Friday, November 10, 2017

নিলাম

আজ আজমীর জন্মদিন।

আজমীর গৃহ শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পেয়েছি কয়েক মাস হলো। পাঁচবছরের ছোট্ট মেয়েটিকে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে। তাকে ক্লাশের পড়ায় সহযোগীতা করার জন্য আমাকে রাখা হয়েছে। সন্ধের পর এক ঘন্টা করে পড়ানোর কথা। কিন্তু সেই এক ঘন্টা কখনও কখনও দুই ঘন্টাতেও শেষ হতে চায় না।

ভার্সিটিতে প্রথম বর্ষে পড়ি। ঢাকায় এসেছি বেশি দিন হয়নি। আত্মীয়তার সুবাধে এই টিউশনিটা পেয়েছি। এই টিউশনির টাকায় হলের খাওয়া খরচের অনেকটাই মিটে যাচ্ছে। তাই কষ্ট হলেও, সময় বেশি লাগলেও টিউশনিটা করতে হচ্ছে।
আজমীকে পড়ানো যথেষ্ট কষ্টের। জানিনা আজমীর স্মৃতিশক্তি কি দিয়ে পরিচালিত হয়। আজ যদি A, B, C শিখিয়ে পরের দিন বলি এগুলো কী তাহলেই শেষ। সব ভুলে গেছে। আবার নতুন করে শেখাতে হয়। এভাবেই চলছে।

বুঝতে পারছি না শিক্ষক হিসেবে আমি ব্যর্থ না শিক্ষার্থীর মনোযোগ কম। প্রতিদিন একই জিনিস শেখাই পরের দিন আবার ভুলে যায়, আবার নতুন করে শেখাতে হয়। উপকরণ দিয়ে চেষ্টা করেছি তাও কাজ হয়নি। মনেই রাখতে পারে না।

আজমী ওর নানার বাড়ি থাকে। ঠিক আপন নানার বাড়ি না, ওর মাকে এই বাড়িতে ছোট বেলায় পালক নিয়ে এসেছিল। ওর মাকে নানা-নানী বড় করে বিয়েও দিয়েছে। তবে লেখাপড়া শেখাতে পারেনি। এসএসসিও পাশ করাতে পারেন নি। অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ওর মার পড়ায় মন বসেনি। মাথায় নাকি ধরেনি, মুখস্ত করতে পারতো না কিছু। অগত্যা বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। বর প্রবাসী, একমাত্র মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়িই থাকে।

আজমীর নানা গফুর চৌধুরী চাকরি করে মৎস অফিসের বড় পদে। ঢাকায় মৎস অফিসেই বসে। নাতনীকে তিনি অনেক বেশি আদর করে। মনে হয় এত আদরেই আজমীর পড়া লাটে উঠার উপক্রম হয়েছে।

আজ সেই আজমীর ছয় বছর পূর্ণ হল। তার জন্য জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান। সারা বাড়ী সাজানো হয়েছে লাল, নীল লাইটে। এক নজর দেখে মনে হবে বিয়ে বাড়ি। আমাকে সকাল সকাল আসতে বলা হয়েছে। গেস্টদের দেখাশোনাসহ আরও কিছু কাজে লাগতে পারব বলে।

বন্ধুবান্ধবদের সাথে পরামর্শ করে অনেক ঘুরে নিউমার্কেট থেকে একটা টেডি বেয়ার কিনলাম। যা পেয়েছিলাম গত মাসের টিউশনিতে তার প্রায় অর্ধেকটাই চলে গেল। কিছুই করার নেই। এতবড় বাড়ির অনুষ্ঠানে যা তা নিয়ে গেলে তো হয় না।

যথা সময়ে উপহার নিয়ে আজমীদের বাড়ি গেলাম। গেট দিয়ে যেতেই নাকে খাবারের গন্ধ এসে ধাক্কা দিল। অনেকদিন ভালমন্দ খাওয়া হয়না, বাড়ি যাওয়াও হয় না ভালমন্দ খাওয়াও হয় না। গন্ধে চনমনে হয়ে গেল মনটা। উপরে উঠলাম। আত্মীয়রা আসতে শুরু করেছে। আজমীর নানা আমাকে সোফা বসতে বলে আজমীকে ডেকে দিল। আজমী আজ পরির মতো একটা ড্রেস পড়েছে। মানে ড্রেসের পেছনে পাখার মতো আছে। আমাকে দেখে ফোকলা দাতে হাসি দিয়ে কাছে এসে বসল।

ফোকলা দাতে বলতে শুরু করল, মিস মিস তুমি এসেছ? আজ না আমি কেক কাটবো। আশে পাশে কয়েকজন আত্মীয় বসেছিল। আজমীকে সংশোধন করে দিয়ে বলল, মিস না বল স্যার। ওর নানা কাছেই ছিল, সেই ব্যাখ্যা দিয়ে বলল, না না আজমী মিসই বল, উনি তো মিসই।

ও আচ্ছা আপনাদের তো বলাই হয়নি, আজমী আমাকে মিস বলে ডাকে। ওর স্কুলে বাইরের কাউকে দিয়ে পড়ানোর নিয়ম নেই। তবে গোপনে সবাই বাইরের কাউকে দিয়ে পড়ায়। আজমীর নানার ভাবনাটা এমন, আজমী যদি আমাকে মিস বলে ডাকে, তাহলে সুবিধা হবে। ক্লাশে যদি কখনও বলেও দেয় মিস এভাবে পড়ায় তাহলেও তারা বুঝতে পারবে না কার কথা বলা হচ্ছে। আমার বিষয়টা পছন্দের না, তবে কিছুই করার নেই। এই সময়ে টিউশনিটা অনেক দরকার ছিল।

আজমীর সাথে গল্প করছি, ভালই সময় কাটছে। আশেপাশে কে কি পোশাক পড়লো, কে কি নিয়ে আলোচনা করছে তারও দিকে নজর রাখছি, ধীরে ধীরে অতিথির পরিমান বাড়তে লাগল। আজমীও চলে গেল ওর রুমে। অতিথিরা আসছে, কিছুক্ষণ পরই কেক কাটা হবে, আজমী সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াতে লাগল।

দশ পাউন্ডের কেক কাটল আজমী। তার আগে মোমবাতি নেভাতে ভুল হয়নি। যদিও আমার এসব পছন্দ না তবে কিছুই করার নেই। সবাইকে কেক কেটে খেতে দেওয়া হলো।

কেক খেতে খেতে শুরু হল পার্টি। ঘরোয়া পার্টি তাই ঘরোয়া শিল্পীর মুখেই শোনা গেল একের পর এক সংগীত। এরই মাঝে গান শোনালো নাজু। আজমীর সম্পর্কে খালামনি লাগে। বয়স কতই আর হবে, ১২-১৩। কণ্ঠ শুনে আমি অবাক। এত সুন্দর কণ্ঠ কারও হয়? তবে শিল্পীকে দেখে আমি অবাক হলাম আরও বেশি। বইয়ের ভাষায় ওদের বলে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু আর আমরা মুখে বলি প্রতিবন্ধী, গ্রামে থাকে। পড়ে ক্লাশ এইটে। ছাত্রীও নাকি ভালো। তবে কেন যেন শংকিত হই। জানিনা ওর ভবিষ্যৎ কি?

সংগীতানুষ্ঠান শেষে খাওয়ার পালা। এত কিছু রান্না হয়েছে যে, আমি অনেক কিছুর নামই জানিনা। কয়েকটা আইটেম দেখলাম তা কি করে খেতে হয় তাও জানি না, আড়চোখে দেখলাম আর সবাই কীভাবে খায়। দেখে দেখে আমি ওভাবেই খেতে লাগলাম। ওহ খাবারের কি স্বাদ! মনে হল অনেকদিন মুখে লেগে থাকবে।

রাত বাড়ছে, ভাবলাম এবার চলে যেতে হবে। আজমীর নানাকে বলতেই বলল, আরে এখনই যাবে কেন? অনুষ্ঠানের আরও বাকি আছে। শেষ করে যাবে। ড্রাইভার সবাইকে পৌঁছে দেবে। এর আগে ধনীদের কোন অনুষ্ঠানে থাকার সৌভাগ্য হয়নি, তাই বুঝলাম না আর কি বাকি থাকতে পারে, খাওয়াতো শেষ এরপর আবার কি থাকবে? কৌতূহল হল, হলে রাতে ফেরা নিয়ে প্রবলেম নেই, যখন তখন যে কেউ ঢুকতে পারে। তাই আর ভয় কি?
ড্রয়িং রুমে সবাই গিয়ে বসল। এবার একে একে আজকের অনুষ্ঠানে পাওয়া উপহারের মোড়ক খোলা শুরু হলো। এতবড় অনুষ্ঠান, এত ধনী ধনী আত্মীয় স্বজন, সবাই দেখি ছোট ছোট উপহার এনেছে। সেই উপহারের মোড়ক খোলা হচ্ছে।

তবে মোড়ক খোলা হচ্ছে ভিন্নভাবে। মোড়ক খোলার আগে অনুমান করতে বলা হচ্ছে, যে ভেতরে কি আছে। তবে যে দিয়েছে তার পরিবার বাদে বাকি যে কেউ অনুমান করতে পারবে। যদি অনুমান মিলে যায় তাহলে সেই উপহার চলে যাবে যে অনুমান করছে তার কাছে।

একটা করে মোড়ক খোলা হচ্ছে আর সবাই অনুমান করতে চাচ্ছে। তখন আজমীর উপর ভার দেওয়া হল কে অনুমান করবে তা নির্বাচন করতে। আজমী যাকে দেখাচ্ছে সেই অনুমান করতে পারছে।

একবার আমার দিকেও আঙ্গুল তুলল আজমী। আমার কোন ধারণাই নেই কি হতে পারে উপহার। এতক্ষণ দেখে কেন যেন একটা অনুমান করতে ইচ্ছে হল। উপহারের সাইজ দেখ বলে ফেললাম কি হতে পারে। কেন যেন মনে হলো ওটাতে একটা পুতুল আছে। এবার খোলা হল। সবাই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় আছে, কি হয় না হয় সেটা দেখতে। অতঃপর খোলা হলে দেখা গেল অনুমান ঠিক।

জীবনে এত খুশি কখনও হইনি। এতগুলো লোকের মাঝে এভাবে উপহারটা পেয়ে যাব শুধুমাত্র অনুমান করে তা ভাবতেও পারিনি। অনুমান করে বলায় উপহারটা আমার হয়ে গেল। আমি উপহারটা আজমীকে দিয়ে দিলাম। সবাই খুশি হয়ে হাতে তালি দিতে লাগল। আমার দেখাদেখি পরে সবাই এটাই করতে লাগল।

এভাবে অনুমান করে করে সব উপহার খোলা হল। কেউ পারল কেউ পারল না।অনেক মজাই হল। তবে মজা যে আরও আছে তা কে জানত? উপহার খোলা শেষের দিকে। শেষ উপহার খোলার আগে আলাদা ঘোষনা এল। এটা অনুমান করতে হবে না, এটা নিলামে তোলা হবে। যে সর্বোচ্চ ডাক দিতে পারবে সেই পাবে এটা। এ কথায় গুঞ্জন শুরু হল। কে পেতে পারে, কি থাকতে পারে এতে? এবার শুরু হল এই অনুমান। তবে এই অনুমানে কোন পুরস্কার নেই।

প্রথমে ডাক দিল আজমীর মামা সম্পর্কে একজন। একশত টাকা থেকে শুরু হলো। একশত এক একশত দুই একশত তি...

তিন বলার আগেই আরেকজন বলল দেড়শ। ও কি? এক লাফেই দেড়শ? এবার সবাই নড়েচড়ে বসল। এবার আরেকজন বলল তিনশত। ডবল হয়ে গেল? পাশ থেকে একজন বলল, ছয়শত। কি বিষয় বুঝতে পারছি না, এভাবে বাড়ছে কেন? কি আছে ওতে?

কী থাকতে পারে ওতে, আমি ভাবতে ভাবতেই দেখি নিলামের ডাক হাজারের ঘরে উঠে গেছে। বারশত, চব্বিশত এভাবে কখন যে কয়েক হাজারে চলে গেছে বুঝতেই পারলাম না। বাড়ছে তো বাড়ছে। তবে এবার যারা ডাকছে তাদের চিনতে পারছি না। আলাদা বসে ছিল তারা।

তাদের ডাকের পরিমান এবার আধা লাখ থেকে পুরো লাখে চলে গেল। এক লাখের পর আর কেউ ডাকতে সাহস করল না। যিনি লাস্ট ডাক দিল তার দিকে নজর দিলাম। বেশভুষা দেখে বোঝা যায় ব্যবসায়ী। সারাদিনে অনেকের সাথেই পরিচয় হয়েছে। তাদের একজনকে ধরলাম ঐ ব্যক্তির পরিচয় জানতে। শুনলাম সে একজন বড় ব্যবসায়ী। মাছের কয়েকটি আড়ৎ আছে। আজমীর নানার বন্ধু। মাছের আমদানী রপ্তানী ব্যবসার সাথে জড়িত কয়েকজনের একজন সে।

অবশেষে নিলাম শেষ হলো। ঐ ব্যবসায়ী হাসি মুখে সাথে থাকা ব্রিফকেস থেকে গুণে গুনে এক লাখ টাকা আজমীর নানাকে দিয়ে বিনিময়ে উপহারটি বুঝে নিলেন। সবার আগ্রহ ঐ প্যাকেটে কি আছে সেটা দেখার। অবশেষে সবাই মিলে দেখতে চাইল কি এমন দামী জিনিস ওটা যার দাম এত টাকা হলো।

উপহারের মোড়ক খোলা হলো। ভেতর থেকে ক্রিস্টালের শোপিস বের হলো। অসাধারণ দেখতে। তবে এর দাম কখনোই এক লাখ টাকা হবেনা। আমি ভাবলাম, আহারে বেচারা জিদ করতে গিয়ে এক লাখ টাকাই জলে ফেলল।

অনেক রাতে আজমীর নানা তার গাড়ির ড্রাইভারকে বলল সবাইকে যেন তাদের ঠিকানায় পৌঁছে দেয়। আমিও সবার সাথে চলে এলাম। আমাকে হলের সামনে নামিয়ে দিয়ে ড্রাইভার চলে গেল। রুমে গিয়ে দেখি রুমমেট বড়ভাই তখনও জেগে। তাকে কাহিনী শোনালাম। বলতে বলতে ঐ লোকের বোকামীর কথা মনে করে আমার হাসি পাচ্ছিল। কিছুটা হেসেও নিলাম।

বড়ভাই দেখি মুখ গম্ভীর করে বসে আছে। মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে তার দিকে তাকাতে বড়ভাই বলল, চালাক লোককে বোকা বলাও বোকামি। আমি বললাম, চালাক কে?

বড় ভাই তখন বলল, আরে বুঝলে না, সবার সামনে দিয়ে কত সহজে ঘুষ দিল সেটাও বুঝলে না? উপহার কেনাটা একটা বাহানা, আসলে এর আড়ালে লেনদেন হল ঘুষ। হয়ত কোন সুবিধা নিতে এটা করা হলো। তোমরা দেখলে কিন্তু বুঝতেও পারলে না। এখন বল কে বোকা?

আমিও ভাবতে বসলাম আসলেই কে বোকা?

রংপুর
২ নভেম্বর, ২০১৬
আপনার মন্তব্য লিখুন

ফেসবুক লাইক ও শেয়ার