Friday, June 19, 2020

অনন্ত লতা

অনন্ত চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল। নটরডেম থেকে পাশ করার পর ভর্তি নিয়ে বেশি চিন্তিত হয়নি, বিশ্বাস ছিল ভালো কোথাও ভর্তি হতে পারবে। বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষা দিয়ে দেখল বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বুয়েট, মেডিক্যাল কোনটাতেই হল না তখন কিছুটা চিন্তিত হয়েছিল, তবে ঢাবিতে ভর্তি হয়ে সেই চিন্তা দূর হলো। সে সাইন্স নিয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে, তবে ঢাবিতে বিজ্ঞানের কোন বিষয়ে ভর্তি হতে পারলো না, সাবজেক্ট হিসেবে যা পেল সেটায় অনেকে ভর্তিই হতে চায়না।

বাংলা বিষয়টা অনন্তের অনেক ভালো লাগত, কিছুটা কবি কবি ভাব তার মাঝে ছিল, তবে পরিবারের চাপে কখনও মুখ ফুটে বলা হয়নি। বাংলা বিষয়ে পড়বে এটা নিয়ে ওর বাবার প্রথমে কিছুটা আপত্তি ছিল। তবে আর যেহেতু বিকল্প নেই, ঢাবিতে পড়া একটা গর্বের বিষয় তাই বাবা আর আপত্তি করেনি। অনন্তও খুশি এখানে ভর্তি হতে পেরে।

অনন্ত গল্প-উপন্যাস পড়তে ভালোবাসে। বাসায় বিশাল এক লাইব্রেরি আছে, তার বাবা প্রচুর বই পড়তেন, বাবার স্বভাবটা অনন্তও ধরে রেখেছে। সময় পেলেই বই পড়তে চেষ্টা করে। তাই ঢাবিতে বাংলা বিষয়টা পাওয়ায় সবার চেয়ে বেশি খুশি হয়েছে অনন্ত। তবে মনের ভাবটা বাড়ির কাউকে বুঝতে দেয়নি।

এলাকার বড় ভাইদের ধরে মুহসীন হলের গণরুমের সিটে উঠতে পেরেছে। গণরুম সম্পর্কে কোন ধারণা তার আগে ছিল না, হলে কিছু রুম থাকে যেগুলোকে গণরুম বলা হয়। একই রুমে ১৭ থেকে ১৮ জন বসবাস করে। কোন রুমে একটা দুইটা চৌকি থাকতে পারে, কোথাও থাকে না, যে যার মতো তোশক বিছিয়ে শুয়ে পড়ে। তবে সেটাও হয় পালাক্রমে। মাঝে মাঝে কয়েকজন রাতে লাইব্রেরিতে কাটিয়ে দেয়, তবে তা পালাক্রমে। এই রুমে কখনও রাত নামে না, সারা রাত আড্ডা চলেই, এর মাঝেই কেউ ঘুমায় কেউ পড়ার চেষ্টা করে।

কখনও কখনও পানি চুক্তিতে তাশ পেটানো হয়, যে হেরে যাবে তাকে পানি খেতে হবে। প্রথম যখন অনন্ত খেলার নিয়মটা শুনে তখন মনে হয়েছিল খারাপ না, হারলে পানি খেতে হবে, ক্ষতি কি? খেলতে গিয়ে দেখলো শেষের দিকে পানি খাওয়া কী কষ্টের! তাই সে চেষ্টা করত জিততে। কখনও কখনও হেরেও যেতে হতো।

গণরুমে প্রথম কয়েকদিন খুব কষ্ট পেয়েছিল, এভাবে কখনও থাকেনি। অনন্তের গ্রামের বাড়ি সখিপুর, তবে এসএসসির পরই ঢাকায় চলে আসে ও। মেস বাড়ি ভাড়া করে থাকতো। একরুমে দুইজন থাকার অভ্যাস হয়ে গেছিল, এখানে এসে এতজন একসাথে প্রথম দিকে কেমন যেন কষ্ট লাগত। তারপর যখন দেখল একেকজন একেক এলাকা থেকে এসেছে, একেকজনের সংস্কৃতি একেক রকম। তখন অনন্ত আবিস্কার করল গণরুমের প্রত্যেক শিক্ষার্থী একেকটা বই, কত গল্পে সাজানো সবার জীবন। যেন একেকজন একেকটা রবীঠাকুরের গল্পগুচ্ছ। অনন্ত চেষ্টা করতো সবার সাথে মিশতে, সবার ভেতরের কথাগুলো নিয়ে আসতে। এক অদ্ভুদ কারণে সবাই সাথে সহজেই মিশত ও নিজেদের অনেক কথাই বলে দিত।

গণরুমে থাকতে গেলে হালকা রাজনীতি করতে হতো। অনন্তের কণ্ঠ অনেক ভরাট, হলের ডিবেট ক্লাবের সদস্য হয়ে প্রায়ই বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক করে। হলের অনেক অনুষ্ঠানে বা ভার্সিটির অনুষ্ঠানে হলের পক্ষ হয়ে বিতর্ক করে। বিতর্ক করতে গেলে প্রচুর পড়তে হয়। অনন্তের সুবিধাই হয়েছে। তার খুব পড়ার শখ।

হলের বড় ভাইদের কাছে গেস্টরুমে তার আলাদা একটা পরিচিতি আছে। প্রায় দিনই সন্ধেয় হাজিরা দিতে হয়, মিছিল থাকলে সকালেও বসতে হয়। মাঝে মাঝে মিছিলে যেতে হয়। বড় ভাইদের কাছে আশ্বাস পেয়েছে, খুব শীঘ্রই তাকে রুমে সিট দেওয়া হবে। ইদানিং অনন্তেরও গণরুমে ভালো লাগে না। কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। প্রাইভেসি বলতে কিছু নেই। মাঝ রাতে লিখতে ইচ্ছে করলে বা কোন কবিতার বই নিয়ে পড়তে বসতে চাইলে তার উপায় নেই।

আজ মাহবুব স্যার চমৎকার একটা লেকচার দিয়েছে। মধ্য যুগের কাব্যে প্রেম। স্যার লেকচার শেষ করে অনন্তের হাতে কিছু নোট দিয়েছে। সবাইকে বলেছে ফটোকপি করে নিতে। সবাই এখন অনন্তকে ঘিরে আছে। অনন্ত হিসেব করে দেখেছে প্রতিজনের দশটাকা করে লাগবে। একটা কাগজে কে কে টাকা দিচ্ছে তার হিসেব নিচ্ছে আর টাকা পকেটে ভরছে।

সবাই দশটাকা করে দিচ্ছে আর অনন্ত পকেটে টাকা ভরছে। এই সময়ে হঠাৎ তার সামনে একটা ৫০০ টাকার নোট দেখতে পেল। বিরক্ত ভরা চোখ নিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখে তাদের ক্লাসের চুপচাপ মেয়েটা ৫০০ টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়েছে। ১০ টাকার জন্য ৫০০ টাকা, এত টাকার ভাংতি পাবে কোথায়? ৫০০ টাকা অনেক টাকা, অনন্ত প্রতিমাসে ৫০০ টাকা দেয় হলের ডাইনিংএ দুই বেলা খাওয়ার জন্য। সবাই যে টাকা দিয়েছে তাতে বড়জোর তিনশ টাকার মতো হবে। তার পকেটে মেরে কেটে ৫০ টাকা আছে। আরও ১৫০ টাকা হলে লতাকে ভাংতি দিতে পারবে। লতার দিকে হাসি ভরা মুখ নিয়ে বলল, তোমারটা পরে নেই। সবার টাকা আগে নিয়ে নেই, ভাঙ্গতি নেই এত টাকার। ভাঙ্গতি হলে তোমারটা নিচ্ছি। লতা একটু সময় নিয়ে ভেবে বলল, কত বাকি আছে। অনন্তও ঝটপট হিসেব করে বলল, ১৫০ টাকা। লতা বলল, ঠিক আছে সাড়ে তিনশই দাও। বাকি যে কয়জনের টাকা দরকার ছিল ওদের কাছ থেকে আর নিও না, ওদেরটা আমিই দিয়ে দিচ্ছি।

দুএকজন আপত্তি জানিয়েছিল তবে বেশিরভাগই হই হই করে উঠলো। আজ একটা মিনি পিকনিক হয়ে যাবে। দেড়শ টাকায় প্রায় সবাই মিলে একটা করে সিংগারা হয়ে যাবে। কতদিন সবাই মিলে আড্ডা দেওয়া হয়না, আরও দুএকজন জোগাড় হলো যারা এই মিনি পিকনিকে চাঁদা দিবে। লতা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল, তার বাসায় ফেরার তাড়া আছে। লতার চলে যাওয়া দেখে অনন্তের অল্প অল্প মন খারাপ হল কি? অনন্ত ভেবে পেল না লতার চলে যাওয়ায় অনন্তের মন খারাপ হলো কেন?

লতা ক্লাসের সবচেয়ে চুপচাপ মেয়ে। বন্ধু বান্ধব খুব একটা নেই, ক্লাসে এসে একপাশে চুপচাপ বসে ক্লাস করে, আবার ক্লাস শেষে বাসায় চলে যায়। দেখতে ছিমছাম সুন্দর সাজানো গোছানো। প্রতিদিন পরিপাটি করে সেজে আসে, সাজটাও হয় ছিমছাম, উগ্র সাজে কখনও ভার্সিটিতে আসেনি লতা। ইদানিং অনন্ত ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে লতার দিকে তাকিয়ে থাকে। তবে খুব সাবধানে, সবার নজর এড়িয়ে তাকায়, পাছে আবার সবাই হাসাহাসি করে তাই সবার সামনে তাকাতে ইতঃস্তত বোধ করে।

কয়েকদিন হল ক্লাসে আসে না লতা, তবে এখন অনেকেই ক্লাসে আসে না। এখন তারা দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আজও লতাও আসেনিও, লতা ছাড়া অনন্ত কেমন যেন একা একা বোধ করে। কারও কাছে খোঁজও নিতে পারে না। বিকেল বেলায় বের হলো নিউমার্কেটের দিকে।

নীলক্ষেতের পুরনো বইয়ের দোকানে ঘুরতে তার বেশ লাগে। কত নামিদামী বইয়ের সমাহার। পুরনো বইয়ের দোকানে অনেক সময় মূল্যবান বইও পাওয়া যায়, দামেও সস্তা। বই দেখতে দেখতে সামনের দিকে হাঁটছিল অনন্ত, হঠাৎ চোখ গেল ফুটপাতের দোকানে। ফুটপাতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বেগম মেরী বিশ্বাস, বিমল মিত্রের অসাধারণ উপন্যাস। ক্লাসে এই বইয়ের কথা বলা হয়েছিল, ইতিহাসের ইতিহাস জানতে বইটা নাকি খুব কাজে লাগে। নতুন বইটি কিনতে গেলে অনেক টাকার মামলা, আর বাজারে পাওয়াও দুস্কর। প্রায় সাড়ে নয়শত পাতার বইটা ফুটপাতে বিকাচ্ছে খুব সস্তায়। কিছুক্ষণ দামদর করে বুঝতে পারল ৭০ টাকাতেই কিনতে পারবে। দাম দেওয়া শেষ করার পর হাতে নিতে পাশ থেকে কে যেন বলল, আমাকেও পড়তে দিও। চোখ তুলে তাকাল অনন্ত, দামদর করতে গিয়ে এতক্ষণ খেয়াল হয়নি, লতা দাঁড়ানো আছে পেছনে সাথে আরেকটা মেয়ে।

লতাই পরিচয় করিয়ে দিল ছোট বোনের সাথে। বন্যা, এবারই মাত্র জাবিতে ভর্তি হয়েছে। ওর ভর্তি নিয়ে দৌড়াদৌড়িতে একয়দিন আসতে পারেনি। বই কেনাকাটার পর তিনজনে চাঁদনি চক মার্কেটের সামনের দোকানে বসেছে। এখানে লাচ্ছিটা ভালো বানায়। দুই বোন মার্কেট করতে করতে ক্লান্ত। ওরাই অফার দিয়েছে লাচ্ছি খাওয়ানোর। অনন্ত না করেনি। কতদিন পর লতার সাথে দেখা, এই সময়টুকু আর মিস করতে চায়নি। এতদিন ভার্সিটিতে কী কী মিস করেছে তার ফিরিস্তি দিচ্ছে অনন্ত। লতা বরাবরের মতো চুপচাপ শুনে যাচ্ছে। একসময় কথা বলতে বলতে অনন্ত দেখল লতা তার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে, আবার মনে হল এটা হয়ত দেখার ভুল।

একসময় সময় ফুরিয়ে গেল। তিনজন দুই দিকে রওয়ানা হলো, তবে অনন্ত মনটাকে আর নিজের দিকে নিয়ে আসতে পারল না। মনে হল, মনটা লতার দিকে চলে যাচ্ছে। কেন এমন হয়? এর একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।

পরদিন শাড়ী পরে লতা এলো ভার্সিটিতে। ক্লাস শেষে অনন্তকে ডেকে বলল, এ কয়দিন আসতে পারিনি, পড়ায় কিছু গ্যাপ হয়েছে। এই কয়দিন যা পড়ানো হয়েছে তার বিষয়ে অনন্ত কি সহায়তা করতে পারে? সামনে পরীক্ষা, কিছু নোট পত্রও দরকার।

অনন্ত কি বলবে ভেবে পেল না, এত সুন্দর প্রস্তাব কখনও না করা যায়? তারা গিয়ে বসল মল চত্বরে। এ কয়দিন কী কী পড়ানো হয়েছে। কোনটার নোট কোথায় পাওয়া যাবে, কোন কোন বই পড়তে হবে সবটাই একে একে বলে গেল অনন্ত। পড়ার বিষয়ে অনন্ত সিরিয়াস। মাঝে একবার বলা শেষ করে থেমে সামনে তাকিয়ে ছিল, দেখেছে লতা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বলা শেষে আবার সামনে তাকিয়ে দেখে একইভাবে তাকিয়ে আছে লতা।

অনন্ত যে অনেকক্ষণ হলো বলা থামিয়ে দিয়েছে লতার সেদিকে মনই নেই। সে এখনও একইভাবে তাকিয়ে আছে অনন্তের দিকে। অনন্ত কি করবে ভেবে না পেয়ে তাকিয়ে রইলো লতার দিকে। আজ মেয়েটিকে অন্যরকম লাগছে। শাড়িতে মেয়েদের কেমন যেন আলাদা লাগে, লতা তেমন সাজেনি, শুধু আকাশী কালারের শাড়িই পরেছে। তাতেই কেমন যেন অচেনা লাগছে। মেয়েটা অনেক সুন্দর। অনন্তের মা যেমনটা বলেন সুন্দর একটা মেয়েকে বউ বানিয়ে ঘরে নিয়ে আসবে, মেয়েটা সেই রকমই সুন্দর। ইচ্ছে করে মাকে ডেকে এনে দেখাক, এই মেয়েটাকে পছন্দ কিনা। অনন্ত তার মায়ের চোখ দিয়ে দেখে, হ্যাঁ এইতো সেই মেয়ে।

হঠাৎ মুখ ফসকে বলে ফেলে, মা এমন একটা মেয়ের কথা সব সময় বলত। লতা আশে পাশে তাকিয়ে দেখে কোন মেয়ে নেই, তাহলে অনন্ত কার কথা বলল? অনন্ত প্রথমে এড়িয়ে যেতে চাইলেও লতা নাছোড়বান্দা। না বলিয়ে ছাড়বেই না। কথাগুলোর অর্থ কী জানতেই হবে।

বাধ্য হয়েই বলল, তার মায়ের কথা, মা ছোট বেলা থেকে বলে আসছে, বড় হলে অনন্তের জন্য একটা বউ আনবে, অনেক সুন্দর একটা মেয়েকে বউ বানাবে। ছোট বেলা থেকে কথাগুলো শুনতে শুনতে একটা মেয়েকে কল্পনা করত অনন্ত। আজ লতাকে দেখে মনে হয়েছিল হয়ত এটাই সেই মেয়ে। তাই কথাগুলো বলা।

বলা শেষে ভেবেছিল সরি বলবে, কিন্তু লতার দিকে তাকিয়ে থ হয়ে গেল। মুগ্ধ দৃষ্টিতে লতা তাকিয়ে আছে অনন্তের দিকে। মুগ্ধ চোখেই বলল, তুমি যেমন সুন্দরের কথা বলছ আমি তো এত সুন্দর না। তোমার মা কী আমায় পছন্দ করবে?

অনন্ত যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল। ও ভাবেনি এত সহজে লতা ওর সাথে জরিয়ে যাবে। লতার দিকে তাকিয়ে অনন্ত বলল, লতা তুমিও কী আমার মত ভাবছ? আমরা কি পারি সারাটা পথ একসাথে চলতে?

লতা কোন মতে বলতে পারলো, তুমি সাথে থাকলে আমি হেঁটে যেতে পারি অনন্তকাল।

সেই থেকে শুরু, দুজনের একসাথে পথ চলা। ডিপার্টমেন্টের সবাই মোটামুটি জেনে গেল তাদের দুজনের কথা। আজ মোর্শেদ স্যারের ক্লাস ছিল দুপুরের পর। স্যার রোমান্টিকতা নিয়ে অনেক গল্পই বললেন, একপর্যায়ে অনন্তের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার নামে একটা ফুলের নাম আছে জানো?

অনন্ত ঠিক জানেনা, কি বলবে ভেবে পেল না। স্যার উত্তর না পেয়ে বলল, তবে শুধু অনন্ত দিয়ে ফুলের নামটা সম্পূর্ণ হয় না, সাথে একটা লতাও থাকতে হয়। ফুলটা হলো অনন্তলতা। এটাকে ইংরেজিতে মেক্সিকান ক্রিপার, কোরাল ভাইন, বি বাশ অথবা সান মিঘুয়েলিট ভাইনও বলা হয়। এটি মেক্সিকোর স্থানীয় প্রজাতি।

অনন্ত লতার আরেক নাম জানো? আবার প্রশ্ন ছুড়ে দিল স্যার। এটারও উত্তর জানা নেই, তাই চুপ করেই রইল অনন্ত। স্যার নিজেই একটু পরেই বলল, প্রেম লতা। এই লতা শাদা রঙেরও হয়। আর অনন্ত লতার বীজ পানিতে ভেসে অনেক দূরে বাহিত হতে পারে। সাবধান থাকবে, যেন ভেসে না যাও। তোমাকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন।

দেখতে দেখতে অনন্ত লতার প্রেমের এক বছর হয়ে গেল। তারা এবার তৃতীয় বর্ষে পা দিয়েছে। বছরের শুরুতেই তারা নতুন একজন শিক্ষক পেল, তাদেরই ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই তারামিয়া। খুব মেধাবী হিসেবে নামডাক ছিল, পাশ করার পর এখানেই শিক্ষক হিসাবে পরীক্ষা দেয়। রাজনীতিও করত। মেধাবী না রাজনীতি ঠিক কোন কারণে শিক্ষক হলো সেটা আজও কেউ জানে না।

দেখতেও সুন্দর হওয়ায় অনেকে তার চারপাশে ঘুরতে লাগলো। অনন্ত কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছে লতা তারা স্যারের দিকে একটু বেশিই তাকিয়ে থাকে। ভালো করে নজর দিয়ে দেখেছে, ঐ একই মুগ্ধতা নিয়ে তারা স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবল এই নিয়ে লতার সাথে কথা বলতে হবে।

রাতটা যেন কোনভাবেই কাটে না, কখন সকাল হবে, কখন লতাকে বলতে পারবে, স্যারের সাথে এভাবে হেসে হেসে কথা বললে তার কতটা কষ্ট হয়। লতা কি কিছুই বুঝে না? তাহলে কেন এমন করে?

লতা ভার্সিটিতে আসতেই অনন্ত লতাকে নিয়ে টিএসসির দিকে হাঁটতে লাগল। লতা বলেছিল ক্লাসটা করে তার পর বের হতে কিন্তু অনন্ত শুনেনি। টিএসসি মোটামুটি ফাঁকাই বলা যায়। ডিপার্টমেন্টগুলোতে ক্লাস হচ্ছে, তাই এখানে ভীড় কম। অনন্ত কথা বলার আগেই লতা বলতে শুরু করলো। বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। আগামী সপ্তাহে ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে। লতা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছে। মা বাবা কিছুতেই শুনবে না। ছেলে ব্যবসায়ী, ঢাকায় বাড়ি গাড়ি আছে। লতা অনন্তের কথা বলেছে। বাবা উত্তরে বলেছে ওর কি ঢাকায় বাড়ি আছে? তোরে বিয়ে করে রাখবে কোথায়?

অনন্ত ভেবেছিল কী, হয়ে গেল কী? লতার দিকে তাকিয়ে বলল, তাহলে আমাকে কী করতে হবে?

লতা অনন্তের দিকে তাকিয়ে বলল, ঢাকায় বাড়ি করতে হবে। আমি হয়ত বিয়েটা একবছর আটকাতে পারব, এর মাঝে কিছু একটা করতে হবে, না হলে কী যে হয়। এদিকে বন্যাও বড় হয়ে যাচ্ছে। ওরও বিয়ের বয়স হয়ে যাচ্ছে। মা বলেছে লতার বিয়ে না দিয়ে বন্যার বিয়ে দেওয়া যাবে না, তাই তাড়াতাড়ি বড় মেয়ের বিয়ে দিতে চাচ্ছে। বড় মেয়ে রেখে ছোট মেয়ে বিয়ে দিবে না।

লতা অনন্তকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বাড়ি চলে গেল। অনন্ত দেখল সামনে ফাঁকা ময়দান, কোথাও কেউ নেই, সে কী করবে এখন? ঢাকায় বাড়ি করা কি এতই সহজ।

তার খুব কান্না পেল। মায়ের সাথে সবই শেয়ার করে অনন্ত। হলের সামনের দোকান থেকে মাকে ফোন দিল, ভেবেছিল কিছুই বলবে না, কিন্তু মা কি করে যেন সবই বুঝে গেল, একের পর এক প্রশ্ন করে ভেতরের খবর সবই বের করে আনলো। ছেলেকে সহজ করতে হেসে দিয়ে বলল, এটা কোন ব্যাপার হলো? ঢাকায় বাড়ি করতে কত লাগে? শোন, আমার বাবা আমাকে একটা জমি দিয়ে গিয়েছিল। তুই হয়ত জানিস না, ঐ জমিটা এমনিতেই পতিত পড়ে আছে। সখিপুরের পাহাড়ে। তবে ঐদিকে অনেক শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। সেদিন শুনলাম ঐ দিকের জমির দাম বাড়ছে। তুই খোঁজ নিয়ে দেখ, জমির দাম কেমন।

অনন্ত যেন আত্মায় পানি ফিরে পেল। সেও শুনেছে সখিপুরের ঐদিকে জমির দাম হঠাৎ অনেক বেড়ে গিয়েছে। ওদিকে তার মামাদের অনেক জায়গা জমি আছে। তবে তাদেরও যে আছে সেটা জানতো না। মায়ের কাছ থেকে সবটা জেনে নিয়ে মামাত ভাইকে ফোন দিল। বিস্তারিত জানানোর পর মামাত ভাই কিছু একটা হিসেব করে বলল, বর্তমান বাজার ধরে জায়গাটার দাম হবে প্রায় কোটি টাকার মতো। অনন্ত হিসেব শুনে কি বলবে ভেবে পেল না। মাকে আবার ফোন দিয়ে বিস্তারিত জানালো।

অনন্ত একসাথে দুইটা কাজ শুরু করলো, সখীপুরের জমিটা বিক্রি করার ব্যবস্থা সাথে ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট কেনা। একজায়গায় বিক্রি করে আরেক জায়গায় কেনা। লতাকে সবটা জানিয়েছে। কিন্তু কেমন যেন লতার মাঝে সেই উচ্ছাসটা ফিরে পায়নি। লতাকে বাড়ি থেকে তাগাদা দিচ্ছে। এবার পাত্র ভার্সিটিতে শিক্ষকতা করে। আগের বাড়ি গাড়িওয়ালাকে বিদায় দিতে পেরেছে। এবার এসে জুটেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তবে কে বা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লতা তা বলেনি, অনন্তও শুনতে চায়নি, কী হবে জেনে? লতার বোনও বড় হয়ে যাচ্ছে, তাকেও বিয়ে দিতে হবে। মা বাবা আর কতদিন বসে থাকবে? বাড়ি না হয় হচ্ছে, পড়াশোনা শেষ করেই যে চাকরি পাবে অনন্ত তার গ্যারান্টি কি? লতার সাথে সাথে বন্যার জন্যও পাত্রপক্ষ আসতে চায়, বন্যা দেখতেও লতার চেয়ে ভালো। তাই মা-বাবা চাচ্ছেন তাড়াতাড়ি বিয়েটা হয়ে যাক। অনন্ত সবটা শুনে বলেই ফেলল, বন্যাটা না থাকলে আজ এই অবস্থা হতো না। শুনে লতা বলল, তবে কি বন্যাকে মরে যেতে বলো?

অনন্ত কী করবে ভেবে পাচ্ছে না, বন্যার বিষয়টাও ভাববার মতো। সকাল বেলায় ক্লাসে গিয়ে দেখে লতা আসেনি। কোন মতে ক্লাস শেষ করে বাইরে থেকে লতার বাসায় ফোন দিল অনন্ত। তখনই দুঃসংবাদটা শুনতে পেল। শুনে আর এক মূহুর্ত দেরি করেনি, দ্রুত ছুটে গেল লতার বাসায়।

বন্যা প্রতিদিনের মত ঢাকা থেকে সাভারের বাসে উঠেছিল ক্লাস করবে বলে। বাস আমিন বাজার ব্রিজের উপর গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যায় নদীতে। ডুবুরী নামানো হয়েছিল, দুই ঘন্টার তল্লাশী শেষে খুঁজে পায় বেশ কিছু লাশ। সেখানে বন্যার লাশও পাওয়া গিয়েছে। বন্যা নেই এটা ভাবতেও কষ্ট হয়, তরতাজা একটা প্রাণ এভাবে ঝরে যাবে কে জানতো।

শোকটাও একসময় শক্তিতে রূপান্তরিত হয়, লতার পরিবারও শোক সামলাতে পেরেছে। তবে লতা আগের মতো অনন্তকে সময় দেয় না। অনন্তের মাঝে মাঝে মনে হয় লতা এড়িয়ে চলছে। একদিন সামনাসামনি বসে সরাসরি প্রশ্ন করলো, তুমি কি আমাকে এড়িয়ে চলতে চাইছ? তাহলে বলে দিতে পারো। এভাবে কষ্ট দেওয়ার চেয়ে একেবারে কষ্ট দাও সেটাই ভালো।

লতা অনন্তের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার কেন যেন মনে হয় বন্যার মৃত্যুর জন্য আমরাই দায়ী। তুমি-আমি বারে বারে বলেছি, ওর জন্য আমাদের বিয়েটা হয়ত হবে না, তাই হয়ত বন্যা অকালে চলে গেল। যখনই আমি তোমাকে ভাবতে চাই তখনই ও সামনে চলে আসে, আর আমাকে বলে, আপু তুই তো এটাই চেয়েছিস, আপু তুই সুখে থাক তাই আমি আর তোমাকে ভাবতে চাইনা। অনন্ত আমাকে ক্ষমা করে দিও। আজ থেকে আমাদের পথ ভিন্ন। কথাটা বলে লতা আর দাঁড়ায়নি।

অনন্ত আর জোর করেনি, কী হবে জোর করে? লতা প্রথমে বলল, ঢাকায় বাড়ি চাই। সেটাও সামনের মাসে পেয়ে যাবে। এরপর বলল, ছোট বোনকে বিয়ের জন্য তাড়াহুড়া করছে সেই বোনও মারা গেল। তাহলে এখন বাঁধা কিসের?

এরপর কেটে গেল অনেকদিন, অনন্ত আর লতাদের ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। দুজনই ভালো ফলাফল করেছে। লতা বিয়ে করেছে এক ব্যবসায়ীকে। অনন্ত চাকরি নিয়েছে ব্যাংকে, সংসারও শুরু করেছে। লতার চেয়ে কোন অংশে কম না। একয়দিনে বেশ আপনও করে নিয়েছে। অনন্ত ঢাকার বাসায় বসে মাঝে মাঝেই ভাবে, কেন এমন হলো। লতার প্রথম কথা ছিল ঢাকায় বাড়ি নেই বাড়ি করতে হবে, সেটাও হলো। এরপর বোনের কথা বলে প্রেশার দিল, সেই বোনও মারা গেল, যেখানে কারও হাত নেই। তারপরও দুরে চলে গেল কেন? বন্ধুদের কাছে কানাঘুষায় শুনেছিল তারা স্যারের সাথেও নাকি প্রেম ছিল কয়েকদিন, অবশ্য অনন্তের সাথে ব্রেকআপ হওয়ার পর। তাহলে সেখানেও বিয়ে হলো না কেন?

অবশ্য অনন্তের বাবা বলে, বিয়ে হয়নি এক দিকে ভালোই হয়েছে। লতারা বিহারি। এই দেশে আটকা পড়েছে। এমন ঘরের মেয়েকে তার ছেলের বউ হিসাবে দেখতে হয়নি সেও এক হিসাবে ভালো। অনন্ত খুঁজে পায়না কেন এমন হলো?

মুশফিকুর রহমান
কক্সবাজার
১৬ জুন, ২০২০
আপনার মন্তব্য লিখুন

ফেসবুক লাইক ও শেয়ার