Wednesday, May 20, 2020

ভাগনে

মুহিত যখন এইচএসসি পাশ করলো তখন তার স্কুলের বন্ধুদের মাঝে যারা পড়া চালু রেখেছিল তাদের কেউ অনার্স আবার কেউ ডিগ্রি ২য় বর্ষে পা দিয়েছে। মুহিতের কলেজ পাশ দিতে চার বছর লাগায় এই বিড়ম্বনা।
সে তার কলেজ জীবন শুরু করেছিল নাম করা কলেজের ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল করার মধ্য দিয়ে তবে শেষ করেছিল ফেল করাদের কলেজে ভর্তি হয়ে ফাইনালে অখ্যাত বোর্ড থেকে স্ট্যান্ড করার মধ্য দিয়ে। প্রথম বার এইচএসসি
পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হতে পারেনি, রসায়নে ৯০ পেলেও পদার্থ বিজ্ঞানে ৩৩ তুলতে হিমশিম খেতে হয়েছে। কী এক আজব এক সিস্টেম। একই সাথে পদার্থবিদ রসায়নবিদ গণিতবিদ সবই হতে হবে। ফেল করার পর আবার পরীক্ষা না দিয়ে কলেজটাই বদলে ফেলল মুহিত। এবার ভর্তি হলো কারিগরি শিক্ষায় ব্যবসায় ব্যবস্থাপনায়। ওখান থেকে পরীক্ষা দিয়ে বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলো। অবশ্য কারিগরিতে যারা ভর্তি হয় তাদের বেশির ভাগই ফেল করা শিক্ষার্থী।
উত্থান পতন হয়ত এটাকেই বলে। ফেল করাও শাপেবর হতে পারে মুহিত জীবনে চলার পথে শিক্ষাটা পেল। প্রথমবার পাশ করলে যেখানে যেখানে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার চান্স পেত না এখন সেখানে সহজেই ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারছে।

ভর্তি পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি যে সমস্যা হয় সেটা হলো থাকার সমস্যা। নতুন জায়গায় কোথায় থাকবে সেটাই চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মুহিত চিটাগাং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাবে তবে থাকার জায়গা নিয়ে মোটেই চিন্তিত না। ওখানে তার প্রাণ প্রিয় বন্ধু আছে। চিঠি লিখে জানিয়েছে পরীক্ষা দিতে যাবে, ওখানে থাকার ব্যবস্থা করতে। বন্ধু বলেছে চলে আয় ব্যবস্থা হবেই।

বন্ধু থাকার ব্যবস্থায় কোন কমতি রাখেনি। হলে সিট না পেয়ে মেস বাড়িতে থাকে। একরুমে সে আর তার ক্লাস মেট আরেক বন্ধু। মুহিত যাওয়ায় তাই কোন সমস্যাই হয়নি। দুই জনের রুমে তিনজন থাকা কোন বিষয়ই না।

ভোর বেলায় চিটাগাং পৌঁছাল মুহিত। তার বন্ধু আহাদ বলে দিয়েছে কীভাবে কীভাবে পৌঁছাতে হবে। বাস থেকে নেমে আরও দুয়েক জন সঙ্গী জুটে গেল ভার্সিটিতে যাওয়ার। লোকাল বাসে কোথায় থেকে উঠতে হবে তা আগেই জানিয়েছিল আহাদ। তাই ভার্সিটিতে পৌঁছাতে বেগ পেতে হয়নি।

ভার্সিটিতে রিসিভ করল আহাদ। সারা রাতের ভ্রমণের ক্লান্তি চোখ জুড়ে। পরীক্ষা শুরু হতে আরও দুইদিন তাই বিশ্রাম নিতে বলল আহাদ। শুয়ে পড়লো কথা না বাড়িয়ে, এক ঘুমে বিকেল। আহাদের ডাকে ঘুম ভাঙ্গল। বিকেল বেলায় দুজন মিলে ঘুরতে বের হলো।

চারদিকে পাহাড় তার মাঝে ক্যাম্পাস। আহাদ সব চেনাতে লাগলো, কোনটা কোন ভবন, কোথায় কী হয় এই সব, মুহিতের চোখে তখন স্বপ্ন, ইশ এখানে যদি ভর্তি হতে পারে। কী সুন্দর পরিবেশ! সবুজ গাছপালা তার সব সময়ই প্রিয়। চার দিকের পাহাড় যেন তাকে হাত ছানি দিয়ে ডাকছে।

সকালে আসার পর থেকে একবারও আহাদের রুম মেটের সাথে দেখা হয়নি। ও বাড়ি গেছে কাল সকালে আসবে। দু বন্ধু রাতের খাওয়ার পর অনেক সময় নিয়ে গল্প করলো। প্রাইমারি থেকে একসাথে পড়াশোনা করেছে দুজন, গল্পের অভাব নেই। এর উপর নিজ এলাকার কাউকে পেলে গল্প কি আর থামে?

এলাকার কে কী করছে,কার বাড়িতে বিল্ডিং উঠলো, কার কার বিয়ে হলো, কার চাকরি হলো, কার ব্যবসায় ভালো চলছে, এটা ওটা আরও কত কী জানার থাকে। দুবন্ধু মন খুলে সব আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আহাদ জানতে চাচ্ছে মুহিত বলে যাচ্ছে। অনেকদিন বাড়িতে যাওয়া হয় না আহাদের। তাই এত কৌতূহল।

কাল পরীক্ষা, আলোচনাও বেশি চালানো যায় না, আহাদের কাছে মুহিত জানতে চাইলো পরীক্ষায় কেমন প্রশ্ন হতে পারে। আহাদ উত্তর দিতে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর যে উত্তর দিলো তাতে মনে হলো এড়িয়ে যেতে চাইছে বিষয়টা। মুহিতও কিছু বললো না। ছোট বেলা থেকে ওর আত্মসম্মান একটু বেশিই। ক বলতেই কলিকাতা বুঝতে চেষ্টা করে। তাই এই বিষয়ে আর কিছু বলল না। আহাদের দিকে তাকিয়ে,ওর মুখে কী যেন, মনে হচ্ছে কোন কথা বলতে গিয়েও বলতে পারছে না, যেন দ্বিধাগ্রস্ত নাবিক। ওর দিকে তাকিয়ে মুহিত সামান্য হাসি দিল। এই হাসিতেই মনে হল আহাদ বলার শক্তি ফিরে পেল।

আহাদ মুহিতের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো, আমার রুমমেট সবুজ কাল আসবে। ওর সাথে তোর যখন পরিচয় করিয়ে দেব তখন তোর কথা বলব তুই আমার ভাগ্নে, পরীক্ষা দিতে এসেছিস। তুই আমি একসাথে পড়াশোনা করেছি এটা বলার দরকার নেই।

প্রচুর একটা শক পেলেও হাসি মুখে মেনে নিলো মুহিত। আহাদ খারাপ বলেনি, গ্রাম সম্পর্কে লতায় পাতায় কয়েক পুরুষ সামনের দিকে গিয়ে আবার পিছিয়ে এলে ঐ রকম এক সম্পর্ক পাওয়া যায়,তবে এত বছরে কখনও এই কথা বলেনি আহাদ।

মুহিতের হাসিমুখ দেখে আহাদ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। নিজের কথায় সাফাই গাইতে গিয়ে বললো, আসলে তুই আমার বন্ধু সেটা ঠিক আছে, আবার এখন আমার ২য় বর্ষ প্রায় শেষ। এখন তুই প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষা দিবি। আমার এখানের সব বন্ধু বান্ধব ২য় বর্ষ প্রায় শেষ করতে যাচ্ছি, তাই কিছুটা সমস্যায় পড়তে হবে। আশা করি কিছু মনে করবি না। মুহিদ সহজ গলায় বললো, আরে এটা কোন বিষয় হলো, মামা।

পরদিন সবুজ এলো, আহাদ পরিচয় করিয়ে দিল ভাগ্নে হিসেবে। সবুজও সেই ভাবে যত্ন নিতে লাগলো ভাগ্নের। সবুজই নিয়ে গেল পরীক্ষার হলে, কখন কী লাগবে, না লাগবে সব দিকেই তার খেয়াল। সবুজের সাথে চলতে চলতে কেমন যেন বন্ধুর মতো হয়ে গেল মুহিত। সবুজও মনে হল এতদিন পর একজন মনের মত বন্ধু পেল। তার জীবনে প্রথম প্রেমের কথা যেটা অনেকেই জানে না, কী এক নিদারুণ কষ্ট বুকে জমা রেখে সবসময় হাসি হাসি মুখ নিয়ে থাকে সব সময় সেই গল্পটাও সহজেই শেয়ার করলো মুহিতের সাথে।

একসময় পরীক্ষা শেষ হলো, মুহিতও চলে আসলো বাড়িতে। আসার সময় সবুজই বাসে তুলে দিয়ে আসলো মুহিতকে। যদিও সে না করেছিল এতদূর আসতে হবে না, তবে সবুজ কথা শুনেনি। এমনভাবে যত্ন নিলো যেন নিজের ভাগ্নেকেই বিদায় জানাচ্ছে।

বাসে বসে ভাবল মুহিত জীবন কত বিচিত্র। কেউ বন্ধু থেকে মামা হয় আবার কেউ মামার বন্ধু থেকে বন্ধু হয়ে যায়। সে জানে না জীবন আরও বিচিত্র ময়!

‌২
মুহিত চিটাগং ভর্তি হতে পারেনি। বলতে গেলে বলা যায় ভর্তি হতে চায়নি। কিছুটা যেন ইচ্ছে করেই পরীক্ষা ভালো করেনি। আহাদের কথাগুলো মনে পড়েছে। মানুষ এমন হতে পারে? আহাদের প্রতি যে ক্ষোভটা বুকে ধারণ করেছে সেটা কাউকে বুঝতে দেয়নি। এত দিনের বন্ধুকে দুটো বছর গ্যাপ দিয়েছে বলে বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতিই দিতে পারছেনা, সে যখন বড় হবে তখন কী হবে? বড় হয়ে যখন বড় বড় চাকরি করবে তখন তো আশেপাশের মানুষকে মানুষ বলেই মনে হবে না। এটাই কি শিক্ষা। তাহলে এই শিক্ষার কী দরকার?

তবে মুহিতের ভাগ্য অনেক ভালো বলা যায়। চিটাগং ভর্তি হতে পারেনি বলে বাড়ির সবাই যতটুক মন খারাপ করেছিল সেটা দূর হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় ভর্তি হতে পেরে। সবাই অনেক খুশি। সবচেয়ে বেশি খুশি মুহিত নিজে। ছোট বেলায় টিভিতে নাটক সিনেমায় এই ভার্সিটির অনেক ছবি দেখেছে। তার একটা দৃশ্য বেশি চোখে পড়তো, বড় একটা লাইব্রেরি সেখানে নায়ক তাক থেকে বই সরিয়ে ওপাশে নায়িকাকে দেখে। এই দৃশ্য অনেক নাটকে দেখে তারও ইচ্ছে হতো এখানে ভর্তি হতে। মানুষের কত অদ্ভুদ ইচ্ছে!

এখানে ভর্তি হয়ে বন্ধু হিসেবে পেল পাশের গ্রামের মলয় কে। হাই স্কুলে দুই বছরের ছোট ছিল,তবে মুহিতের যেহেতু দুই বছর গ্যাপ ছিল তাই এখন একই সাথে ভর্তি হয়েছে। মলয় প্রথমদিন কিছুটা দুরুত্ব রেখে চলতে চাইছিল মুহিতই দুরুত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছে। বন্ধুত্বে আবার বয়স কী? আর এখনতো একসাথেই পড়ে। মুহিতকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে মলয় যেন অনেক খুশি।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তার আরেক বাল্য বন্ধু পরিমলও পড়ে। পরিমল ছিল ক্লাসের ফাষ্ট বয়। তবে মুহিতের সাথেও ভালো সম্পর্ক ছিল। আসলে মুহিতের গ্রুপে সবার সাথে সবার ভালো বন্ধুত্বই ছিল বলে মুহিত ভাবতো। আহাদ সেই ভাবনার ভিতে নাড়া দিয়ে গেছে।

আহাদের ব্যবহারে মুহিতের সাহস হয়নি পরিমলের সাথে দেখা করার। জানে না সে পরিমলও বদলে গেছে কিনা।

একদিন দল বেঁধে বন্ধুদের নিয়ে টিএসসিতে আড্ডা দিচ্ছে মুহিত। মলয়ও আছে সাথে। দূর থেকে দেখল পরিমলও বন্ধুদের সাথে এদিকেই আসছে। এখানে এলে দেখা হয়ে যাবে, তাই মুহিতও বন্ধুদের থেকে সাময়িক বিদায় নিয়ে এগিয়ে গেল পরিমলদের দিকে। পরিমল দল থেকে কিছুটা সরে গিয়ে মুহিতের সাথে দেখা করলো। অনেক দিন পর দেখা হলো দুজনার। কত কথাই আলোচনায় উঠে এলো। পরিমল জানালো ও শুনেছে মুহিত ভর্তি হয়েছে, কিন্তু সময়ের অভাবে দেখা করতে পারেনি। কোন হলে উঠেছে কী অবস্থা, হলে কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা সব জেনে নিলো।

মুহিত হঠাৎ দেখলো পরিমলের মুখেও সেই একই ইতস্তত ভাব। বলবে, কি বলবে না, এই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব, মুহিত আবারও সেই হাসিটা দিয়ে বুঝিয়ে দিল, বলে ফেল না বলা কথা।

পরিমল এবার আস্তে আস্তে বললো, দেখ মলয় আমাদের চেয়ে ২ বছরের জুনিয়র। ওর সাথে তুই চলিস সমস্যা নেই, তবে ওর সামনে আমার সাথে দেখা হলে একটু আগে সরে এসে কথা বলবি। আসলে আমার সাথে আমার ব্যাচমেট, বন্ধু থাকেত, আর মলয় আমি এক হলে থাকি, তাই...

মুহিত আর কিছু বলতে দিল না, তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো, আরে এত চিন্তা করিস না, আমি থাকতে কোন সমস্যায় পড়তে হবে না।

সমস্যায় পড়তে হয়নি। অনার্স মাস্টার্স দুই বছর আগেই পরিমলের শেষ হয়েছে। দুই বছর পর মুহিতের, এর মাঝে কখনও মুহিত পরিমলের সামনে পড়েনি। চিটাগং গিয়ে শিখে এসেছে। দুই বছর গ্যাপ মানে বিশাল কিছু। এবার তাই বুঝতে সমস্যা হয়নি।

তবে সুবিধা হলো এবার আর ভাগনে হতে হয়নি। পার্থক্য শুধু এইটুকুই।

২০ মে ২০২০
কক্সবাজার
আপনার মন্তব্য লিখুন

ফেসবুক লাইক ও শেয়ার