অলস বিকেল নিয়ে তার চিন্তা।
লাইব্রেরিতে যাওয়ারও ইচ্ছে হচ্ছে না। আবার শুয়ে থাকতেও ইচ্ছে করছে না।
পাভেল তাই বাসার ছাদে উঠে এল। দোতলা বাসার ছাদটা সত্যিই ছিমছাম করে গোছানো।
ছাদের দক্ষিন অংশে গোলাপ বাগান। টবের উপর গোলাপ গাছে নানান বর্ণের গোলাপ
সারা বছরই ফুটে থাকে। বাগানের এ অংশটি তৈরি করেছে পাভেলের বাবা ফজলুল করিম।
তিনি সৌখিন প্রকৃতির মানুষ। সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার হিসেবে আর মাত্র
দুই বছর চাকরি আছে। দেশের অনেক জায়গা ঘুরে নিজ শহরে স্থিত হয়েছে।
ছাদের উত্তর পাশে টবে পেয়ারা গাছ, লেবুগাছ আর কিছু মৌসুমী সবজি গাছ লাগিয়েছে পাভেলের মা রাজিয়া বেগম। তিনি ফুলগাছ একেবারেই পছন্দ করে না, তার কথা এগুলোতে কোন উপকার পাওয়া যায়না, জঙ্গল হয়ে থাকে। প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন গত বছর ইচ্ছে করে চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে এসেছে। তার হাতে অফুরন্ত সময়।
ফজলুল করিম আর রাজিয়া বেগমের একটা মজার গল্প আছে। ফজলুল করিম আগে চাকরি করত সহকারী শিক্ষক হিসেবে আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিল রাজিয়া বেগম। স্ত্রীর অধীনে আবার কিসের চাকরি। ঠিক মতো স্কুলে যেত না, ছুটির কোন নিয়ম মানত না, ক্লাশ ঠিক মতো করাতো না। সব দেখে শুনে রাজিয়া বেগম তার কর্তা ব্যক্তিদের ধরে এর একটা ব্যবস্থা করে দিতে বলে। যে সময়ের কথা সেই আমলে অনেক কিছুই হত, কর্তা ব্যক্তিরা প্রমোশন দিয়ে ফজলুল করিমকে সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার বানিয়ে দেয়। ঝামেলা মিটে যায়।
পাভেল এই গল্পটা অনেকবার শুনেছে। আজ তার কিছুতেই মন বসছে না, ছাদে কিছু চেয়ার পাতা আছে বিকেলে বসার জন্য, তার একটাতে বসে পড়ল সে। বাতাসে লেবু গাছের পাতাগুলো দুলছে, আর দুলছে পাভেলের হৃদয়। তার বয়সটা এমন যে হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যকুল, কিন্তু কাকে বলবে তা জানে না। সেই মানুষটা কোথায় যাকে হৃদয়ের এই দোলার কথা বলা যায়?
পাভেলের বসে থাকতেও ভালো লাগছে না। উঠে দাড়িয়ে পায়চারি করতে লাগল। তার কেন এমন হচ্ছে, কেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বসন্তকাল শুরু হয়েছে , হালকা বাতাসে নানান ফুলের সুবাস। সেই বাতাস তার হৃদয়টা ফাঁকা করে দিয়ে যাচ্ছে। পাভেল পায়চারি করতে করতে হঠাৎ থমকে দাড়িয়ে পড়ল।
পাভেলদের দোতলা বাসার দেয়াল ঘেষে দাড়িয়ে আছে শিমুদের টিনের ঘর। যেন কোন সম্ভ্রান্ত লোকের পাশে দাড়িয়ে আছে কুলি মজুর শ্রেণির কেউ। একেবারেই মানাচ্ছে না।
এই যে মানাচ্ছে না এটা নিয়ে মাথা ঘামান না শিমুর বাবা এরফান আলী। শুধু এটা নিয়ে না তিনি কোন কিছুই নিয়েই ভাবেন না। তার কাজ শুধু সকাল ৯ টায় অফিসে যাওয়া আর বিকেল ৫ টায় বাসায় আসা। সংসার সামলান শিমুর মা শেফালী বেগম। সব দিকে তার নজর দিতে হয়, আগে অনেক অভিযোগ করতেন এখন আর করেন না। অভিযোগ দিয়ে কিছু হয়না এটা এতগুলো বছর সংসার করে বুঝে গিয়েছেন। তবে ইদানিং তাকে একা সংসার সামলাতে হয়না। ঘরের কাজে শিমু মাকে সাহায্য করে। করবেই না কেন এবার দশম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। বয়স তো আর কম হল না। এই বয়সে শেফালী বেগমের প্রথম পুত্র হয়েছিল।
শিমু প্রতিদিন বিকেলে পড়াশোনা শেষ করে ঘর থেকে বের হয়ে বাড়ির ভেতর খোলা জায়গায় হাঁটাহাটি করে। আসরের আযান থেকে মাগরিবের আযান পর্যন্ত এই সময়টা এখানেই হাঁটে সে। তাদের বাড়িতে বিপরীত মুখী দুইটা টিনের ঘর একটির দক্ষিন দরজা আরেকটির উত্তর দরজা। তার ভাই ঢাকা থেকে আসলে ছোট ঘরটাতে থাকে। বাকি দিনগুলোতে শিমু এই ঘর দখল দেয়।
এই ঘরের সামনে গন্ধরাজ গাছ। ফুলে ফুলে ভরে আছে। শিমু পদচারণা থামিয়ে গন্ধরাজ গাছের কাছে চলে এল। একটা ফুল ধরে নাকের কাছে নিয়ে প্রাণ ভরে ঘ্রাণ নিল। সবাই শুধু গোলাপ গোলাপ করে তার পছন্দ। কি সুন্দর সাদা ফুল। আর কি গন্ধ, তাইতো এর নাম গন্ধরাজ। আর ফুলটা গাছ থেকে ছিড়ে নিলেও প্রায় তাজা থাকে অনেক দিন।
শিমু ফুল নিয়ে ব্যস্ত, আর দোতলার ছাদ থেকে পাভেল শিমুকে নিয়ে ব্যস্ত। মুগ্ধ নয়নে দেখছে শিমুকে। এতদিন অনেকবার দেখেছে মেয়েটিকে কখনও এমন মনে হয়নি। আজ কেন যেন অন্য রকম লাগছে। কেন যেন তার হৃদয়ের দোলাটা থেমে গেছে বলে মনে হল। আর শিমু? সেকি দেখছে? কেউ তার দিকে কতটা মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে? হয়ত দেখছে, হয়ত না।
পাভেল হাঁটতে হাঁটতে ছাদের একপাশে এসে দাঁড়ায়। কখন যে শিমুর দিকে চোখ যায় খেয়াল করতে পারেনি।
সূর্য ডুবতে আর বেশি দেরি নেই। এই সময়ে পশ্চিম আকাশে এক অপরূপ দৃশ্যের অবতারণা হয়। লাল, নীল, মেঘ ঘুরে বেড়ায় ইতস্তত। এর মাঝে লাল টুকটুকে সূর্য ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে অতল গহব্বরে। হয়ত মনে করিয়ে দিতে চায় আমাদেরও এভাবে একদিন চলে যেতে হবে।
রেলিং ঘেরা ছাদের রেলিং এর উপর হাতে ভর দিয়ে আকাশে ডুবে যাওয়া সূর্য দেখতে লাগল। কতক্ষণ আকাশের দিকে চেয়েছিল খেয়াল নেই, হয়ত অনন্তকাল চেয়ে থাকত কিন্তু বাদ সাধল পাশের বাড়ির ফুলগাছের পাশে দাঁড়ানো মেয়েটি। কলি যেমন তার আভা ছড়িয়ে দিয়ে প্রস্ফুটিত হয়ে ফুলে পরিণত হয় ঠিক তেমনি শিমু কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পন করতে যাচ্ছে। চেহারা ততটা সুন্দর না হলেও মায়া কাড়া। দীঘল কালো চুল, গ্রীবাদেশ বেয়ে নেমে এসেছে পিঠের উপর। ভ্রুজোড়া মিশকালো চোখ দুটো গভীর সরোবরের মত। গালের ডানপাশে কালো তিল সৌন্দর্যকে আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। পাভেলের ইচ্ছে করছে এই মূহুর্তে শিমুর সাথে কথা বলতে। কিন্তু তা এখন সম্ভব না। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া পাভেলের আর কিইবা করার আছে।
শিমুকে এর আগে বহুদিনই দেখেছে পাভেল। কিন্তু আজ তার কাছে মনে হল সে খুঁজে পেয়েছে এতদিন যাকে সে খুঁজে বেড়িয়েছে। ভাবল শিমুকে না পেলে তার চলবে না যে কোন ভাবেই হোক না কেন শিমুকে জয় করতে হবেই।
আজ শনিবার।
দীর্ঘ দিন এসএসসি পরীক্ষার বন্ধের পর স্কুল খুলেছে শিমুদের। বাসা থেকে স্কুল অনেক দুর। কিছু রাস্তা হেঁটে কিছু রাস্তা রিক্সায় স্কুলে যেতে হয় তাকে, অবশ্য ভাগ্য ভাল থাকলে কখনও কখনও বাসার সামনেই রিক্সা পাওয়া যায়। বাসা থেকে বের হয়ে মিনিট দশেক হাঁটলে বান্ধবী নিশুদের বাসা। দুই বান্ধবী এক সাথেই স্কুলে যায়।
পাভেল এসব কিছু খুব ভালো করেই জানে, সে এই মাত্র গোসল করে জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার ঘরের জানালা থেকেই শিমুদের বাড়ির উঠোন দেখা যায়। চুল আঁচড়িয়ে তার প্রিয় সাদা শার্ট গায়ে চড়িয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল। খাবার টেবিলে মা নাস্তা নিয়ে বসে আছে। টেবিলে বসেই গোগ্রাসে খাওয়া শুরু করে দিল। দেখে মনে হয় যেন শেষ ট্রেন এখনই ছেড়ে দিবে। মা ধমক দিয়ে বলল আস্তে খা। গলায় ঠেকবে।
আস্তেই তো খাচ্ছি মা। জোরে তো খায় এভাবে, বলেই শেষ লোকমাটা দ্রুত মুখে ভরে দিল।
মা পাভেলের ড্রেস দেখে জানতে চাইলো, কোথাও যাবি নাকি?
হ্যাঁ মা একটু বাইরে যাব। মা আর কিছু জিজ্ঞেস করল না, ছেলে বড় হয়েছে তাকে সব কথা জিজ্ঞেস করাও ঠিক না।
খাওয়া শেষ করে রুমে এসে দেখল শিমু বাড়ি থেকে বের হয়েছে। তাইতো দেরি না করে দ্রুত নিচে চলে এল।
রাস্তায় শিমু পাভেলকে দেখে হাস্যময় মুখে বলল, কেমন আছেন পাভেল ভাই? কোথাও যাচ্ছেন?
পাভেল শার্টের কলার আর চুলে হাত বুলিয়ে আরেকটু পরিপাটি করে বলল, ভালো আছি, তুমি কেমন আছ? স্কুলে যাচ্ছ বুঝি?
শিমুর পড়নে স্কুল ড্রেস। আর এখন স্কুলে যাওয়ার সময়। যে কেউ দেখলে বলবে স্কুলেই যাচ্ছে, এটা জিজ্ঞাসা করার মানে কি? মনে মনে বলল, স্কুলে না গাধা, মাঠে যাচ্ছি হাডুডু খেলতে, যাবেন? কিন্তু মুখে বলল, স্কুলে যাচ্ছি ভাইয়া।
ওহ তাহলে তোমাদের স্কুল খুলেছে। এসএসসি পরীক্ষা কি শেষ হয়েছে ? আচ্ছা হেঁটেই তো যাবে চল, হাঁটতে শুরু করি, আজ মনে হয় এখান থেকে রিক্সা পাওয়া যাবে না।
শিমু বলল, আপনি কোথাও যাবেন বুঝি, আমি তো আস্তে হাঁটি, আপনি চলে যান আমার সমস্যা হবে না, আমি একলাই যেতে পারব।
তোমাকে এগিয়ে দিতে যাব কেন? ওদিকেই যাচ্ছিলাম, ভাবলাম একসাথেই যাই। তোমার অসুবিধা হলে থাক। আমি না হয় পরেই আসছি।
রাগ করলেন ভাইয়া, রাগ করবেন না প্লিজ। চলুন যাওয়া যাক।
পাভেল শিমু একসাথে রওয়ানা দিল। ভাগ্য ভালই বলতে হবে। কোন রিক্সা আজ তারা পেল না, রিক্সা পেলে সমস্যা হত, তখন হয়ত শিমুকে রিক্সায় তুলে দিতে হত। হাঁটতে লাগল দুইজন। এতে পাভেলের সুবিধাই হল। অনেকটা সময় শিমুকে কাছে পাওয়া যাবে। অনেক কথাই বলা যাবে। পাভেল ভাবছে কি বলা যায়, অনেক কথাই বলার ইচ্ছা হচ্ছে কিন্তু কিছুই বলতে পারছে না। এভাবে চলতে চলতে কখন যে স্কুলের গেটে চলে এল বলতে পারবে না পাভেল।
ভাইয়া সঙ্গ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ, শিমুর কথায় পাভেল সম্বিৎ ফিরে পেল। দেখল তারা স্কুল গেটে চলে এসেছে। পাভেল শিমুকে স্কুলে দিয়ে শহরের দিকে হাঁটতে গেল।
পড়ত বসে কিছুতেই মন বসাতে পারছে না পাভেল। বারে বারে মনের পর্দায় ভেসে উঠছে শিমুর ছবি। মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে কিন্তু ছোঁয়া যায় না। বইয়ের তাক থেকে লাল মলাটের ডায়েরি বের করল। কলমদানি থেকে তুলে নিল তার প্রিয় কলম। পাতা উল্টিয়ে সাদা পাতায় লিখতে শুরু করল-
প্রতিদিনই তোমাকে দেখি কিন্তু কখনও পুরনো হওনা তুমি। সব সময় নতুন রূপে তোমায় দেখতে পাই। কিন্তু কিছুই জানতে পারো না তুমি। কতবার মনে হয় তোমাকে সামনে পেলে বলব, শিমু তোমার চোখের তারায় আমি বাঁধা পড়েছি। ওখান থেকে আমাকে দূরে ঠেলে দিও না। তাহলে আমার যাওয়ার জায়গা থাকবে না। আমাকে তুমি আপন করে নাও।
কিন্তু বলতে পারিনা। সাহস হয় না। ভাবি যদি ফিরিয়ে দাও। তার চেয়ে এইযে তোমাকে প্রতিদিন দেখছি তাইতো ভালো। তুমি হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছ। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। বাইরে চাঁদটা কি সুন্দর আলো দিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তুমি আর আমি চাঁদনী রাতে হাত ধরে পাশাপাশি বসে আছি। তুমি গল্প বলছ আর আমি শুনছি। কিন্তু সবই কল্পনা মাত্র। এ স্বপ্ন কি পূরণ হতে পারে না?
“বরাঙ্গনা, এসো দুজনে মিলে গোলক মাঝে অটবি তলে বাঁধি স্বপ্নের নীড়।”
ডায়েরি লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে পড়ল পাভেল।
আজ পাভেলের বোন রুনাকে দেখতে আসবে ছেলে পক্ষ। ফজলুল করিম সে জন্য খুবই ব্যস্ত। তার ভাবনা চাকরি থাকতে থাকতে ছোট মেয়ের বিয়ে দেওয়া। তাঁতে সে কিছুটা নিশ্চিত হতে পারবে। তিনি তার বড় মেয়ে কনাকে খুব ভাল ঘরে বিয়ে দিয়েছেন।
তার একমাত্র ছেলে পাভেল বিএ তে পড়ছে। কদিন পর পাশ করে বের হয়ে কিছু একটা করতে পারবে। রুনা এবার এইচএসসি পাশ করেছে। দেখতে শুনতে খারাপ না, তাই বর পক্ষের পছন্দ হতে দেরি হয়নি। খাওয়া দাওয়ার পর বিয়ের দিন তারিখও ঠিক করে ফেলল।
চারদিকে হই হুল্লোড়, বিয়ে বাড়ি বলে কথা। সারাবাড়ি আত্মীয় স্বজনে ভরে গেছে। এই বাড়ির একমাত্র ছেলে বলে পাভেলের ব্যস্ততাও বেশি। সব দিকেই তাকে লক্ষ্য রাখতে হয়।
সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল, বর পক্ষের কোন খবর নেই। পাত্রের বাসা খুব বেশি দূরে নয়, বাসে আসতে খুব বেশি হলে দেড় ঘন্টা লাগার কথা। তাতে এতো দেরি হওয়ার কথা না। পাভেল বাবার কাছে অনুমতি নিয়ে তাদের খোঁজ নিতে গেল। ঘন্টা তিনেক পর ফিরে এসে যা বলল তাতে বাসার পরিবেশটাই পাল্টে গেল।
বিয়ের গাড়ি ঠিক সময়েই রওয়ানা হয়েছিল। মাঝ পথে অন্য আরেকটি গাড়িকে সাইড দিতে গিয়ে দূর্ঘটনায় পড়ে। আর এতে সবাই বেঁচে থাকলেও হবু বর বেঁচে নেই।
ঘটনা শোনার পর ফজলুল করিম বুকে হাত দিয়ে পড়ে গেল। কেউ পানি নিয়ে আসল কেউ পাখা। পাভেলের বড় চাচা ডাক্তার। তিনি ভাইয়ের বুকে হাতে নাকের সামনে বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষা করে বুঝল তার ভাই আর বেঁচে নেই।
কয়েক ঘন্টা আগেও যে বাড়ি ছিল উৎসবে পরিপূর্ণ, এখন তা শোকের বাড়িতে রূপ নিয়েছে।
শোককেও এক সময় শক্তিতে পরিনত করতে হয়। না হলে জগৎ সংসার থেমে থাকত। পাভেলও শোককে শক্তিতে পরিনত করেছে। রুনা ভালো ছাত্রী হওয়ায় ঢাকায় ভর্তি হতে পেরেছে, পাভেলেরও পরীক্ষা এগিয়ে আসতে লাগল। ওদিকে শিমু এবার এসএসসি দিবে। ভীষন ব্যস্ত। সব সময় পড়াশোনায় ডুবে থাকতে হয়। মাঝে মাঝে যখন পড়া বুঝে না তখন পাভেলের কাছে চলে আসে। এর ব্যবস্থা পাভেলের মা করে দিয়েছে। শিমুদের অবস্থা অতটা ভাল না, শিমু যে প্রাইভেট পড়বে সে অবস্থাও নেই। তাই পাভেলকে এই কাজে লাগিয়েছে।পাভেল এতে খুশিই হয়েছে। যতক্ষণ পড়ায় এক প্রকার ভালো লাগা কাজ করে।
আজও পড়া বুঝতে এসেছে। পাভেল বাসায় নেই। শিমু চলে আসতো, পাভেলের মা বলল বসতে। ছেলেকে দোকানে পাঠিয়েছে। চলে আসবে বেশি সময় লাগবে না। শিমু পাভেলের ঘরে বসে বইয়ের তাকের বইগুলো দেখতে লাগল। এত বই পড়ে পাভেল ভাই। তার ইচ্ছে আছে এসএসসির পর এখান থেকে বই নিয়ে পড়বে।
বইয়ের ফাঁকে একটা ছবির মতো কি যেন দেখা যাচ্ছে। কারও ছবির মত মনে হচ্ছে। স্বাভাবিক কৌতূহলে একপা একপা করে এগিয়ে গিয়ে ছবিটা বের করল। তারপর যা দেখল তাতে অবাক হওয়ার ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না।
ছবিটি শিমুর। এটা এখানে এল কোথা থেকে। ভয়ে ভয়ে আবার ছবিটি যথাস্থানে রেখে দিল। কেন যেন তার মনে হল কোথাও কিছু একটা সমস্যা আছে। টেবিলে দেখলো একটা সুন্দর মলাটের একটা ডায়েরি। অন্যের ডায়েরি পড়া নিষেধ। তারপরও খুলে ফেলল। যে লোক তার ছবি অনুমতি ছাড়া নিজের কাছে রাখতে পারে তার ডায়েরি পড়া যেতেই পারে। কয়েকটি পাতা উল্টিয়ে দেখল সুন্দর অক্ষরে লেখা-
শিমু প্রতিদিন তোমাকে কতবারই দেখি, কতবারই সামনে এসে চলে যাও। ভাবি তোমাকে বলেই ফেলি না বলা কথা। কিন্তু বলতে পারি না। শুধু ভাবি বে যে বলব, তোমাকে ভালোবাসি।
এরপর আর পড়তে পারল না। শিমু মনে মনে বলল, আমিও যে তোমাকে ভালোবাসি, পাভেল ভাই। কিন্তু তুমি কিছু না বললে আমি কি করে বলব। দোতলার সিড়িতে নামতে গিয়ে মুখোমুখি হল পাভেলের সাথে। একরাশ লজ্জা এসে ভর করল ওর মুখে। মাথা নিচু করে এক দৌড়ে চলে এল বাড়িতে।
ছাদের উপর বসে উলের কাপড় বুনছে পাভেলের মা, তিনি দেখলেন শিমু বের হয়ে গেল। শিমুকে তার অনেক ভালো লাগে। মনে মনে ভাবল এমন একটি মেয়ে যদি তার পুত্রবধূ হয় মন্দ হয় না।
প্রতিদিনের মতো রাত্রে শিমু পড়তে বসেছে। সদর দরজার আওয়াজে বুঝল বাসায় বাবা এসেছে। প্রতিদিনই এমন সময় আসে। তাই ওদিকে মন না দিয়ে পড়তেই লাগল। হঠাৎ মায়ের চিৎকারে ভয় পেয়ে মায়ের ঘরে চলে গেল। বাবা বিছানায় শোওয়া। মা পাখা দিয়ে বাতাস করছে। শিমু মায়ের হাত থেকে পাখা নিয়ে বাতাস করতে লাগল।
কথায় কথায় যা জানল তা বড় ভয়ঙ্কর। বাবার চাকরি চলে গেছে। অফিসে দলাদলি ছিল তারই রেশারেশিতে ষড়যন্ত্রে করে সহকর্মীরা মিলে চোর সাজিয়ে চাকরি থেকে অব্যহতি দিতে বাধ্য করেছে।
কুকথা যেটা সত্যি হোক মিথ্যা হোক ছড়াতে সময় নেয় না। পরদিন পাড়ায় রটে গেল, অফিসে চুরি করায় চাকরি চলে গেছে এরফানের। পাড়ায় যেটুকু সম্মান ছিল তাও হারালো শিমুর পরিবার। আর এদিকে পাভেলের মা বিকেলে যে ভাবনা ভেবেছিল তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল দিল। মন থেকে মুছে ফেলল। এমন একটা চোরের পরিবারে সে আত্মীয় করবে না।
পাভেলের ডিগ্রি পরীক্ষা শেষ। পরীক্ষার সিট পড়েছিল তার মামার বাড়ির কাছে তাই এই কয়দিন মামার বাড়িতে থেকে পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষার কারণে এতো ব্যস্ত ছিল যে কোন দিকে খেয়াল রাখতে পারেনি।
আজ যখন পরীক্ষা শেষ হল তখন তার হাতে প্রচুর সময়। অনেকদিন হল শিমুকে দেখে না। বাবার চাকরি চলে যাওয়ার পর শিমু আর পাভেলদের বাসায় আসেনি। শুধু পাভেলদের বাসায় না, আর কোথাও যায়নি। বাসায় বসে থেকেছে সারাদিন, বাইরে আসলে সবাই এটা ওটা জিজ্ঞেস করে। যেন বাবার না ওরই চাকরি চলে গেছে।
শিমু আজ অনেকদিন পর স্কুলে যাওয়ার জন্য বের হল। কিছু দূর যাওয়ার পর পেছন ফিরে দেখে পাভেল আসছে। শিমু চায় না পাভেলের মুখোমুখি হতে। একটু দ্রুত পা চালাচ্ছে যাতে ধরতে না পারে। খুব আশা করছে যদি একটা রিক্সা আসে। উঠে যেতে পারবে। ভাগ্য খারাপ হলে যা হয়। পাভেল পা চালিয়ে এক সময় শিমুর কাছে চলে এল।
শিমু কেমন আছো? অনেক দিন দেখা হয়নি তোমার সাথে, পরীক্ষা ছিল কাল রাতে বাসায় আসলাম।
ভালো আছি ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন? পরীক্ষা কেমন হল। মনে মনে ভাবছে বাবার বিষয়ে পাভেল কি কিছুই জানেনা? কখন যে বলে বাবার কি হয়েছিল। একটু ভাবনায় পড়ে গেল, মুখে কিছু বলল না।
পরীক্ষা ভালোই হয়েছে। অনেক চিন্তা মুক্ত এখন আমি।
পাভেল ভাবল, আজই কিছু বলতে হবে। ও ঐদিন ইচ্ছে করে ডায়েরি আর ছবিটা ওভাবে রেখে বাইরে গেছে, যাতে শিমু দেখে। ও পরে বুঝতে পারে যা ভাবছে তাই ঠিক। শিমু সব দেখেছে।
পাভেল মুখটাকে গম্ভীর করে বলতে শুরু করল, শিমু কিছু কথা ছিল তোমার সাথে।
শিমুর অন্তর আত্মা ছ্যাত করে উঠল। যে ভয় এতক্ষণ ছিল তাই বুঝি সত্যি হবে।একটু কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, বলুন ভাইয়া।
পাভেলের বসে থাকতেও ভালো লাগছে না। উঠে দাড়িয়ে পায়চারি করতে লাগল। তার কেন এমন হচ্ছে, কেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বসন্তকাল শুরু হয়েছে , হালকা বাতাসে নানান ফুলের সুবাস। সেই বাতাস তার হৃদয়টা ফাঁকা করে দিয়ে যাচ্ছে। পাভেল পায়চারি করতে করতে হঠাৎ থমকে দাড়িয়ে পড়ল।
পাভেলদের দোতলা বাসার দেয়াল ঘেষে দাড়িয়ে আছে শিমুদের টিনের ঘর। যেন কোন সম্ভ্রান্ত লোকের পাশে দাড়িয়ে আছে কুলি মজুর শ্রেণির কেউ। একেবারেই মানাচ্ছে না।
এই যে মানাচ্ছে না এটা নিয়ে মাথা ঘামান না শিমুর বাবা এরফান আলী। শুধু এটা নিয়ে না তিনি কোন কিছুই নিয়েই ভাবেন না। তার কাজ শুধু সকাল ৯ টায় অফিসে যাওয়া আর বিকেল ৫ টায় বাসায় আসা। সংসার সামলান শিমুর মা শেফালী বেগম। সব দিকে তার নজর দিতে হয়, আগে অনেক অভিযোগ করতেন এখন আর করেন না। অভিযোগ দিয়ে কিছু হয়না এটা এতগুলো বছর সংসার করে বুঝে গিয়েছেন। তবে ইদানিং তাকে একা সংসার সামলাতে হয়না। ঘরের কাজে শিমু মাকে সাহায্য করে। করবেই না কেন এবার দশম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। বয়স তো আর কম হল না। এই বয়সে শেফালী বেগমের প্রথম পুত্র হয়েছিল।
শিমু প্রতিদিন বিকেলে পড়াশোনা শেষ করে ঘর থেকে বের হয়ে বাড়ির ভেতর খোলা জায়গায় হাঁটাহাটি করে। আসরের আযান থেকে মাগরিবের আযান পর্যন্ত এই সময়টা এখানেই হাঁটে সে। তাদের বাড়িতে বিপরীত মুখী দুইটা টিনের ঘর একটির দক্ষিন দরজা আরেকটির উত্তর দরজা। তার ভাই ঢাকা থেকে আসলে ছোট ঘরটাতে থাকে। বাকি দিনগুলোতে শিমু এই ঘর দখল দেয়।
এই ঘরের সামনে গন্ধরাজ গাছ। ফুলে ফুলে ভরে আছে। শিমু পদচারণা থামিয়ে গন্ধরাজ গাছের কাছে চলে এল। একটা ফুল ধরে নাকের কাছে নিয়ে প্রাণ ভরে ঘ্রাণ নিল। সবাই শুধু গোলাপ গোলাপ করে তার পছন্দ। কি সুন্দর সাদা ফুল। আর কি গন্ধ, তাইতো এর নাম গন্ধরাজ। আর ফুলটা গাছ থেকে ছিড়ে নিলেও প্রায় তাজা থাকে অনেক দিন।
শিমু ফুল নিয়ে ব্যস্ত, আর দোতলার ছাদ থেকে পাভেল শিমুকে নিয়ে ব্যস্ত। মুগ্ধ নয়নে দেখছে শিমুকে। এতদিন অনেকবার দেখেছে মেয়েটিকে কখনও এমন মনে হয়নি। আজ কেন যেন অন্য রকম লাগছে। কেন যেন তার হৃদয়ের দোলাটা থেমে গেছে বলে মনে হল। আর শিমু? সেকি দেখছে? কেউ তার দিকে কতটা মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে? হয়ত দেখছে, হয়ত না।
পাভেল হাঁটতে হাঁটতে ছাদের একপাশে এসে দাঁড়ায়। কখন যে শিমুর দিকে চোখ যায় খেয়াল করতে পারেনি।
সূর্য ডুবতে আর বেশি দেরি নেই। এই সময়ে পশ্চিম আকাশে এক অপরূপ দৃশ্যের অবতারণা হয়। লাল, নীল, মেঘ ঘুরে বেড়ায় ইতস্তত। এর মাঝে লাল টুকটুকে সূর্য ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে অতল গহব্বরে। হয়ত মনে করিয়ে দিতে চায় আমাদেরও এভাবে একদিন চলে যেতে হবে।
রেলিং ঘেরা ছাদের রেলিং এর উপর হাতে ভর দিয়ে আকাশে ডুবে যাওয়া সূর্য দেখতে লাগল। কতক্ষণ আকাশের দিকে চেয়েছিল খেয়াল নেই, হয়ত অনন্তকাল চেয়ে থাকত কিন্তু বাদ সাধল পাশের বাড়ির ফুলগাছের পাশে দাঁড়ানো মেয়েটি। কলি যেমন তার আভা ছড়িয়ে দিয়ে প্রস্ফুটিত হয়ে ফুলে পরিণত হয় ঠিক তেমনি শিমু কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পন করতে যাচ্ছে। চেহারা ততটা সুন্দর না হলেও মায়া কাড়া। দীঘল কালো চুল, গ্রীবাদেশ বেয়ে নেমে এসেছে পিঠের উপর। ভ্রুজোড়া মিশকালো চোখ দুটো গভীর সরোবরের মত। গালের ডানপাশে কালো তিল সৌন্দর্যকে আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। পাভেলের ইচ্ছে করছে এই মূহুর্তে শিমুর সাথে কথা বলতে। কিন্তু তা এখন সম্ভব না। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া পাভেলের আর কিইবা করার আছে।
শিমুকে এর আগে বহুদিনই দেখেছে পাভেল। কিন্তু আজ তার কাছে মনে হল সে খুঁজে পেয়েছে এতদিন যাকে সে খুঁজে বেড়িয়েছে। ভাবল শিমুকে না পেলে তার চলবে না যে কোন ভাবেই হোক না কেন শিমুকে জয় করতে হবেই।
আজ শনিবার।
দীর্ঘ দিন এসএসসি পরীক্ষার বন্ধের পর স্কুল খুলেছে শিমুদের। বাসা থেকে স্কুল অনেক দুর। কিছু রাস্তা হেঁটে কিছু রাস্তা রিক্সায় স্কুলে যেতে হয় তাকে, অবশ্য ভাগ্য ভাল থাকলে কখনও কখনও বাসার সামনেই রিক্সা পাওয়া যায়। বাসা থেকে বের হয়ে মিনিট দশেক হাঁটলে বান্ধবী নিশুদের বাসা। দুই বান্ধবী এক সাথেই স্কুলে যায়।
পাভেল এসব কিছু খুব ভালো করেই জানে, সে এই মাত্র গোসল করে জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার ঘরের জানালা থেকেই শিমুদের বাড়ির উঠোন দেখা যায়। চুল আঁচড়িয়ে তার প্রিয় সাদা শার্ট গায়ে চড়িয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল। খাবার টেবিলে মা নাস্তা নিয়ে বসে আছে। টেবিলে বসেই গোগ্রাসে খাওয়া শুরু করে দিল। দেখে মনে হয় যেন শেষ ট্রেন এখনই ছেড়ে দিবে। মা ধমক দিয়ে বলল আস্তে খা। গলায় ঠেকবে।
আস্তেই তো খাচ্ছি মা। জোরে তো খায় এভাবে, বলেই শেষ লোকমাটা দ্রুত মুখে ভরে দিল।
মা পাভেলের ড্রেস দেখে জানতে চাইলো, কোথাও যাবি নাকি?
হ্যাঁ মা একটু বাইরে যাব। মা আর কিছু জিজ্ঞেস করল না, ছেলে বড় হয়েছে তাকে সব কথা জিজ্ঞেস করাও ঠিক না।
খাওয়া শেষ করে রুমে এসে দেখল শিমু বাড়ি থেকে বের হয়েছে। তাইতো দেরি না করে দ্রুত নিচে চলে এল।
রাস্তায় শিমু পাভেলকে দেখে হাস্যময় মুখে বলল, কেমন আছেন পাভেল ভাই? কোথাও যাচ্ছেন?
পাভেল শার্টের কলার আর চুলে হাত বুলিয়ে আরেকটু পরিপাটি করে বলল, ভালো আছি, তুমি কেমন আছ? স্কুলে যাচ্ছ বুঝি?
শিমুর পড়নে স্কুল ড্রেস। আর এখন স্কুলে যাওয়ার সময়। যে কেউ দেখলে বলবে স্কুলেই যাচ্ছে, এটা জিজ্ঞাসা করার মানে কি? মনে মনে বলল, স্কুলে না গাধা, মাঠে যাচ্ছি হাডুডু খেলতে, যাবেন? কিন্তু মুখে বলল, স্কুলে যাচ্ছি ভাইয়া।
ওহ তাহলে তোমাদের স্কুল খুলেছে। এসএসসি পরীক্ষা কি শেষ হয়েছে ? আচ্ছা হেঁটেই তো যাবে চল, হাঁটতে শুরু করি, আজ মনে হয় এখান থেকে রিক্সা পাওয়া যাবে না।
শিমু বলল, আপনি কোথাও যাবেন বুঝি, আমি তো আস্তে হাঁটি, আপনি চলে যান আমার সমস্যা হবে না, আমি একলাই যেতে পারব।
তোমাকে এগিয়ে দিতে যাব কেন? ওদিকেই যাচ্ছিলাম, ভাবলাম একসাথেই যাই। তোমার অসুবিধা হলে থাক। আমি না হয় পরেই আসছি।
রাগ করলেন ভাইয়া, রাগ করবেন না প্লিজ। চলুন যাওয়া যাক।
পাভেল শিমু একসাথে রওয়ানা দিল। ভাগ্য ভালই বলতে হবে। কোন রিক্সা আজ তারা পেল না, রিক্সা পেলে সমস্যা হত, তখন হয়ত শিমুকে রিক্সায় তুলে দিতে হত। হাঁটতে লাগল দুইজন। এতে পাভেলের সুবিধাই হল। অনেকটা সময় শিমুকে কাছে পাওয়া যাবে। অনেক কথাই বলা যাবে। পাভেল ভাবছে কি বলা যায়, অনেক কথাই বলার ইচ্ছা হচ্ছে কিন্তু কিছুই বলতে পারছে না। এভাবে চলতে চলতে কখন যে স্কুলের গেটে চলে এল বলতে পারবে না পাভেল।
ভাইয়া সঙ্গ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ, শিমুর কথায় পাভেল সম্বিৎ ফিরে পেল। দেখল তারা স্কুল গেটে চলে এসেছে। পাভেল শিমুকে স্কুলে দিয়ে শহরের দিকে হাঁটতে গেল।
পড়ত বসে কিছুতেই মন বসাতে পারছে না পাভেল। বারে বারে মনের পর্দায় ভেসে উঠছে শিমুর ছবি। মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে কিন্তু ছোঁয়া যায় না। বইয়ের তাক থেকে লাল মলাটের ডায়েরি বের করল। কলমদানি থেকে তুলে নিল তার প্রিয় কলম। পাতা উল্টিয়ে সাদা পাতায় লিখতে শুরু করল-
প্রতিদিনই তোমাকে দেখি কিন্তু কখনও পুরনো হওনা তুমি। সব সময় নতুন রূপে তোমায় দেখতে পাই। কিন্তু কিছুই জানতে পারো না তুমি। কতবার মনে হয় তোমাকে সামনে পেলে বলব, শিমু তোমার চোখের তারায় আমি বাঁধা পড়েছি। ওখান থেকে আমাকে দূরে ঠেলে দিও না। তাহলে আমার যাওয়ার জায়গা থাকবে না। আমাকে তুমি আপন করে নাও।
কিন্তু বলতে পারিনা। সাহস হয় না। ভাবি যদি ফিরিয়ে দাও। তার চেয়ে এইযে তোমাকে প্রতিদিন দেখছি তাইতো ভালো। তুমি হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছ। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। বাইরে চাঁদটা কি সুন্দর আলো দিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তুমি আর আমি চাঁদনী রাতে হাত ধরে পাশাপাশি বসে আছি। তুমি গল্প বলছ আর আমি শুনছি। কিন্তু সবই কল্পনা মাত্র। এ স্বপ্ন কি পূরণ হতে পারে না?
“বরাঙ্গনা, এসো দুজনে মিলে গোলক মাঝে অটবি তলে বাঁধি স্বপ্নের নীড়।”
ডায়েরি লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে পড়ল পাভেল।
আজ পাভেলের বোন রুনাকে দেখতে আসবে ছেলে পক্ষ। ফজলুল করিম সে জন্য খুবই ব্যস্ত। তার ভাবনা চাকরি থাকতে থাকতে ছোট মেয়ের বিয়ে দেওয়া। তাঁতে সে কিছুটা নিশ্চিত হতে পারবে। তিনি তার বড় মেয়ে কনাকে খুব ভাল ঘরে বিয়ে দিয়েছেন।
তার একমাত্র ছেলে পাভেল বিএ তে পড়ছে। কদিন পর পাশ করে বের হয়ে কিছু একটা করতে পারবে। রুনা এবার এইচএসসি পাশ করেছে। দেখতে শুনতে খারাপ না, তাই বর পক্ষের পছন্দ হতে দেরি হয়নি। খাওয়া দাওয়ার পর বিয়ের দিন তারিখও ঠিক করে ফেলল।
চারদিকে হই হুল্লোড়, বিয়ে বাড়ি বলে কথা। সারাবাড়ি আত্মীয় স্বজনে ভরে গেছে। এই বাড়ির একমাত্র ছেলে বলে পাভেলের ব্যস্ততাও বেশি। সব দিকেই তাকে লক্ষ্য রাখতে হয়।
সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল, বর পক্ষের কোন খবর নেই। পাত্রের বাসা খুব বেশি দূরে নয়, বাসে আসতে খুব বেশি হলে দেড় ঘন্টা লাগার কথা। তাতে এতো দেরি হওয়ার কথা না। পাভেল বাবার কাছে অনুমতি নিয়ে তাদের খোঁজ নিতে গেল। ঘন্টা তিনেক পর ফিরে এসে যা বলল তাতে বাসার পরিবেশটাই পাল্টে গেল।
বিয়ের গাড়ি ঠিক সময়েই রওয়ানা হয়েছিল। মাঝ পথে অন্য আরেকটি গাড়িকে সাইড দিতে গিয়ে দূর্ঘটনায় পড়ে। আর এতে সবাই বেঁচে থাকলেও হবু বর বেঁচে নেই।
ঘটনা শোনার পর ফজলুল করিম বুকে হাত দিয়ে পড়ে গেল। কেউ পানি নিয়ে আসল কেউ পাখা। পাভেলের বড় চাচা ডাক্তার। তিনি ভাইয়ের বুকে হাতে নাকের সামনে বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষা করে বুঝল তার ভাই আর বেঁচে নেই।
কয়েক ঘন্টা আগেও যে বাড়ি ছিল উৎসবে পরিপূর্ণ, এখন তা শোকের বাড়িতে রূপ নিয়েছে।
শোককেও এক সময় শক্তিতে পরিনত করতে হয়। না হলে জগৎ সংসার থেমে থাকত। পাভেলও শোককে শক্তিতে পরিনত করেছে। রুনা ভালো ছাত্রী হওয়ায় ঢাকায় ভর্তি হতে পেরেছে, পাভেলেরও পরীক্ষা এগিয়ে আসতে লাগল। ওদিকে শিমু এবার এসএসসি দিবে। ভীষন ব্যস্ত। সব সময় পড়াশোনায় ডুবে থাকতে হয়। মাঝে মাঝে যখন পড়া বুঝে না তখন পাভেলের কাছে চলে আসে। এর ব্যবস্থা পাভেলের মা করে দিয়েছে। শিমুদের অবস্থা অতটা ভাল না, শিমু যে প্রাইভেট পড়বে সে অবস্থাও নেই। তাই পাভেলকে এই কাজে লাগিয়েছে।পাভেল এতে খুশিই হয়েছে। যতক্ষণ পড়ায় এক প্রকার ভালো লাগা কাজ করে।
আজও পড়া বুঝতে এসেছে। পাভেল বাসায় নেই। শিমু চলে আসতো, পাভেলের মা বলল বসতে। ছেলেকে দোকানে পাঠিয়েছে। চলে আসবে বেশি সময় লাগবে না। শিমু পাভেলের ঘরে বসে বইয়ের তাকের বইগুলো দেখতে লাগল। এত বই পড়ে পাভেল ভাই। তার ইচ্ছে আছে এসএসসির পর এখান থেকে বই নিয়ে পড়বে।
বইয়ের ফাঁকে একটা ছবির মতো কি যেন দেখা যাচ্ছে। কারও ছবির মত মনে হচ্ছে। স্বাভাবিক কৌতূহলে একপা একপা করে এগিয়ে গিয়ে ছবিটা বের করল। তারপর যা দেখল তাতে অবাক হওয়ার ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না।
ছবিটি শিমুর। এটা এখানে এল কোথা থেকে। ভয়ে ভয়ে আবার ছবিটি যথাস্থানে রেখে দিল। কেন যেন তার মনে হল কোথাও কিছু একটা সমস্যা আছে। টেবিলে দেখলো একটা সুন্দর মলাটের একটা ডায়েরি। অন্যের ডায়েরি পড়া নিষেধ। তারপরও খুলে ফেলল। যে লোক তার ছবি অনুমতি ছাড়া নিজের কাছে রাখতে পারে তার ডায়েরি পড়া যেতেই পারে। কয়েকটি পাতা উল্টিয়ে দেখল সুন্দর অক্ষরে লেখা-
শিমু প্রতিদিন তোমাকে কতবারই দেখি, কতবারই সামনে এসে চলে যাও। ভাবি তোমাকে বলেই ফেলি না বলা কথা। কিন্তু বলতে পারি না। শুধু ভাবি বে যে বলব, তোমাকে ভালোবাসি।
এরপর আর পড়তে পারল না। শিমু মনে মনে বলল, আমিও যে তোমাকে ভালোবাসি, পাভেল ভাই। কিন্তু তুমি কিছু না বললে আমি কি করে বলব। দোতলার সিড়িতে নামতে গিয়ে মুখোমুখি হল পাভেলের সাথে। একরাশ লজ্জা এসে ভর করল ওর মুখে। মাথা নিচু করে এক দৌড়ে চলে এল বাড়িতে।
ছাদের উপর বসে উলের কাপড় বুনছে পাভেলের মা, তিনি দেখলেন শিমু বের হয়ে গেল। শিমুকে তার অনেক ভালো লাগে। মনে মনে ভাবল এমন একটি মেয়ে যদি তার পুত্রবধূ হয় মন্দ হয় না।
প্রতিদিনের মতো রাত্রে শিমু পড়তে বসেছে। সদর দরজার আওয়াজে বুঝল বাসায় বাবা এসেছে। প্রতিদিনই এমন সময় আসে। তাই ওদিকে মন না দিয়ে পড়তেই লাগল। হঠাৎ মায়ের চিৎকারে ভয় পেয়ে মায়ের ঘরে চলে গেল। বাবা বিছানায় শোওয়া। মা পাখা দিয়ে বাতাস করছে। শিমু মায়ের হাত থেকে পাখা নিয়ে বাতাস করতে লাগল।
কথায় কথায় যা জানল তা বড় ভয়ঙ্কর। বাবার চাকরি চলে গেছে। অফিসে দলাদলি ছিল তারই রেশারেশিতে ষড়যন্ত্রে করে সহকর্মীরা মিলে চোর সাজিয়ে চাকরি থেকে অব্যহতি দিতে বাধ্য করেছে।
কুকথা যেটা সত্যি হোক মিথ্যা হোক ছড়াতে সময় নেয় না। পরদিন পাড়ায় রটে গেল, অফিসে চুরি করায় চাকরি চলে গেছে এরফানের। পাড়ায় যেটুকু সম্মান ছিল তাও হারালো শিমুর পরিবার। আর এদিকে পাভেলের মা বিকেলে যে ভাবনা ভেবেছিল তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল দিল। মন থেকে মুছে ফেলল। এমন একটা চোরের পরিবারে সে আত্মীয় করবে না।
পাভেলের ডিগ্রি পরীক্ষা শেষ। পরীক্ষার সিট পড়েছিল তার মামার বাড়ির কাছে তাই এই কয়দিন মামার বাড়িতে থেকে পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষার কারণে এতো ব্যস্ত ছিল যে কোন দিকে খেয়াল রাখতে পারেনি।
আজ যখন পরীক্ষা শেষ হল তখন তার হাতে প্রচুর সময়। অনেকদিন হল শিমুকে দেখে না। বাবার চাকরি চলে যাওয়ার পর শিমু আর পাভেলদের বাসায় আসেনি। শুধু পাভেলদের বাসায় না, আর কোথাও যায়নি। বাসায় বসে থেকেছে সারাদিন, বাইরে আসলে সবাই এটা ওটা জিজ্ঞেস করে। যেন বাবার না ওরই চাকরি চলে গেছে।
শিমু আজ অনেকদিন পর স্কুলে যাওয়ার জন্য বের হল। কিছু দূর যাওয়ার পর পেছন ফিরে দেখে পাভেল আসছে। শিমু চায় না পাভেলের মুখোমুখি হতে। একটু দ্রুত পা চালাচ্ছে যাতে ধরতে না পারে। খুব আশা করছে যদি একটা রিক্সা আসে। উঠে যেতে পারবে। ভাগ্য খারাপ হলে যা হয়। পাভেল পা চালিয়ে এক সময় শিমুর কাছে চলে এল।
শিমু কেমন আছো? অনেক দিন দেখা হয়নি তোমার সাথে, পরীক্ষা ছিল কাল রাতে বাসায় আসলাম।
ভালো আছি ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন? পরীক্ষা কেমন হল। মনে মনে ভাবছে বাবার বিষয়ে পাভেল কি কিছুই জানেনা? কখন যে বলে বাবার কি হয়েছিল। একটু ভাবনায় পড়ে গেল, মুখে কিছু বলল না।
পরীক্ষা ভালোই হয়েছে। অনেক চিন্তা মুক্ত এখন আমি।
পাভেল ভাবল, আজই কিছু বলতে হবে। ও ঐদিন ইচ্ছে করে ডায়েরি আর ছবিটা ওভাবে রেখে বাইরে গেছে, যাতে শিমু দেখে। ও পরে বুঝতে পারে যা ভাবছে তাই ঠিক। শিমু সব দেখেছে।
পাভেল মুখটাকে গম্ভীর করে বলতে শুরু করল, শিমু কিছু কথা ছিল তোমার সাথে।
শিমুর অন্তর আত্মা ছ্যাত করে উঠল। যে ভয় এতক্ষণ ছিল তাই বুঝি সত্যি হবে।একটু কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, বলুন ভাইয়া।
শিমু আমি ভালো নেই। ভালো ছিলাম না। এই কয়দিন তোমাকে দেখিনি। কিছুই ভালো লাগছে না, তোমাকে অনেক দিন থেকে কেন যেন ভালো লাগতে শুরু করেছে। সেই ভালো লাগা আজ ভালোবাসায় পরিনত হয়েছে। তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, তবে সত্যিই বলছি তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। এই পর্যন্ত বলে পাভেল শিমুর মনোভাব বোঝার জন্য থামলো।
শিমু বুঝতে পেরেছিল পাভেল তাকে একদিন না একদিন একথা বলবেই। মনে মনে সে ভীষন খুশি। তার এই ১৬ বছরের জীবনে কেউ এমন করে বলেনি। কিন্তু বাইরে প্রকাশ করল না।
ভাইয়া তা কি করে হয়? আপনারা উঁচু তলার মানুষ আমরা নিচু তলার মানুষ।তার উপর যে কাণ্ড ঘটে গেল, তাতে আপনার আমার সম্পর্ক কেউ মেনে নিবে না। তার চেয়ে একা আছি এই বেশ ভাল আছি। অংকুরেই যদি উপরে ফেলা যায় তবে কষ্ট কম ভোগ করতে হবে। তাই বলছি আমাকে ভুলে যান। সেই ভালো হবে।
পাভেল এভাবে প্রত্যাখ্যাত হবে ভাবতে পারেনি। ভেঙ্গে পড়ল কিছুটা। কিছুটা মন খারাপ নিয়ে বলল, হতে পারে আমাদের দোতলা বাড়ি আছে। কিন্তু সে তো আমার না, আমার বাবার, আমার এই আমি। এছাড়া অন্য কোন আর কিছু নেই। তোমাকে আবার ভাবার সময় দিলাম, একটু ভেবে বল।
শিমুকে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পাভেল অন্য পথে চলে গেল। শিমু ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। সেও পাভেলকে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু প্রকাশ করবে কি করে, নিরবে কয়েক ফোঁটা অশ্রু তার চোখ থেকে গড়িয়ে নামলো। এই অশ্রুর কথা কেউ কোনদিন জানতে পারবে না।
শিমু সেই দিনের পর থেকে শুধু পাভেলের কথাই ভেবে যাচ্ছে। সে ভেবেছিল রাস্তায় পাভেলের সাথে যেদিন দেখা হবে সেদিন তাকে বলবে সেও ভালোবাসে। কিন্তু কেন যেন তা আর হচ্ছে না। কি আশ্চর্য অদ্ভুদ ঘটনা। এক দেয়ালের এপাড় ওপাড় দু জনের বাড়ি কিন্তু কেউ কাউকে দেখছে না। শিমু অনেকবার ভেবেছে পাভেলদের বাসায় যাবে। কিন্তু কিসের যেন বাঁধা পায়। হয়ত তার ওখানে যেতে লজ্জা লাগে।
এমন সময় একদিন শিমুর মা তাকে বলল, ভালো করে গোসল করে তৈরি হয়ে নিতে। কোথা থেকে যেন দেখতে আসবে। শিমু বাধ্য মেয়ের মতই তৈরি হয়ে নিল।
শিমুকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে। তার বাবার চোখে- মুখে খুশির আমেজ। পাত্রপক্ষকে যথা সম্ভব আদর যত্নে খাওয়ানো হল। চলে যাওয়ার সময় তারা জানিয়ে গেল মেয়ে তাদের পছন্দ হয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
শিমুর বাবা চিন্তা শুরু করে দিল। মেয়ের বিয়ে বলে কথা, ছেলে পক্ষের বেশি কিছু দাবি নেই। তাও তো কিছু না কিছু দিতেই হবে। তার উপর এতগুলো লোকের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তার খরচ নিশ্চয়ই কম না। এখন চিন্তা হল এত টাকা কি করে যোগাড় করা যায়। দেনদরবার করলে অফিস থেকে কিছু পাওয়া যেতে পারে। এছাড়া তার নিজের নামে কিছু জমা আছে ব্যাংকে। তাই দিয়ে চালিয়ে নিতে হবে, আর যদি কাজ না হয় তাহলে তো বাড়িটা আছেই।
পাভেলও খবরটা পেয়েছে। তার মা তাকে খবরটা দিয়েছে। পাভেলের মা মনে মনে খুশি হয়েছে। ভাবছে ভালোই হল, কদিন যাবৎ লক্ষ্য করছে পাভেল কি যেন ভাবে। মায়ের মন বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তাইতো সে খুশি হয়েছে। ছেলেকে নিয়ে অনেক আশা। সে চায় না শিমুর জন্য তার ছেলের জীবন নষ্ট হয়ে যাক। খবর শুনে পাভেল বেশ কিছু সময় চুপ করে থাকল। কি যেন ভাবল বলে মনে করল। মৃদু কণ্ঠে জানতে চাইল, কোথায় বিয়ে হচ্ছে, ছেলে কি করে?
বিয়ে হচ্ছে ইসলামপুর, ছেলে নাকি ব্যাংকে চাকরি করে।
মুখে শুষ্ক হাসি রেখে পাভেল বলল, ভালোই হবে মা, মেয়েটি বড় ভালো, সে সুখেই থাকবে।
মা ছেলে দুজনই জানে দুজনের মাঝে কি চলছে। একই ঘটনায় একজন সুখী, একজন দুঃখী। কিন্তু ভঙ্গি করছে কিছুই হয়নি। সংসারে এমন কিছু ব্যাপার থাকে যা সবাই জানে কিন্তু না জানার একটা মুখোশ সব সময় মুখে এঁটে থাকে। এটাই নাকি নিয়ম।
কাল শিমুর গায়ে হলুদ। তাদের সব আত্মীয় স্বজন আসতে শুরু করেছে। বাড়ির সবখানেই উৎসবের আমেজ। বিকেলের দিকে আসলো শিমুর ছোট মামা ও তাদের ছেলে মেয়ে। শিমু এতক্ষণ এদের জন্যেই অপেক্ষা করছিল। তার মামাত বোন আঁখির সাথে তার খুবই ভালো সম্পর্ক। দুইজন দুই জায়গায় থাকলেও চিঠিতে যোগাযোগ আছে। চিঠি লিখে শিমু পাভেলের সব কথা জানিয়েছে। পাভেলকে কি পরিমান পছন্দ করে, ভালোবাসে। কিন্তু এও জানিয়েছে সামনাসামনি কোন দিন বলতে পারবে না, পাভেলকে সেও ভালোবাসে। হয়ত বিয়ের পর সংসারের চাপে সব ভুলে যাবে। কিন্তু কোন একদিন মনে পড়বে পাভেল নামের কেউ একজন ছিল, সেদিন নিরব কান্না ছাড়া আর কিই বা করার থাকবে।
আঁখি বলল, ভুল করিস না শিমু, তুই পাভেল ভাইকে আজই জানা, তুই ওকে ভালোবাসিস। তারপর দেখ কি হয়। ও যদি তোকে এখনই বিয়ে করতে চায় তবে তুই রাজি হয়ে যাবি। তোদের ব্যাপারে যা করার সব আমি করব।
ওড়না দিয়ে আপাদমস্তক খুব ভালো করে ঢেকে শিমু বের হল বাসা থেকে। সন্ধা হয়েছে কিছুক্ষণ হল। রাস্তার বাতি মিটি মিটি জ্বলে অন্ধকারকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এর মাঝে শিমু সিড়ি বেয়ে দোতলায় পাভেলের ঘরে চলে এলো।
সারাদিন নানান ভাবনা ভেবে বিকেলের দিকে একটু ঘুমিয়েছিল পাভেল। সন্ধের পরও ঘুম ভাঙ্গেনি। শিমু দেখে পাভেল ঘুমাচ্ছে। একবার ভাবল ফিরে যায়। কিন্তু পরে ভাবল না, আজ আর ফিরে যাওয়া না। আজ কিছু একটা ফয়সালা করতেই হবে। মৃদু স্বরে পাভেলকে ডাকলো।
পাভেল প্রথমে বুঝতে পারেনি কে ডাকছে। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারে কণ্ঠটা কার। হুড়মুড়িয়ে বিছানা ছাড়ে পাভেল। শিমু এখন এখানে? কিছুই বুঝতে পারছে না।
পাভেল বিছানায় বসে একটু তোতলানো কণ্ঠে বলল, তুমি এখন এখানে?
শিমু ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে ইশারা দিল আস্তে কথা বলার জন্য। পাভেল গলার স্বর নামিয়ে বলল, তুমি এখন এভাবে এখানে। কাল না তোমার বিয়ে।
শিমু মুচকি হেসে বলল, বিয়ে তো হয়ে যাচ্ছে তাই তো একটু বেড়াতে এলাম। ভাবলাম এতোদিন ধরে আপনাদের সাথে চেনাজানা, হয়ত কোথায় না কোথায় চলে যাবো, তাই দেখা করতে এলাম।
পাভেল রাগী রাগী মুখে বলল, কাজটা কি ঠিক হল, এই অবস্থায় কেউ দেখলে?কেন এসেছো দুঃখের বোঝা বাড়াতে? দেখতে এসেছো তোমার বিয়ের সংবাদ শুনে আমি কেমন আছি? তবে দেখ ভালো করে, আমি কেমন আছি।
রাগ করেন কেন পাভেল ভাই, দুঃখ দিতে আসব কেন? একটু পুরনো দিনের গল্প করতে এলাম। আচ্ছা পাভেল ভাই আপনি আমাকে কতটুকু ভালোবাসেন?
একটা ছেলে আরেকটা মেয়েকে যতটা ভালোবাসতে পারে আমি তোমাকে তারও বেশি ভালোবাসি। কিন্তু এসব শুনে কি করবে? তোমার দুইদিন পরই বিয়ে, আজ এসব কথা মানায় না।
আচ্ছা পাভেল ভাই আমি যদি আপনাকে ভালোবেসে থাকি, তবে এখন কি আমাকে বিয়ে করতে পারবেন?
পাভেল নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না, ভাবল স্বপ্নে কেউ বলছে। শিমুকে ধমক দিয়ে বলল, কি সব আবোল তাবোল বকছ। যাও বাসায় যাও।
আবোলতাবোল না ভাইয়া। সত্যি বলছি, আপনি যদি আমাকে একবারও বলেন চলো আমরা বিয়ে করি, তাহলে আমি আপনার কথায় রাজি হব। দেখুন না পরীক্ষার করে।
ঠিক আছে আমি রাজি। পাভেল কৌতূহলভরা কণ্ঠে বলল।
শিমু পাভেলের দুটি হাত ধরে কাঁদ কাঁদ স্বরে বলল, আমি আপনাকে সত্যি ভালোবাসি। আমাকে আপনার আপন করে নিন। চলুন আমরা বিয়ে করি। দয়া করে ফিরিয়ে দিবেন না।
ভালোই চলছিল ভালোবাসা বাসি, মাঝখানে মা এসে দাঁড়ালো। কঠিন স্বরে পাভেলের দিকে ফিরে বলল, ওর হাত ছাড়। আমি তোদের সব কথা শুনেছি। আমি চাইনা ঐ মেয়ে আমার ছেলের বউ হোক।
কিন্তু মা আমি ওকে ভালোবাসি, আর ওকেই বিয়ে করব।
তবে আমার বাড়িতে থাকা হবে না। এই বাড়ির বাইরে গিয়ে যা খুশি তাই কর।
বেশ তাই হবে। আমি চলে যাচ্ছি। তুমি থাক তোমার বাড়ি নিয়ে। কথা কয়টি বলে পাভেল শিমুর হাত ধরে অজানার পথে পা বাড়ালো।
কিন্তু কোথায় যাবে তারা? পাভেলের মা প্রথমটায় ভেবেছিল তার কথা শুনে পাভেল শিমুকে ছেড়ে দিবে কিন্তু পাভেল তার বিশ্বাসে আঘাত করে শিমুকে নিয়ে বাড়ী থেকে বের হয়ে গেল। তার নিজ হাতে গড়া ২২/২৩ বছরের ছেলেকে ২২/২৩ দিনেই শিমু নিজের করে নিল? তাই তো তিনি অধিক শোকে পাথর হয়ে গেল।
পোস্ট অফিসে পাভেলের একটা একাউন্ট ছিল। তাতে বেশ কিছু টাকা জমা ছিল, পাভেল আসার আগে এই একাউন্টের চেক বইটা নিয়ে এসেছিল। আর যখন শিমু বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে তখন মামাত বোন দুইটা গয়না পড়িয়ে দিয়েছিল। এই মোটে তাদের সম্পদ।
ঘর থেকে বের হয়ে পাভেল প্রথমে তার বন্ধুর বাসায় গিয়ে উঠে। সেখানে রাত্রিটা থেকে তারা যাত্রা করে সখীপুরে দিকে। সেখানে পাভেলের এক বন্ধু থাকে। সেখানে তারা বিয়ের কাজটাও শেষ করে ফেলে।
পাভেলের মা রাজিয়া সুলতানা তার বড় মেয়ে রুনাকে পাভেলের এই ব্যবহারের কথা জানিয়ে পত্র লিখলেন। পত্র পেয়ে পরের দিনই চলে এসেছে। তার স্বামী শরিফ খান ছুটি নিয়ে এসেছে। এই সপ্তাহ ছুটিতে থাকবে।
রুনা বিস্তারিত শুনে কান্না জুড়ে দিল। সঙ্গে তার স্বামী ছিল। সে বড় জামাই তার দিকে কারও কোন নজর নাই। কি যেন ভেবে শরীফের ঠোঁটের কোন একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। তিনি পাকা ব্যবসায়ী লোক।
তার নিজের একটা ব্যবসা আছে। যেটা দেখে রুনার বাবা রুনাকে বিয়ে দেয়। ইদানিং তার ব্যবসা মন্দ যাচ্ছে। তাতে ভাড়া বাসায় থাকায় মুস্কিল হয়ে যাচ্ছে। তিনি মনে মনে ছক এঁকেছেন। শ্যালক যতদিন না আসে ততদিন এই বাসায় থাকা যাবে। তাহলে প্রতিমাসে বাসা ভাড়ার টাকাটা বেঁচে যাবে। তিনি আদুরে গলায় বলল, চিন্তা করবেন না আম্মা, সব ঠিক হয়ে যাবে, আর আমরা তো আছিই।
দেখতে দেখতে চারটি বছর পাড় হয়ে গেল।
এ চার বছরে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে।
রুনা স্বামী নিয়ে বাবার বাড়ী স্থায়ী নিবাস গড়েছে। শিমু আর পাভেল কারও পরিবারের কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না, পারলে ছায়া মাড়িয়ে চলে। পাভেল একদিনের জন্যেও আর বাড়ি আসেনি। কেউ তাদের খোঁজও করেনি।
শিমুর বাবা মামলা করতে চেয়েছিল কিন্তু অনেক ভেবে বিরত আছেন। একে তো তিনি মেয়ের বাবা, তার উপর আর্থিক অবস্থা মামলা করার মতো না।
পাভেলের মা এ কয় বছরে বেশ বুড়িয়ে গেছে। ছেলের কর্মকাণ্ডে সে প্রচণ্ড বিরক্ত। কেউ তার কথা বললে প্রচুর রাগ হয় কিন্তু একা থাকলে মন কেমন করে। বড় মেয়ে তার সংসার পেতেছে এই বাসায়। মন খারাপ থাকলেও মেয়ের জন্য কিছু বলতে পারে না। পাছে কিনা কি বলে তার মেয়ে। আজকাল তিনি কেন যেন মেয়েকে একটু একটু ভয়ও পায়। তার মনে হয় পাভেল চলে যাওয়ায় এদের হয়ত ভালোই হয়েছে। কথা বার্তায় সেই রকমই মনে হয়। ভয় হয় কখন না আবার তাকেই বিতাড়িত হতে হয়।
পাভেল চার বছর পর তার নিজের শহরে ফিরে এল। একটা চাকরি পেয়েছে, পোস্টিং নিজ শহরে। সাথে অব্শ্য একটা ছোট্ট বাসা। তাতে কোন অসুবিধা হবে না। তিনজন মাত্র মানুষ তারা সে স্ত্রী ও দুই বছরের পুত্র পলাশ। এই চার বছরে কত কষ্টই না করতে হয়েছে। চাকরি পাওয়ায় খুব খুশি হয়েছে। এই চারবছর কি কষ্টই না করতে হয়েছে। সারাদিন প্রাইভেট পড়িয়ে তার উপর চাকরি খোঁজা। সখীপুরের মতন জায়গায় অবশ্য কম টাকাতেই সংসার চালানো যায়। তাই অবশ্য বেশি অসুবিধা হয়নি।
প্রথম মাসে তেমন একটা কষ্ট হয়নি। সেখানে তার এক বন্ধু থাকে, তার বাড়িতেই বউ নিয়ে উঠেছিল। এরপর চার-পাঁচটি টিউশনি পেয়ে এক রুমের বাসা নিয়ে দুজনে সংসার পাতলো।
বিয়ের দুই বছর পর তাদের ছেলে হল। দায়িত্ব বেড়ে গেল কয়েকগুণ। চারদিকে শুধু ইন্টারভিউ দিতে লাগলো। অনেক কষ্টের পর এই চাকরি।
নতুন চাকরি, নতুন দায়িত্ব, তাই ব্যস্ত থাকতে হয় বেশি। এরই মাঝে একটু সময় বের করে পাভেল শিমুকে নিয়ে বেড়াতে বের হয়। বেড়ানোর তেমন কোন জায়গা নেই এই শহরে। তাই তারা ঘন্টা হিসাবে রিক্সা ঠিক করে নেয়।
রিক্সা এ রাস্তা ও রাস্তা ধরে চলতে চলতে এক সময় শিমুদের বাসার সামনে দিয়ে চলতে লাগলো। শিমুর চোখ ছলছল হয়ে গেল। পাভেলের দিকে তাকালো। পাভেলও তাকালো শিমুর দিকে। এক সময় পাভেল শিমুকে বলল, যাবে?
চারবছর পর তারা এই বাড়িতে এলো। কোন পরিবর্তন হয়নি। শিমু যে ঘরে পড়তে বসতো তার সামনে ফুলগাছে প্রচুর ফুল ফুটে আছে। শিমু-পাভেল ছোট গেট ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল।
শিমুর মা রান্না ঘরে বসে রান্না করছিল। আওয়াজ পেয়ে উঠোনে এসে দাঁড়ালো। প্রথমে চিনতে পারেনি। সন্ধা হওয়ায় আলো কম, তার উপর শাড়ি পড়েছে শিমু, শাড়িতে সব মেয়েকে ভিন্ন লাগে। আগের চেয়ে বেশ ফর্সা হয়েছে, একটু যেন মোটাও হয়েছে।
শিমু এগিয়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দেয়। মাও আর কান্না ধরে রাখতে পারে না। কান্নার পাঠ শেষ হলে মা দুইজনকে ঘরে নিয়ে বসায়। এরপর শুরু করল একের পর এ প্রশ্ন।
প্রশ্নের উত্তর পর্ব শেষ হওয়ার পর মা শরবত করে খাওয়ালো। এরপর হালকা নাস্তা।
সন্ধে হয়ে গেছে অনেক আগে এখন রাত্রি হওয়ার পথে, তাই আর দেরি না করে তারা বাসার দিকে রওয়ানা হল।
পাভেলের মা লোক মুখে শুনেছিল তার ছেলে চাকরি নিয়ে এ শহরে এসেছে। আর আজ নিজের চোখে দেখল দোতলার বারান্দা থেকে। শিমু পাভেল হাত ধরে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। তার ছেলে বাড়ির দিকে ফিরেও তাকালো না পর্যন্ত। মায়ের মন অভিমানে ভরে উঠল। এক সময় ভেবেছিল তিনি তার ছেলেকে বাসায় উঠাবে। সেই ভাবনাটা আজ থেকে মন থেকে মুছে ফেলল।
রাত্রি যত গভীর হয়, সকাল ততো এগিয়ে আসে। আবার অন্যভাবে বলা যায় সকাল যত পেরিয়ে যায় রাত ততো গভীরে হয়। শিমু পাভেলের সংসার সুখেই কাটছিল। ছোট ছোট দুই রুমের বাসা। রান্না ঘর বাইরে। ওখানে এই বাসার সবাই রান্না করে।
সুখেই কাটছিল সংসার কিন্তু সুখ বুঝি আর সইল না। পাভেল চাকরি করত এক বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে। এনজিওটা বেশ বড়ই ছিল। কিন্তু লোকাল এই এনজিও এর মালিক পক্ষ বেশি লোভ করতে গিয়ে সবই হারালো, এর প্রভাব পড়ল এনজিও এর কর্মচারীদের উপর। মালিক তো সব হারালো, হারাক, দেশান্তরী হয়ে গেল এটাই বড় সমস্যা, সবাই ধরত মালিককে। কিন্তু সেই মালিক আর দেশেই নেই। ফলস্বরূপ চাকরি হারাতে হল সবার।
চাকরি হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ল পাভেল। এখন সে কিরবে?
শিমু প্রস্তাব দিল পাভেল গিয়ে যদি তার মায়ের কাছে ক্ষমা চায় তবে পাভেলের মা ক্ষমা না করে পারবেই না। কিন্তু পাভেল তার মায়ের কাছে কিছুতেই যাবে না। যা হোক কোন একটা কিছু এখান থেকেই করতে হবে।
এ নিয়ে ঝগড়া বাঁধে দুইজনে। এমন ঝগড়া এর আগে কখনও হয়নি। শিমু বলে পাভেলের জন্যেই এই পরবাস জীবন। পাভেলও কিছু কম যায় না, গলার স্বর উঠিয়ে বলে, তোমার জন্যই এই অবস্থা। সেদিন যদি এইভাবে আমার বাসায় না আসতে তবে আমাকেও আজ সব ছেড়ে একা বাস করতে হত না।
মেয়েদের নাকি প্রধান অস্ত্র কান্না। শিমু সেই অস্ত্র প্রয়োগ করে বলল, শুধু তুমি তোমার মাকে ছেড়ে এসেছ, আমি কিছু ছেড়ে আসিনি? আর যদি আমার কারণেই তোমার এত কষ্ট, এত দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাহলে তুমি থাক আমি চললাম। আমি চাইনা আমার জন্য এত কিছু হোক।
পলাশ এই ঝগড়ার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারছে না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে একবার বাবার দিকে একবার মায়ের দিকে চেয়ে থাকে। এভাবে সে কখনও বাবা মায়ের ঝগড়া দেখেনি। কিছু বুঝতে না পেরে তার স্বরে কান্না শুরু করে দিল।
কেটে গেল বেশ কিছুটা সময়। শিমু এর মাঝে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছে। ছোট একটা ব্যাগ সাথে নিয়েছে আর কিছু নেই। পলাশকে সাথে নিয়ে বের হয়ে গেল বাসা থেকে। পাভেল শুধু চেয়ে চেয়ে দেখল, বাঁধা দিতে পারল না। কিংবা দিতে চাইলো না।
আজ পনের দিন হয়ে গেল শিমু বাবার বাড়ি এসেছে। মা তাকে কতভাবে যে বোঝালো তার ইয়াত্তা নেই। কিন্তু শিমুর বড় অভিমান। যতক্ষণ না পাভেল তাকে নিতে আসবে ততক্ষণ সে যাবেনা। অবশ্য খবর পেয়েছে পাভেল ওদের বাসায় এসেছে।
বোনের সাথে সম্পর্ক তেমন ভাল না পাভেলের। সারাক্ষণ শুধু তর্ক শোনা যায়। পাশাপাশি বাড়ি, না চাইলেও সব শোনা যায়। হায়রে নিয়তি পাশাপাশি বাড়িতে দুইজন বাস করে তাও কেউ কারও দেখা পায় না।
দুজনেরই সমান তালে অভিমান। পাভেল তবু বাইরে যায় কিন্তু শিমু ঘর থেকে বের হয় না বললেই চলে। সারাক্ষণ শুধু ঘরের ভেতর বসে থাকে।
ঘরে বসে থেকে আর নানান টেনশনে শিমুর শরীর দুর্বল হয়ে পড়ল। আর দুর্বল শরীরে বাসা বাঁধতে লাগল রোগের জীবাণু। বেশ কিছুদিন কেমন যেন মাথা ব্যাথা করায় একদিন ডাক্তার দেখায়। ডাক্তার কিছু পরীক্ষা করতে দিয়ে দেখে যা ভেবেছিল তাই, মাথাতে একটা ছোট টিউমার আজ অবহেলায় অনেক বড় হয়ে গেছে। অপারেশন করার মত কোন অবস্থাই নেই।
পাভেলও খবরটা পেয়েছে। কয়দিন যাবৎ ভাবছে একবার শিমুর কাছে যায়। আবার ভাবে কি করে যাবে ওখানে। চাকরি করছে না। শিমুকে কি খাওয়াবে। আর যদি বাসায় আনতে চায় তাহলে মা থাকতে দিবে না। তাই একটা কিছু ব্যবস্থা করে শিমুর ওখানে গিয়ে শিমুকে নিয়ে আসবে। তাই সারাদিন কাজের খোঁজে ঘুরে শহরময়। একটুও বিশ্রাম নেই। সকালে বের হয় ফেরে রাতে।
আজ শিমুর অসুখ বেশি হয়েছে। শিমুর মা থাকতে না পেরে পাভেলদের বাসায় গিয়েছিল। পাভেলের মা অপমান করেছে যা তা বলে। সব অপমান সহ্য করে শিমুর মা পাভেলকে খবর দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে এসেছে।
রাত্রি দশটায় পাভেল বাসায় ফিরে রোজকার মতোন কিছু খেয়ে শুয়ে পড়েছে। তার মা আর কিছু জানায় নি। আজ একটা কাজ করে বেশ কিছু টাকা হাতে এসেছে। ভাবল পাভেল কাল শিমুকে দেখতে যাবে, যা থাকে কপালে।
গভীর রাতে হঠাৎ কান্নার শব্দে ঘুম থেকে জেগে উঠে পাভেল। কোথা থেকে আওয়াজটা আসে বুঝতে পারে না। দরজা খুলে বের হয়ে আসে বারান্দায়। বাহিরে এসে বুঝতে পারে কান্নার শব্দটা শিমুদের বাড়ি থেকেই আসছে। আর আওয়াজটাও কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। কেউ চিরতরে হারিয়ে গেলে মানুষ এভাবে কাঁদে। তবে কি? পাভেল আর ভাবতে পারে না।
শার্ট গায়ে চাপিয়ে সে ওদিকে ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। ও যত আগায় ততই কান্নার শব্দ স্পষ্ট হয়।।
টাংগাইল
২৬/০১/২০০৪
২৬/০১/২০০৪