Monday, May 17, 2021

কোরবানি



একে একে দশ বাড়ি একই কথা। পরে আসো, পরে আসো, এখনও ভাগ হয়নি।

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে। কোরবানি করা হয়েছে অনেক আগেই, কারও কারও কুরবানির গরু জবাই করে গোস্ত ভাগও হয়েছে, কারও গরুর কিছু অংশ বাড়িতে নিয়েও গেছে, বাইরে মাথা, হাড়, ভুরি এসব কাটাকাটি চলছে।
ময়না তার ছোট ছেলেকে নিয়ে বের হয়েছে। শেষ কবে ছেলেটাকে গরুর গোস্ত খাওয়াতে পেরেছে ভুলেই গেছে। আজ সকাল থেকেই আবদার করেছে গোস্ত খাবে। আজ কোরবানির ইদ, সবাই গরু কিংবা ছাগল কোরবানি দিবে। চাইলে হয়ত এবাড়ি ও বাড়ি থেকে কিছু পাওয়া যাবে।

ময়না সকাল সকাল ছেলেকে নিয়ে বের হয়েছে, পাশের গ্রামে যেতে হবে। এই গ্রামে সবাই তাদের চিনে। একসময়ে তাদের অবস্থা ভালো ছিল। আজ অবস্থা খারাপ হওয়ায় গ্রামে কারও কাছে কিছু চাইতে ইতঃস্তত বোধ করে। ময়নার চাচাত দেবর ভাসুররাও তাদের মানা করেছে এই গ্রামে কারও কাছে হাত পাততে। এতে তাদের মান-সম্মানে বাঁধে।

মানসম্মানে বাঁধার কথাই, যে বাড়িতেই দুইটা গরু কোরবানি হয়েছে, সেই বাড়ির বউ হয়ে গোস্তের জন্য হাত পাতা মানায় না। কিন্তু ময়নার উপায় নেই, এই বাড়িতে দুইটা গরু কোরবানি হলেও তার ভাগে কিছুই হয়ত পড়বে না। ময়নার স্বামী মারা যাওয়ার পর এই বাড়িতে থাকতে দিয়েছে তার সেটাই ভাগ্য। ময়নার স্বামীর ভাগে যে জমিজমা ছিল সেটা তার চিকিৎসার সময়েই শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন এই বসত বাড়ি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। কয়েকটা হাঁস মুরগি, উঠোনে একচিলতে কিছু শাকসবজি আবাদ করে কোন রকমে দিন চলে যায়।

এই বাড়ির উপরেও অনেকের লোভ। সব সময় ফন্দি করে কী করে এই বাড়ি দখল নিতে পারে। ময়নাকে তাই সব সময় সাবধানে থাকতে হয়। এই বাড়ি হাত ছাড়া হয়ে গেলে তার যে সবই যাবে, ছেলেটাকে নিয়ে ভেসে যেতে হবে। বাবার বাড়ীর অবস্থাও তেমন না যে ওখানে গিয়ে উঠবে।

ইদ উপলক্ষ্যে ছেলে মেয়েরা কত সুন্দর সুন্দর জামা কাপড় পড়েছে। ময়নার ছেলের পরনে গত বছর পাওয়া লাল পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবি বেশি পরা হয় না বলে নতুনের মতই আছে। হয়ত আগামী ইদেও এটা পরেই চলে যাবে। বছর বছর তো আর পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে না। বড় বাড়ির তিন ছেলে প্রতি ইদে কিছু না কিছু দেয় সবাইকে, তবে বেশিরভাগ সময় বড়দের জন্য শাড়ি কাপড় দেয়, ছোট বাচ্চাদের জন্য কাপড় কমই দেয়। গত বছর দিয়েছিল এবছর আর দেয়নি।

ময়নার ছেলে এই পাঞ্জাবি পড়েই খুশি। ছেলের খুশিতে মায়ের মুখেও হাসি। আরও ভালো লাগবে যখন কিছু গোস্ত ছেলেকে খাওয়াতে পারবে। দুপুর হয়েছে অনেকক্ষণ পেটে এক দানাও পরেনি, যে বাড়িতেই গেছে সেখানেই সবাই ব্যস্ত। ময়নাও শুধু গোস্তই চেয়েছে। এরচেয়ে যদি বলত কিছু খাবার দিতে তাও হয়ত পেত। ছেলেটার দিকে তাকানো যাচ্ছে না, মুখ কেমন যেন শুঁকনো দেখাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে দেখল সামনে টিউবওয়েল, সেখান থেকে পানি খাইয়ে আবার হাঁটতে লাগলো।

পা যেন আর চলতেই চায় না, আর কত হাঁটতে হবে কে জানে। তার স্বামীটা থাকলে আজ হয়ত এত কষ্ট করতে হতো না। বড় রাস্তায় সিএনজি চালাতো। প্রতিদিন সকালে বের হয়ে যেত। নিজের টাকায় কেনা সিএনজি, অনেক কষ্টে কিছু টাকা জমিয়ে, আর নিজের থাকা একটুকরো জমি বিক্রি করে কিনেছিল। বেশি দিন চালাতে পারেনি।

প্রতিদিনের মতো সেদিনও সকালেই বের হয়েছিল, একবার বের হলে ফিরতে ফিরতে রাত। সারাদিন খোঁজও থাকে না। এ রাস্তা ও রাস্তায় যাত্রী নিয়ে যেত। ওর কোন নির্দিষ্ট রোড ছিল না, যে যেখানে নিয়ে যেত সেখানেই যেত। গ্রামের সবাই ভালোবাসত ওর স্বামীকে, কারও কোন জায়গায় যেতে হলে ওর স্বামীকেই নিয়ে যেত। সাবধানী চালক হিসাবে ভালো নাম ডাক ছিল।
 
তবে সেদিনের বিষয়টা ভিন্ন, সেই যে সকালে গেল ফিরলো রাতে তবে ময়নাতদন্তের টেবিল ঘুরেই ফিরল। বিপরীত দিক থেকে আসা ট্রাকের সামনে পড়ে আর জীবন্ত ফেরা হয়নি। ওর স্বামীর যেদিন থেকে দুরন্ত জীবন স্থবির, সেদিন থেকেই শুরু ময়নার জীবনের গতিময়তা। জানে না কবে শেষ হবে এই ছুটে চলা।

ওর স্বামীর সাথে সিএনজিটাও শেষ হয়ে গিয়েছিল, পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়ে কেনা সিএনজি এমনভাবে ধ্বংস হয়েছিল যে তা পঞ্চাশ হাজার টাকাতেও বিক্রি করা যায়নি। সিএনজি বিক্রি করে যৎসামান্য টাকা আর গ্রামবাসীর সহায়তায় বাড়িতেই কয়েকটা হাঁসমুরগি, অল্প সামান্য জমি বন্ধক নিয়ে সেটাই চাষ করিয়ে কোন মতে দিন পার করে ময়না।‌
 
আজ হাঁটতে হাঁটতে কত কথাই মনে পড়ছে। এই গ্রামে যখন বউ হয়ে এল, এইতো সেদিনের কথা, কত স্বপ্ন ছিল চোখে। ময়নার বাবার বাড়ির অবস্থাও বেশি ভালো না, সেই তুলনায় ওর স্বামীর ঘর কিছুটা স্বচ্ছল। স্বচ্ছলতার চেয়ে বড় কথা ওর মনটা ছিল বিশাল। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে, রাতে যখন বাড়ি ফিরত কখনও খালি হাতে ফিরে নি, ময়নার জন্য ওর ছেলের জন্য কিছু না কিছু নিয়েই আসতো, হোক সেটা যতই কমদামি। ময়না এটা পেয়েই আনন্দে আত্মহারা থাকত।

সুখ কি বেশিদিন সয়? কথায় বলে যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ।

দিন খারাপ হলে কতটা খারাপ হতে পারে টের পায় ময়না। ছেলেটার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না, ছেলেটাকে দেখে কে বলবে আজ ইদের দিন। ছোট বেলায় শুনেছিল ইদ মানে আনন্দ, ইদ মানে খুশি, কোথায় সেই আনন্দ কোথায় সেই খুশি।



খুশি সবার জন্য হয়ত না, খুশি কিছু মানুষের জন্য সীমাবদ্ধ। রাস্তায় দল বেঁধে কত ছেলে মেয়ে হাঁটছে। কত বাহারী রঙ্গের পোষাক পরা। খুশি হয়ত ওদের জন্য। ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখল ওর মনটাও বিষাদে ভরে গেছে। ময়না ছেলেকে কাছে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ছেলেটা এত কষ্টের মাঝে মায়ের এই আদরে দাঁত বের করে খিল খিল করে হেসে উঠল। ময়না তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। এই যে হাসি এর তুলনায় পৃথিবীটাকে তার তুচ্ছ মনে হল।

ছেলে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, মা চল এই বাড়িই শ্যাষ। এইহানে না পাইলে আমরা বাড়িত চইল্যা যামু।

ময়নারও তেমন ইচ্ছে। পা আর চলতে চায় না। কত আর টানবে। সেই তো ছেলের বাপ মারা যাওয়ার পর থেকেই টেনে চলছ। কত আর বয়স হবে, বিধবা জেনে অনেকে বিয়ে করতে চায়। চাওয়ারই কথা, দেখতে শুনতে তো খারাপ না, ওরও ইচ্ছে হয় না সেরকম না, ইচ্ছে হয়ত হয়, তবে ছেলের মুখের দিকে চেয়ে আর কিছু করতে চায় না। ও বিয়ে করলে ছেলেটার কপালে দুর্গতি ঠেকাবে কে?

কে চাইবে এত বড় ছেলেকে আপন করে নিতে। অন্যের বিয়ে করা বউকে হয়ত আপন করতে পারে, তাই বলে অন্যের ছেলেকে কে আপন করতে চাইবে। কে দিতে চাইবে সম্পত্তির ভাগ। এত কিছু ভেবে তাই ময়না আর সামনে আগায় না। কষ্ট না হয় একটু হোক, তবুও...

সামনে বিশাল বাড়ি। তিনতলা বিল্ডিং অনেক দুর থেকেও চোখে পড়ে। বিশাল বাউন্ডারি ওয়ালের একপাশে সুন্দর লোহার গেইট। আজ গেইট খোলা রেখেছে। সামনে অনেক লোকের জটলা। এই বাড়ির তিন ছেলে বড় বড় চাকরি করে। তিন ছেলে মিলে বাবাকে হজ্বেও পাঠিয়েছিল। এই বাড়িতে কুরবানির বিশাল অবস্থা। তিন ছেলে চারটা গরু জবাই করেছে। বিশাল আয়োজন।‌
 
সবার সাথে ময়নাও বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। এই বাড়িতে বিশাল পাতিলে রান্নার আয়োজন করেছে। যারাই গোস্ত চাইতে আসছে তাদের কে বসিয়ে খাওয়াচ্ছে। খাওয়া শেষে আবার একটু করে গোস্তও দিয়ে দিচ্ছে। ময়নার ভালোই লাগল। বাড়িতে রান্নার তেমন মসলা নেই। গোস্ত পেলেও হয়ত স্বাদ করে রান্না করা হতো না। সেই তুলনায় এটাই ভালো।

একপাশে বসার আয়োজন। একসাথে ৩০-৪০ জন বসতে পারে। ময়না দেখল এক কোনায় দুইটা চেয়ার ফাঁকা আছে। ছেলেকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বসে গেল। সবার সামনে প্লেট দিয়েছে। এদিকে শুধু মেয়েরা বসেছে। সাথে বাচ্চারাও আছে। খাবারের তদারকি করছে বাড়ির বড় বউ। দেখে দেখে সবার প্লেটে যাতে ভালো খাবার পরে সেই ব্যবস্থাই করছে।

চার পাঁচ বছর আগেও এখানে এত বড় বাড়ি ছিল না, ভাঙ্গা টিনের চালার ঘর এবছরই তিনতলায় রুপ নিয়েছে। এই চার পাঁচ বছরে তিন ছেলে পরপর ভালো চাকরি পাওয়ার পর যেন হঠাৎ করেই অবস্থা পাল্টেছে। তবে এত তাড়াতাড়ি এত উন্নতি কী করে হল সেটা কেউ কখনও আলোচনায় আনেনি। আনবেই বা কী করে, দানের ক্ষেত্রে বিশাল বিশাল দান তাদের বাড়ি থেকেই আসে। মসজিদ মাদ্রাসা এই এলাকায় যতগুলো হয়েছে সেখানে বড় বড় দান বলতে গেলে এই বাড়ির তিন ছেলেই করে থাকে।

ময়নার ছেলের সামনে আকাঙ্খিত গোস্তের টুকরা। ইশ তার চোখ দিয়ে যেন পানি পড়তে চাচ্ছে। সকাল থেকে না খাওয়া। হাঁটতে হাঁটতে অবশ হয়ে যাচ্ছিল পা। কোন মতে চেয়ারে বসতে পেরেছে। খাওয়ার আগেই গ্লাসের পানি সবটুকু শেষ। হাত বাড়িয়ে গোস্তের টুকরা মুখে নিল। চোখ বন্ধ করতে চিবুতে যাবে তখনই গন্ধটা পেল।

চিবানো বাদ দিয়ে এদিক ওদিকে চেয়ে গন্ধের উৎস খুজতে লাগল। তার যে পরিমান ক্ষুধা লেগেছিল তাতে গন্ধকে পাত্তা দেওয়ার কথা না। কিন্তু এত উৎকট গন্ধ যে মুখের খাবার মুখেই রয়ে গেল গিলতেও ইচ্ছে করছে না। কোন মতে ওয়াক করে গোস্তটা ফেলে দিল। ওর পাশে যারা বসেছিল তাদের এদিকে তাকানোর কোন ফুরসত নেই। ময়নার দিকে তাকিয়ে দেখল তার মাও খাওয়া বন্ধ রেখেছে।

দুজনেই খাওয়া বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। বড় বউ বলল, কী ব্যাপার না খেয়ে উঠছ কেন? ময়না কোন মতে বলল, ছেলেটা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। খাবার নষ্ট করলাম মাফ কইরা দিয়েন।

ময়না সেই ছোট বেলায় একবার পাশের বাড়ির গাছ থেকে পেয়ারা চুরি করে খেতে গিয়েছিল। সে সময়ও এমন গন্ধ পেয়েছিল। পেয়ারা খেতে পারেনি। ওর দাদা বলেছিল অসৎ পথের খাবারে এমন গন্ধ আসে। এমন গন্ধ পেলে ওটা আর হাতেও নিও না।

বড় বউ অনেক করে বলেছিল গোস্তের প্যাকেট নিয়ে যেতে। ময়না নিতে পারেনি, বলতেও পারেনি গোস্ত গন্ধ করে। সব কথা কি সব জায়গায় বলা যায়?

২১ মার্চ ২০২১
কক্সবাজার
আপনার মন্তব্য লিখুন

ফেসবুক লাইক ও শেয়ার