সকাল দশটায় ঘুম থেকে উঠি। ফিরি রাত দশটায়।
ক্লাশ নেই বলেই হয়ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। আজ এই কাজ কাল ঐ কাজ লেগে আছে। প্রতিদিন ভাবি সারাদিন হল থেকে বের হবনা, কিন্তু সকাল হলেই মনে হয় জরুরি কাজগুলো আমাকে ডাকছে!
ক্যাম্পাসে ধর্মঘট চলছে। বোমা হামলা প্রতিবাদে ডাকা হয়েছে এই ধর্মঘট। কবে ভাঙ্গবে তার কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। বন্ধুরা সবাই বাড়ী চলে গেছে, আমি যেতে পারিনি। দুটো টিউশনি টিকিয়ে রাখতে হলে ক্যাম্পাসে থাকতেই হবে। এছাড়া কোন গতি নেই।
চিন্তার কথাই বটে। দ্রুত পড়ে দেখি 'চাচার বিয়ে দ্রুত আসো'
পড়ে চিন্তা দূর হল। এবার বাড়ি থেকে আসার সময় মাকে অসুস্থ দেখে এসেছি, এছাড়া বাবার শরীরও ভাল না, তাই চিন্তা হয়, তবে টেলিগ্রাম পেয়ে খুশি হয়েছি।
ছোট চাচা বিয়ে করবেন এর চেয়ে আর খুশির সংবাদ কি হতে পারে। পাঁচ বছর আগে এমএড শেষ করে বেশ ভাল একটা চাকুরী করছেন। বিয়ের বয়েস সেই কবেই হয়েছে। চারিদিকে সবাই পাত্রী দেখতে লাগলো। অনেক পাত্রীর খবর আসে কিন্তু চাচার খবর নেই। চাচা বিয়ে করবেন না।
সবার মাথায় হাত। ছোট চাচা আমার দাদা-দাদীর ছোট ছেলে। বাবা মায়ের ছোট সন্তান হলে যা হয়, ছোট বেলা থেকেই একরোখা। যা বলেন তা করবেন; আর যে কাজে না করবেন সে কাজ তাকে দিয়ে করানো দায়।
বিয়ে না করা সম্পর্কে নানান দিক দিয়ে নানান কথা শোনা যেতে লাগল, তার প্রায় সব কয়টাই শেষ হত বিশ্রি ইঙ্গিত দিয়ে। দাদা দাদীর সে কি কান্না।
তাদের কথা ছোট ছেলের বউ না দেখে মরলে তারা নাকি শান্তি পাবে না।
কিন্তু ছোট চাচার এক কথা। তার দ্বারা বিয়ে করা সম্ভবনা। আমার চাচার কথা শুনে বাবা সে কি রাগ! মায়ের কথা অবশ্য ভিন্ন। হাজার হলেও দেবর বলে কথা, ছোট বেলা থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। আড়ালে নিয়ে বলল, ছোট মিয়া, যদি পছন্দের কেউ থাকে তো বল, আমরা দেখে শুনে ঘরে নিয়ে আসি।
চাচার ছোট্ট উত্তর ওসব কিছু না ভাবী।
এরপর মা বেশি ঘাটালেন না। কত জায়গা থেকে কত প্রলোভন দেখিয়ে প্রস্তাব আসে। কিন্তু কিছুতেই ছোট চাচার মন গলে না, তার এক কথা তিনি বিয়ে করবেন না।
সেই ছোট চাচা বিয়ে করবেন শুনলে কার না আনন্দ হবে। বিয়েতে রাজি না হওয়ার কারণ কেউ না জানলেও আমি জানি। সে অনেক কথা-
গত শীতে সব ফুপা-ফুপিরা এলেন পিঠের দাওয়াত খেতে। বাড়িতে মহা হুলুস্থুল, বাড়ি ভর্তি মেহমান। সব ঘরে এলোপাতাড়িভাবে মেহমানরা শুয়েছেন। আমার স্থান হল চাচার ঘরে চাচার কাছে।
চাচা আমার চেয়ে ছয় বছরের বড়, তাই চাচার সাথে সম্পর্কটা ভয়ের। সব সময় চাচার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতাম। ছোট বেলা থেকে দূরে দূরে থাকতে থাকতে দুজনের মাঝে একটা গ্যাপ সৃষ্টি হয়েছে। যখন ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম তখন চাচার পড়া শেষ। একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হওয়া স্বত্ত্বেও তার সাথে আর গ্যাপটা পূরণ হয়নি। আজ এত বছর পর তার কাছে থাকতে হবে। দুজন দুপাশ ফিরে শুয়ে আছি। এক সময় চাচা জিজ্ঞেস করল পড়াশোনা কেমন চলছে।
ভালো। আমার সংক্ষিপ্ত উত্তর।
A থাকবে তো? চাচার প্রশ্ন যেন শেষ হতেই চায় না।
আমি আবার সংক্ষিপ্ত করে উত্তর দিলাম, থাকতে পারে।
ঢাকা কেমন লাগছে; পাশ ফিরে আবার প্রশ্ন করল।
কেন যেন চাচাকে আর ভয় করছে না, একটু স্বাভাবিক হতে লাগলাম, তবে উত্তরটাও সেই আগের মতোই সংক্ষিপ্ত হল- মন্দ না।
শোন ফয়সাল, এই যে আমি বিয়ে করতে চাইনা তোর কি মনে হয়?
আমি বললাম, কিছুই মনে হচ্ছে না, আপনার প্রয়োজন নেই বলে বিয়ে করছেন না।
ঠিক বলেছিস; এই কথাটাই কাউকে বুঝাতে পারছি না। তোকে মনে হয় বোঝাতে পারব।
চাচা আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে মনোযোগী শ্রোতা পেয়ে বলতে শুরু করল-
এই যে আমি বিয়ে করছিনা, এর পেছনে কিছু কারণ আছে।
কি কারণ চাচ্চু? আমাকেও কেন যেন কথায় পেয়ে বসল।
ধীরে বৎস ধীরে! আজ যখন বলার সুযোগ এসেছে, তো সবই বলব। তোরা হয়ত সবাই অনেক কিছু সন্দেহ করেছিস, সন্দেহ করারই কথা। এত ভাল একটা জব করি, বয়সও কম হল না, দেখতেও মন্দ না, এই তো বিয়ের উপযুক্ত বয়স তাও বিয়ে না করলে তো সন্দেহ করারই কথা।
আসলে সে রকম কিছু না। বিয়ে নিয়ে নিজের সাথেও অনেক যুদ্ধ করেছি। একেকবার সবার জন্য ভাবনা হয়, মনে হয় সবাইকে কষ্ট না দিয়ে বিয়ে করেই ফেলি কিন্তু তখনই কিছু স্মৃতি ভেসে উঠে।
ফয়সাল তোকে একটা প্রশ্ন করব। ঠিক ঠিক উত্তর দিবি তো?
আমি বললাম কি প্রশ্ন চাচ্চু?
তোর বড় চাচীকে তোর কাছে কেমন মনে হয়?
বড় চাচা অর্থাৎ বাবার ছোট ভাইদের মাঝে বড়জন বিয়ে করেছেন আজ তিন বছর হয়েছে। বিয়েতে কি মজাটাই না করেছি তা বলে শেষ করা যাবে না। বড় চাচীকে আমার খুব ভাল লাগে। সেই কথাটাই চাচ্চুকে বললাম।
চাচা মনে হল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছু সময় চুপ করে থেকে বললেন, সে তো সবাই বলে। বিয়ের আগে আমিও ভাবতাম। তুই তো জানিস। ভাবী ছিল তোর ফুপুর বান্ধবী। এক সাথে দুইজন পড়াশোনা করত, ভাবীর বাবা মারা গেছেন সেই কবেই, তারপর তার মা তাকে কি কষ্ট করে মানুষ করিয়েছে তা সবাই জানে। তখন তো তোরা ছোট ছিলি।
বিয়ের আগে যে ছিল শান্ত শিষ্ট একটা মেয়ে, আজ তার রূপ অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। তোর বড় চাচী তোর দাদীকে একদমই সহ্য করতে পারে না। সব কাজে মাতব্বরি করা তার চাই।
ছোট চাচা এবার বললেন, বাড়ী থেকে তোর খালাত ভাই শামীম চলে গেছে, যে ছোট বেলা থেকেই এই বাড়ীতে থাকত। তোর কি একবারও মনে হয়না কেন সে চলে গেল?
শামীম খুব ভাল ছেলে ছিল, সেই ছোট বেলায় তার মা মানে আমার খালা মারা যাওয়ায় মা তাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসে। মা তার বোনকে খুব ভালবাসত। সেই সূত্রে বোনের ছেলেকে আমার আমার চেয়ে কোন অংশে কম ভালবাসত না, বরং বেশিই বাসতো মনে হয়।
চাচ্চুকে বললাম, শামীম ভাই নাকি চাকুরী পেয়েছে। তাই এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।
চাচা বললেন, সে তো সবাই জানে। আসল কথাটা কয়জনেই বা জানে? তোর বড় চাচী যখন এই বাড়িতে বউ হয়ে আসে তখন থেকেই শামীমকে পছন্দ করত না। প্রথম দিকে কিছুই বলত না কিন্তু ধীরে ধীরে তার রূপ বের হতে লাগল। শামীমকে কথায় কথায় খোটা দেওয়া হত। সবাই ভাবত হয়ত কৌতুক করে বলছে। পরে সবাই বুঝতে পারে এসব কৌতুক না শামীমের এভাবে খালার বাড়ি থাকাকে তোর বড় চাচীর পছন্দ না।
অগত্য শামীম সবার শান্তির জন্য চাকুরীর নাম করে চলে গেল ময়মনসিংহ। কাউকে বুঝতে দিল না, কেন সে ময়মনসিংহ চলে গেল। আমিও অনেকদিন জানতাম না। চাকুরীর কাজে ময়মনসিংহ গিয়ে তার সাথে দেখা না হলে আমিও জানতাম না। দেখা হওয়ার পর ও সব খুলে বলে।
বয়স তো কম হল না, আমারও তো ইচ্ছে হয় একটা সংসার হোক। মাকেও বিয়ের কথা জানাতাম। কিন্তু ময়মনসিংহ থেকে এসে আর ইচ্ছে হল না বিয়ে করতে। তোর বড় চাচীর কথা ভেবে বিয়ের কথা বাদ দিলাম। বিয়ে করার পর বউ যদি সবাইকে মেনে নিতে না পারে তা ভেবে বিয়ের কথা বাদ দিলাম।
ছোট চাচা ভার্সিটিতে থাকতে একটি মেয়ের সাথে তার প্রেম ছিল। একথা বাড়ির কেউ জানত না। আমি জেনেছি চাচার বই নিয়ে পড়ার সময়। সেখানে একটা চিঠি ছিল। সেই চিঠি পড়ে অনেক কিছু জেনেছিলাম। যদিও সেই সময়ে তা অস্পষ্ট ছিল। কিন্তু আজ সাহস করে বলেই ফেললাম তাহলে সেই রিমা আন্টিকেই বিয়ে করেন।
তুই রিমার নাম জানলি কি করে?
আমি কিছু না বলে চুপচাপ রইলাম। ছোট চাচ্চু উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে বলতে শুরু করল- তিনমাস আগে ওর বিয়ে হয়ে গেছে। আমার কাছে থেকে সাড়া না পেয়ে ও বিয়ে করে ফেলেছে। ওর বর খুব বড় একজন ব্যবসায়ী।
একবার ভেবেছিলাম ওকে বিয়ে করি। সবাই রাজি হত। আমি আর চুপ করে না থেকে বললাম কিন্তু করলে না কেন?
তার কারণও তোকে আজ বলব। তবে শোন-
বিয়ে সম্পর্কে দুটো কথা পাওয়া যায়। পরিবারের সবার পছন্দে বিয়ে আরেকটা হল প্রেম করে নিজের পছন্দে বিয়ে। প্রথমটির অসুবিধা তো দেখলি, বাবা মার এত সাধের পছন্দ করা পাত্রীর বৈশিষ্ট তো দেখলি। ভালো একটা মেয়ে সংসারে এসে কীভাবে বদলে গেল। এবার অন্য দিকে নিজেরা প্রেম করে বিয়ের ক্ষেত্রে কি হয় তাই শোন-
তুই তো জানিস তোর ছোট মামা আর আমি একসাথেই পড়াশোনা করতাম। অনেক ভাল একজন বন্ধু আমার, একসাথেই চলতে চেষ্টা করি। তোর ছোট মামার বিয়ের সময় তুই এসএসসি দিলি। কি কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে সেই বিয়েতে তোর হয়ত কিছু মনে আছে।
তোর মামা-মামীর প্রেম ছিল বিয়ের আগে থেকেই। সে আরেক কাহিনী- তোর মামী আমাদের এক ইয়ার নিচের পড়ত। ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসে তার সাথে পরিচয়। ভর্তির পর থেকেই নিয়মিত দেখা হত ওর সাথে। তখন রিমার সাথে আমার বেশ ভাল একটা সম্পর্ক চলছে। একদিন শুনলাম তোর মামার তোর মামীর সাথে প্রেমও হয়ে গেছে। তারপর কিযে হল, দুজন ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দিয়ে বেড়াতো।
এমএড শেষ করে চাকুরী পেয়েছি, তোর মামা ও আমি একই হলে থাকতাম। একদিন হলের গেস্ট রুমে তোর মামী এসে হাজির। আমরা নিচে এসে দেখা করার পর থেকে সে কি কান্না। ওর নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে যাচ্ছে। তা ফেরাতে হবে। কিছু করার নেই, অনেক কষ্টে বিয়ে ভাঙ্গতে হল। কিন্তু বিয়ে ভাঙ্গা সহজ ছিল না। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তোর মামা মামীর বিয়ে দিয়ে দিলাম। তোর নানা নানী কেউ বিয়েতে রাজি ছিল না।
কতভাবে যে তোর নানাকে বোঝানো হল। কিন্তু তার এক কথা, যারা নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করেছে তারা নিজেরাই থাকুক। আমাদের আর দরকার কি। তোর নানা খুব কড়া ধাঁচের মানুষ। সেদিন বারান্দায় দাড়িয়ে কড়া গলায় বলে দিলেন, আজ থেকে ওদের স্থান আমার বাড়িতে হবে না, নিজের দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে।
তোর নানী আর কি বলবে। না পাড়ছে স্বামীকে বোঝতে না পারছে ছেলেকে ধরে রাখতে, মুখে আচল চাপা দিয়ে কান্না ছাড়া আর কি করার আছে তার।
শফিক মানে তোর মামার কর্মস্থল ছিল সিরাজগঞ্জ। আমরা বন্ধুরা মিলে ওখানেই বাসা খুঁজে তাদের সংসার পেতে দিয়ে আসলাম। একদম নদীর পাড়ে নিরিবিলি সুন্দর বাসা। দুই টোনাটুনির ছোট্ট সংসার সাজিয়ে দিয়ে চলে এলাম।
বেশ সুখেই চলতে ছিল তাদের সংসার। এর মাঝে শুনলাম শফিক নিগারের মাঝে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। এরপর পেলাম তোর মামার চিঠি। চিঠিতে কি কি লেখা ছিল তার সবটা মনে নেই। তবে কিছু অংশ মনে গেঁথে ছিল-
শফিক যা জানায় তাতে বুঝলাম- কিছুদিন ধরে নাকি নিগারের নামে নীল খামে চিঠি আসে। প্রতিটি চিঠি পাঠায় আকাশ নামে কেউ। প্রেরকের জায়গায় শুধু নাম থাকে আকাশ আর কোন ঠিকানা থাকে না। চিঠির ভাষাও বেশ রোমান্টিক। এনিয়ে নিগারের সাথে কথা হয় কিন্তু নিগার শফিককে কিছু বলে না। কেমন যেন এড়িয়ে যায়। আকাশ কে? প্রশ্ন করে কোন উত্তর পাওয়া যায় না। নিগারের একটা অতীত ছিল। কিন্তু কখনও তা শফিককে বলেনি। এমনকি আমিও জানতাম না। কখনও জানার চেষ্টাও করতাম না। শফিক অনেকবার প্রশ্নে করে কোন উত্তর পায়না, ঝামেলা বাড়তেই থাকে। শেষে থাকতে না পেরে এত বড় ডিসিশন নেয়।
তারও কিছু দিন পর নিগারের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। সেদিন কিছু সময় চেয়ে নিয়ে যা বলল, তাতে আমি মর্মাহত। শফিক কর্মস্থলে ওর সহকারীকে পছন্দ করত। এর প্রতিবাদ করলে নিগারের গায়েও হাত তুলে। এভাবে আর কতদিন থাকা যায় তাই নিগারও চায়নি ঘর করতে। তাই এই বিচ্ছেদ।
এবার তুইই বল ফয়সাল আমি কাকে বিশ্বাস করব। একদিকে তোর মামা, অন্য দিকে নিগার। তখন মনে হত দুইজনের কথাই ঠিক। তাইতো রিমাকে বিয়ে করার কথা বাদ দিতে হল। দুদিন পরে যে বিচ্ছেদ তা এখনও হোক। এতে করে দুইজনই শান্তি পাব।
চাচা তার কথা বলে চুপ করল। এবার আমার বলার পালা, ভাবলাম কিছু বলি, কিন্তু কি বলব। তার সব কথাই তো বাস্তব মনে হচ্ছে।
ঢাকায় ফিরে এলাম। ক্লাশ নিয়ে ভীষন ব্যস্ত। স্যারেরাও জানি কেমন। শুধু কাজ আর কাজ। কাজ ছাড়াও আছে গ্রুপে কাজ। নতুন সেমিস্টারে এক ইয়ার আগের এক সিনিয়র আপু আমাদের সাথে পুনরায় ভর্তি হল। তাকে আমাদের গ্রুপে রাখা হল। গ্রুপে কাজ করতে গিয়ে তার সাথে পরিচয় হল ভালো করে। আমাদের যে কাজ দেয় তার বেশিরভাগই করে নিয়ে আসে সেই আপু। একদিন প্রশ্ন করলাম, আপনি এত সময় পান কিভাবে সব কাজ করে নিয়ে আসার।
তার স্বভাব মত একটু হাসি দিয়ে বলল, এই সব কাজ গুছিয়ে দেয় আমার স্বামী।
আমরা সবাই অবাক। আমাদের অবাক মুখ দেখে সে বলল, তার সব কাজ গুছিয়ে দেয় তার স্বামী।
আমি বললাম কি করেন উনি?
পুলিশ সার্জেন্ট, তারপর সেই আপু বলল, প্রথম বর্ষে থাকাকালীন পারিবারিকভাবে তার বিয়ে হয়েছে। শশুরের অনেক সম্পদ আছে, তাই তার স্বামী বেশি পড়াশোনা করেনি। ডিগ্রি পাশ করে পুলিশের চাকুরী নিয়ে নেয়। ইচ্ছে ছিল চারুকলায় পড়বে, চান্স পায়নি, তাই ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়। পাশ করে পুলিশের চাকুরী পায়। উপরি ইনকামের সুযোগ থাকলেও তা করা হয়না। নিজে ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারেনি তাই চেয়েছে বউয়ের পড়াশোনা যেন না থেমে যায়। আত্মীয় স্বজন অনেকে নানান কথা বলেছে। বাসা থেকেও চাপ এসেছে ঘরের বউ এত কেন পড়বে। তার উপর তাদের ছেলে ডিগ্রি পাশ বউ মাস্টার্স করলে তো প্রবলেম। কিন্তু আপুর স্বামী তার বউকে পড়াবেই। শেষে বাসা থেকে বের হয়ে দুইজনে বাসা ভাড়া করে থাকে। আপু চায়না আলাদা থাকতে। তাই শশুর বাড়ি থেকেই পড়াশোনা চলছে। কিছুদিন পর আপুর ব্যবহারে শশুর বাড়ীর সবাই তাকে আপন করে নেয়। শশুর শাশুড়ী নিজের মেয়ের মতোই মনে করে তাকে।
ঘটনাটা আমাকে ভীষন নাড়া দেয়। চাচাকে জানালাম। যুদ্ধে জয় পরাজয় থাকেই। জীবনটা একপ্রকার জুয়া খেলা, এখানে হারজিত থাকতেই পারে। তাই বলে কি সেখান থেকে পালিয়ে আসতে হয়?
চাচাকে আরও বললা,- এই পৃথিবীতে বড় চাচা চাচী, ছোট মামা মামীর মত যেমন দম্পত্তি আছে, তেমনি এই আপু আর স্বামীর মত দম্পত্তিও আছে। ভালো মন্দ মিলিয়েই মানুষ। তাই আপনাকে বিয়ে করতেই হবে। একবার করেই দেখেন, বিয়ে করলে কতটুকু সুখ বা দুঃখ পাওয়া যায়।
আজ এই টেলিগ্রাম পেয়ে ভালই লাগছে। বুঝতে পারলাম আমার কথায় কাজ হয়েছে। তার ফলাফল এই বিয়ের বার্তা।
দেরি না করে বাড়ীর দিকে রওয়ানা হলাম। শুধু যে চাচার বিয়ের জন্য বাড়ি যাচ্ছি তাই না, আরও কারণ আছে। ফাবিলার সাথে দেখা করাও একটা কারণ। ওদের বাড়ি আমাদের পাশের এলাকাতেই।
ফাবিলা! পর কথা ভাবতে ভাবতেই এক প্রকার সুখে মন ভরে গেল। কতদিন পর দেখা হবে। চিঠি মাঝে মাঝেই পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু ডাক বিভাগ একেক সময়ে এতো দেরিতে চিঠি দেয় যে তা খুব বিরক্ত সৃষ্টি করে।
কতবার না বলা কথাগুলো এবার নিজেই গিয়ে জানাব। আর তার উত্তরও নিজের কানেই শুনব।
বাড়ি গিয়ে দেখি সকলেই তৈরি হয়ে বসে আছে। কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ বাড়িতে রেখে বিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম। ছোট বাসে সবাই উঠেছি। বাসটি কিছু দুর যাওয়ার পর রাস্তাটি কেন যেন বেশি পরিচিত লাগল। গাড়ি যতই যাচ্ছে রাস্তাকে ততই বেশি পরিচিত মনে হচ্ছে। এক সময় গাড়ি থামল। নেমে সবার সাথে এগিয়ে গিয়ে দেখি গেট সাজানো। বাড়িটি অনেক চেনা, কত এসেছি তার ঠিক নেই। এই বাড়ি আমার প্রিয় বান্ধবী আর আমার মনে মনে ভেবে রাখা আমার প্রেয়সী ফাবিলার বাড়ি। ওদের বাড়িতে গেট সাজানো। যতদুর জানি এই বাড়িতে আর কোন মেয়ে নেই, তাহলে কি??
যতটা সম্ভব ভীর কাটিয়ে বিয়ে বাড়িতে চলে গেলাম, এই বাড়ির সবাই আমাকে চিনে তাই কেউ কিছু বলল না, সরাসরি ফাবিলার রুমে গিয়ে দাঁড়ালাম। যা ভেবেছিলাম তাই। বিয়ের সাজে খাটে বসে আছে ফাবিলা। আমাকে দেখে ছলছল চোখে তাকালো, হয়ত কিছু বলত, কিন্তু মুখে কোন কথাই শোনা যাচ্ছিল না।
আমার চোখ জুড়ে কান্না আসছিল, সেটা ঢাকতে বাইরে চলে এলাম, বুকের বাম পাশে কেমন যেন একটা ব্যাথা অনুভব করছি। হাত দিতে দেখতে গিয়ে পকেটের কাগজটা হাতে ঠেকল, মনে পড়ল, সকালের ডাকে পাওয়া চিঠির কথা। খুলে পড়লাম। ফাবিলা লিখেছিল বেশ কয়েকদিন আগে। তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। আমি যদি ভালোবাসি তাহলে কিছু একটা যেন করি।
বুঝলাম দোষ ফাবিলারও না আমারও না। চিঠি পেতে সময় লেগেছিল এটাই কাল হয়ে দাড়িয়েছে।
ভাবলাম কিছু করা দরকার। সামনে তাকিয়ে দেখি বরের বেশে চাচ্চু বসে আছে। তার মুখে একটা সুখের ছায়া। এই ছায়াটাকে আমার আধারে ঢাকতে ইচ্ছে করছে না তাই আমি কিছু না বলে ঐছায়াটাকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হতে দিলাম।।
ক্লাশ নেই বলেই হয়ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। আজ এই কাজ কাল ঐ কাজ লেগে আছে। প্রতিদিন ভাবি সারাদিন হল থেকে বের হবনা, কিন্তু সকাল হলেই মনে হয় জরুরি কাজগুলো আমাকে ডাকছে!
ক্যাম্পাসে ধর্মঘট চলছে। বোমা হামলা প্রতিবাদে ডাকা হয়েছে এই ধর্মঘট। কবে ভাঙ্গবে তার কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। বন্ধুরা সবাই বাড়ী চলে গেছে, আমি যেতে পারিনি। দুটো টিউশনি টিকিয়ে রাখতে হলে ক্যাম্পাসে থাকতেই হবে। এছাড়া কোন গতি নেই।
আজ শরীরটা বেশি ভাল নেই। সকালে কোথাও যাওয়া হয়নি। রুমেই শুয়ে আছি, তন্দ্রা মতোন এসেছিল। পিয়ন এসে বলল, ফয়সাল ভাই কে?
পিয়নের ডাকে জেগে উঠলাম। দরজা খুলে বললাম, আমিই ফয়সাল, কি দরকার?
পিয়ন আমার হাতে একটা চিঠি আর একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলল, এই নিন আপনার টেলিগ্রাম।
চিঠি আর টেলিগ্রাম হাতে নিয়ে পিয়নকে বিদায় জানালাম। চিঠি যা পাই তার বেশিরভাগই আমি বাড়ি থেকে পাই। আর পাই যখন ফাবিলা বাড়ী যায় তখন, কিন্তু টেলিগ্রাম কেন? বেশ দুশ্চিন্তা হল। বাড়ীর কেউ তো...
পিয়নের ডাকে জেগে উঠলাম। দরজা খুলে বললাম, আমিই ফয়সাল, কি দরকার?
পিয়ন আমার হাতে একটা চিঠি আর একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলল, এই নিন আপনার টেলিগ্রাম।
চিঠি আর টেলিগ্রাম হাতে নিয়ে পিয়নকে বিদায় জানালাম। চিঠি যা পাই তার বেশিরভাগই আমি বাড়ি থেকে পাই। আর পাই যখন ফাবিলা বাড়ী যায় তখন, কিন্তু টেলিগ্রাম কেন? বেশ দুশ্চিন্তা হল। বাড়ীর কেউ তো...
চিন্তার কথাই বটে। দ্রুত পড়ে দেখি 'চাচার বিয়ে দ্রুত আসো'
পড়ে চিন্তা দূর হল। এবার বাড়ি থেকে আসার সময় মাকে অসুস্থ দেখে এসেছি, এছাড়া বাবার শরীরও ভাল না, তাই চিন্তা হয়, তবে টেলিগ্রাম পেয়ে খুশি হয়েছি।
ছোট চাচা বিয়ে করবেন এর চেয়ে আর খুশির সংবাদ কি হতে পারে। পাঁচ বছর আগে এমএড শেষ করে বেশ ভাল একটা চাকুরী করছেন। বিয়ের বয়েস সেই কবেই হয়েছে। চারিদিকে সবাই পাত্রী দেখতে লাগলো। অনেক পাত্রীর খবর আসে কিন্তু চাচার খবর নেই। চাচা বিয়ে করবেন না।
সবার মাথায় হাত। ছোট চাচা আমার দাদা-দাদীর ছোট ছেলে। বাবা মায়ের ছোট সন্তান হলে যা হয়, ছোট বেলা থেকেই একরোখা। যা বলেন তা করবেন; আর যে কাজে না করবেন সে কাজ তাকে দিয়ে করানো দায়।
বিয়ে না করা সম্পর্কে নানান দিক দিয়ে নানান কথা শোনা যেতে লাগল, তার প্রায় সব কয়টাই শেষ হত বিশ্রি ইঙ্গিত দিয়ে। দাদা দাদীর সে কি কান্না।
তাদের কথা ছোট ছেলের বউ না দেখে মরলে তারা নাকি শান্তি পাবে না।
কিন্তু ছোট চাচার এক কথা। তার দ্বারা বিয়ে করা সম্ভবনা। আমার চাচার কথা শুনে বাবা সে কি রাগ! মায়ের কথা অবশ্য ভিন্ন। হাজার হলেও দেবর বলে কথা, ছোট বেলা থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। আড়ালে নিয়ে বলল, ছোট মিয়া, যদি পছন্দের কেউ থাকে তো বল, আমরা দেখে শুনে ঘরে নিয়ে আসি।
চাচার ছোট্ট উত্তর ওসব কিছু না ভাবী।
এরপর মা বেশি ঘাটালেন না। কত জায়গা থেকে কত প্রলোভন দেখিয়ে প্রস্তাব আসে। কিন্তু কিছুতেই ছোট চাচার মন গলে না, তার এক কথা তিনি বিয়ে করবেন না।
সেই ছোট চাচা বিয়ে করবেন শুনলে কার না আনন্দ হবে। বিয়েতে রাজি না হওয়ার কারণ কেউ না জানলেও আমি জানি। সে অনেক কথা-
গত শীতে সব ফুপা-ফুপিরা এলেন পিঠের দাওয়াত খেতে। বাড়িতে মহা হুলুস্থুল, বাড়ি ভর্তি মেহমান। সব ঘরে এলোপাতাড়িভাবে মেহমানরা শুয়েছেন। আমার স্থান হল চাচার ঘরে চাচার কাছে।
চাচা আমার চেয়ে ছয় বছরের বড়, তাই চাচার সাথে সম্পর্কটা ভয়ের। সব সময় চাচার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতাম। ছোট বেলা থেকে দূরে দূরে থাকতে থাকতে দুজনের মাঝে একটা গ্যাপ সৃষ্টি হয়েছে। যখন ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম তখন চাচার পড়া শেষ। একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হওয়া স্বত্ত্বেও তার সাথে আর গ্যাপটা পূরণ হয়নি। আজ এত বছর পর তার কাছে থাকতে হবে। দুজন দুপাশ ফিরে শুয়ে আছি। এক সময় চাচা জিজ্ঞেস করল পড়াশোনা কেমন চলছে।
ভালো। আমার সংক্ষিপ্ত উত্তর।
A থাকবে তো? চাচার প্রশ্ন যেন শেষ হতেই চায় না।
আমি আবার সংক্ষিপ্ত করে উত্তর দিলাম, থাকতে পারে।
ঢাকা কেমন লাগছে; পাশ ফিরে আবার প্রশ্ন করল।
কেন যেন চাচাকে আর ভয় করছে না, একটু স্বাভাবিক হতে লাগলাম, তবে উত্তরটাও সেই আগের মতোই সংক্ষিপ্ত হল- মন্দ না।
শোন ফয়সাল, এই যে আমি বিয়ে করতে চাইনা তোর কি মনে হয়?
আমি বললাম, কিছুই মনে হচ্ছে না, আপনার প্রয়োজন নেই বলে বিয়ে করছেন না।
ঠিক বলেছিস; এই কথাটাই কাউকে বুঝাতে পারছি না। তোকে মনে হয় বোঝাতে পারব।
চাচা আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে মনোযোগী শ্রোতা পেয়ে বলতে শুরু করল-
এই যে আমি বিয়ে করছিনা, এর পেছনে কিছু কারণ আছে।
কি কারণ চাচ্চু? আমাকেও কেন যেন কথায় পেয়ে বসল।
ধীরে বৎস ধীরে! আজ যখন বলার সুযোগ এসেছে, তো সবই বলব। তোরা হয়ত সবাই অনেক কিছু সন্দেহ করেছিস, সন্দেহ করারই কথা। এত ভাল একটা জব করি, বয়সও কম হল না, দেখতেও মন্দ না, এই তো বিয়ের উপযুক্ত বয়স তাও বিয়ে না করলে তো সন্দেহ করারই কথা।
আসলে সে রকম কিছু না। বিয়ে নিয়ে নিজের সাথেও অনেক যুদ্ধ করেছি। একেকবার সবার জন্য ভাবনা হয়, মনে হয় সবাইকে কষ্ট না দিয়ে বিয়ে করেই ফেলি কিন্তু তখনই কিছু স্মৃতি ভেসে উঠে।
ফয়সাল তোকে একটা প্রশ্ন করব। ঠিক ঠিক উত্তর দিবি তো?
আমি বললাম কি প্রশ্ন চাচ্চু?
তোর বড় চাচীকে তোর কাছে কেমন মনে হয়?
বড় চাচা অর্থাৎ বাবার ছোট ভাইদের মাঝে বড়জন বিয়ে করেছেন আজ তিন বছর হয়েছে। বিয়েতে কি মজাটাই না করেছি তা বলে শেষ করা যাবে না। বড় চাচীকে আমার খুব ভাল লাগে। সেই কথাটাই চাচ্চুকে বললাম।
চাচা মনে হল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছু সময় চুপ করে থেকে বললেন, সে তো সবাই বলে। বিয়ের আগে আমিও ভাবতাম। তুই তো জানিস। ভাবী ছিল তোর ফুপুর বান্ধবী। এক সাথে দুইজন পড়াশোনা করত, ভাবীর বাবা মারা গেছেন সেই কবেই, তারপর তার মা তাকে কি কষ্ট করে মানুষ করিয়েছে তা সবাই জানে। তখন তো তোরা ছোট ছিলি।
বিয়ের আগে যে ছিল শান্ত শিষ্ট একটা মেয়ে, আজ তার রূপ অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। তোর বড় চাচী তোর দাদীকে একদমই সহ্য করতে পারে না। সব কাজে মাতব্বরি করা তার চাই।
ছোট চাচা এবার বললেন, বাড়ী থেকে তোর খালাত ভাই শামীম চলে গেছে, যে ছোট বেলা থেকেই এই বাড়ীতে থাকত। তোর কি একবারও মনে হয়না কেন সে চলে গেল?
শামীম খুব ভাল ছেলে ছিল, সেই ছোট বেলায় তার মা মানে আমার খালা মারা যাওয়ায় মা তাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসে। মা তার বোনকে খুব ভালবাসত। সেই সূত্রে বোনের ছেলেকে আমার আমার চেয়ে কোন অংশে কম ভালবাসত না, বরং বেশিই বাসতো মনে হয়।
চাচ্চুকে বললাম, শামীম ভাই নাকি চাকুরী পেয়েছে। তাই এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।
চাচা বললেন, সে তো সবাই জানে। আসল কথাটা কয়জনেই বা জানে? তোর বড় চাচী যখন এই বাড়িতে বউ হয়ে আসে তখন থেকেই শামীমকে পছন্দ করত না। প্রথম দিকে কিছুই বলত না কিন্তু ধীরে ধীরে তার রূপ বের হতে লাগল। শামীমকে কথায় কথায় খোটা দেওয়া হত। সবাই ভাবত হয়ত কৌতুক করে বলছে। পরে সবাই বুঝতে পারে এসব কৌতুক না শামীমের এভাবে খালার বাড়ি থাকাকে তোর বড় চাচীর পছন্দ না।
অগত্য শামীম সবার শান্তির জন্য চাকুরীর নাম করে চলে গেল ময়মনসিংহ। কাউকে বুঝতে দিল না, কেন সে ময়মনসিংহ চলে গেল। আমিও অনেকদিন জানতাম না। চাকুরীর কাজে ময়মনসিংহ গিয়ে তার সাথে দেখা না হলে আমিও জানতাম না। দেখা হওয়ার পর ও সব খুলে বলে।
বয়স তো কম হল না, আমারও তো ইচ্ছে হয় একটা সংসার হোক। মাকেও বিয়ের কথা জানাতাম। কিন্তু ময়মনসিংহ থেকে এসে আর ইচ্ছে হল না বিয়ে করতে। তোর বড় চাচীর কথা ভেবে বিয়ের কথা বাদ দিলাম। বিয়ে করার পর বউ যদি সবাইকে মেনে নিতে না পারে তা ভেবে বিয়ের কথা বাদ দিলাম।
ছোট চাচা ভার্সিটিতে থাকতে একটি মেয়ের সাথে তার প্রেম ছিল। একথা বাড়ির কেউ জানত না। আমি জেনেছি চাচার বই নিয়ে পড়ার সময়। সেখানে একটা চিঠি ছিল। সেই চিঠি পড়ে অনেক কিছু জেনেছিলাম। যদিও সেই সময়ে তা অস্পষ্ট ছিল। কিন্তু আজ সাহস করে বলেই ফেললাম তাহলে সেই রিমা আন্টিকেই বিয়ে করেন।
তুই রিমার নাম জানলি কি করে?
আমি কিছু না বলে চুপচাপ রইলাম। ছোট চাচ্চু উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে বলতে শুরু করল- তিনমাস আগে ওর বিয়ে হয়ে গেছে। আমার কাছে থেকে সাড়া না পেয়ে ও বিয়ে করে ফেলেছে। ওর বর খুব বড় একজন ব্যবসায়ী।
একবার ভেবেছিলাম ওকে বিয়ে করি। সবাই রাজি হত। আমি আর চুপ করে না থেকে বললাম কিন্তু করলে না কেন?
তার কারণও তোকে আজ বলব। তবে শোন-
বিয়ে সম্পর্কে দুটো কথা পাওয়া যায়। পরিবারের সবার পছন্দে বিয়ে আরেকটা হল প্রেম করে নিজের পছন্দে বিয়ে। প্রথমটির অসুবিধা তো দেখলি, বাবা মার এত সাধের পছন্দ করা পাত্রীর বৈশিষ্ট তো দেখলি। ভালো একটা মেয়ে সংসারে এসে কীভাবে বদলে গেল। এবার অন্য দিকে নিজেরা প্রেম করে বিয়ের ক্ষেত্রে কি হয় তাই শোন-
তুই তো জানিস তোর ছোট মামা আর আমি একসাথেই পড়াশোনা করতাম। অনেক ভাল একজন বন্ধু আমার, একসাথেই চলতে চেষ্টা করি। তোর ছোট মামার বিয়ের সময় তুই এসএসসি দিলি। কি কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে সেই বিয়েতে তোর হয়ত কিছু মনে আছে।
তোর মামা-মামীর প্রেম ছিল বিয়ের আগে থেকেই। সে আরেক কাহিনী- তোর মামী আমাদের এক ইয়ার নিচের পড়ত। ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসে তার সাথে পরিচয়। ভর্তির পর থেকেই নিয়মিত দেখা হত ওর সাথে। তখন রিমার সাথে আমার বেশ ভাল একটা সম্পর্ক চলছে। একদিন শুনলাম তোর মামার তোর মামীর সাথে প্রেমও হয়ে গেছে। তারপর কিযে হল, দুজন ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দিয়ে বেড়াতো।
এমএড শেষ করে চাকুরী পেয়েছি, তোর মামা ও আমি একই হলে থাকতাম। একদিন হলের গেস্ট রুমে তোর মামী এসে হাজির। আমরা নিচে এসে দেখা করার পর থেকে সে কি কান্না। ওর নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে যাচ্ছে। তা ফেরাতে হবে। কিছু করার নেই, অনেক কষ্টে বিয়ে ভাঙ্গতে হল। কিন্তু বিয়ে ভাঙ্গা সহজ ছিল না। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তোর মামা মামীর বিয়ে দিয়ে দিলাম। তোর নানা নানী কেউ বিয়েতে রাজি ছিল না।
কতভাবে যে তোর নানাকে বোঝানো হল। কিন্তু তার এক কথা, যারা নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করেছে তারা নিজেরাই থাকুক। আমাদের আর দরকার কি। তোর নানা খুব কড়া ধাঁচের মানুষ। সেদিন বারান্দায় দাড়িয়ে কড়া গলায় বলে দিলেন, আজ থেকে ওদের স্থান আমার বাড়িতে হবে না, নিজের দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে।
তোর নানী আর কি বলবে। না পাড়ছে স্বামীকে বোঝতে না পারছে ছেলেকে ধরে রাখতে, মুখে আচল চাপা দিয়ে কান্না ছাড়া আর কি করার আছে তার।
শফিক মানে তোর মামার কর্মস্থল ছিল সিরাজগঞ্জ। আমরা বন্ধুরা মিলে ওখানেই বাসা খুঁজে তাদের সংসার পেতে দিয়ে আসলাম। একদম নদীর পাড়ে নিরিবিলি সুন্দর বাসা। দুই টোনাটুনির ছোট্ট সংসার সাজিয়ে দিয়ে চলে এলাম।
বেশ সুখেই চলতে ছিল তাদের সংসার। এর মাঝে শুনলাম শফিক নিগারের মাঝে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। এরপর পেলাম তোর মামার চিঠি। চিঠিতে কি কি লেখা ছিল তার সবটা মনে নেই। তবে কিছু অংশ মনে গেঁথে ছিল-
শফিক যা জানায় তাতে বুঝলাম- কিছুদিন ধরে নাকি নিগারের নামে নীল খামে চিঠি আসে। প্রতিটি চিঠি পাঠায় আকাশ নামে কেউ। প্রেরকের জায়গায় শুধু নাম থাকে আকাশ আর কোন ঠিকানা থাকে না। চিঠির ভাষাও বেশ রোমান্টিক। এনিয়ে নিগারের সাথে কথা হয় কিন্তু নিগার শফিককে কিছু বলে না। কেমন যেন এড়িয়ে যায়। আকাশ কে? প্রশ্ন করে কোন উত্তর পাওয়া যায় না। নিগারের একটা অতীত ছিল। কিন্তু কখনও তা শফিককে বলেনি। এমনকি আমিও জানতাম না। কখনও জানার চেষ্টাও করতাম না। শফিক অনেকবার প্রশ্নে করে কোন উত্তর পায়না, ঝামেলা বাড়তেই থাকে। শেষে থাকতে না পেরে এত বড় ডিসিশন নেয়।
তারও কিছু দিন পর নিগারের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। সেদিন কিছু সময় চেয়ে নিয়ে যা বলল, তাতে আমি মর্মাহত। শফিক কর্মস্থলে ওর সহকারীকে পছন্দ করত। এর প্রতিবাদ করলে নিগারের গায়েও হাত তুলে। এভাবে আর কতদিন থাকা যায় তাই নিগারও চায়নি ঘর করতে। তাই এই বিচ্ছেদ।
এবার তুইই বল ফয়সাল আমি কাকে বিশ্বাস করব। একদিকে তোর মামা, অন্য দিকে নিগার। তখন মনে হত দুইজনের কথাই ঠিক। তাইতো রিমাকে বিয়ে করার কথা বাদ দিতে হল। দুদিন পরে যে বিচ্ছেদ তা এখনও হোক। এতে করে দুইজনই শান্তি পাব।
চাচা তার কথা বলে চুপ করল। এবার আমার বলার পালা, ভাবলাম কিছু বলি, কিন্তু কি বলব। তার সব কথাই তো বাস্তব মনে হচ্ছে।
ঢাকায় ফিরে এলাম। ক্লাশ নিয়ে ভীষন ব্যস্ত। স্যারেরাও জানি কেমন। শুধু কাজ আর কাজ। কাজ ছাড়াও আছে গ্রুপে কাজ। নতুন সেমিস্টারে এক ইয়ার আগের এক সিনিয়র আপু আমাদের সাথে পুনরায় ভর্তি হল। তাকে আমাদের গ্রুপে রাখা হল। গ্রুপে কাজ করতে গিয়ে তার সাথে পরিচয় হল ভালো করে। আমাদের যে কাজ দেয় তার বেশিরভাগই করে নিয়ে আসে সেই আপু। একদিন প্রশ্ন করলাম, আপনি এত সময় পান কিভাবে সব কাজ করে নিয়ে আসার।
তার স্বভাব মত একটু হাসি দিয়ে বলল, এই সব কাজ গুছিয়ে দেয় আমার স্বামী।
আমরা সবাই অবাক। আমাদের অবাক মুখ দেখে সে বলল, তার সব কাজ গুছিয়ে দেয় তার স্বামী।
আমি বললাম কি করেন উনি?
পুলিশ সার্জেন্ট, তারপর সেই আপু বলল, প্রথম বর্ষে থাকাকালীন পারিবারিকভাবে তার বিয়ে হয়েছে। শশুরের অনেক সম্পদ আছে, তাই তার স্বামী বেশি পড়াশোনা করেনি। ডিগ্রি পাশ করে পুলিশের চাকুরী নিয়ে নেয়। ইচ্ছে ছিল চারুকলায় পড়বে, চান্স পায়নি, তাই ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়। পাশ করে পুলিশের চাকুরী পায়। উপরি ইনকামের সুযোগ থাকলেও তা করা হয়না। নিজে ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারেনি তাই চেয়েছে বউয়ের পড়াশোনা যেন না থেমে যায়। আত্মীয় স্বজন অনেকে নানান কথা বলেছে। বাসা থেকেও চাপ এসেছে ঘরের বউ এত কেন পড়বে। তার উপর তাদের ছেলে ডিগ্রি পাশ বউ মাস্টার্স করলে তো প্রবলেম। কিন্তু আপুর স্বামী তার বউকে পড়াবেই। শেষে বাসা থেকে বের হয়ে দুইজনে বাসা ভাড়া করে থাকে। আপু চায়না আলাদা থাকতে। তাই শশুর বাড়ি থেকেই পড়াশোনা চলছে। কিছুদিন পর আপুর ব্যবহারে শশুর বাড়ীর সবাই তাকে আপন করে নেয়। শশুর শাশুড়ী নিজের মেয়ের মতোই মনে করে তাকে।
ঘটনাটা আমাকে ভীষন নাড়া দেয়। চাচাকে জানালাম। যুদ্ধে জয় পরাজয় থাকেই। জীবনটা একপ্রকার জুয়া খেলা, এখানে হারজিত থাকতেই পারে। তাই বলে কি সেখান থেকে পালিয়ে আসতে হয়?
চাচাকে আরও বললা,- এই পৃথিবীতে বড় চাচা চাচী, ছোট মামা মামীর মত যেমন দম্পত্তি আছে, তেমনি এই আপু আর স্বামীর মত দম্পত্তিও আছে। ভালো মন্দ মিলিয়েই মানুষ। তাই আপনাকে বিয়ে করতেই হবে। একবার করেই দেখেন, বিয়ে করলে কতটুকু সুখ বা দুঃখ পাওয়া যায়।
আজ এই টেলিগ্রাম পেয়ে ভালই লাগছে। বুঝতে পারলাম আমার কথায় কাজ হয়েছে। তার ফলাফল এই বিয়ের বার্তা।
দেরি না করে বাড়ীর দিকে রওয়ানা হলাম। শুধু যে চাচার বিয়ের জন্য বাড়ি যাচ্ছি তাই না, আরও কারণ আছে। ফাবিলার সাথে দেখা করাও একটা কারণ। ওদের বাড়ি আমাদের পাশের এলাকাতেই।
ফাবিলা! পর কথা ভাবতে ভাবতেই এক প্রকার সুখে মন ভরে গেল। কতদিন পর দেখা হবে। চিঠি মাঝে মাঝেই পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু ডাক বিভাগ একেক সময়ে এতো দেরিতে চিঠি দেয় যে তা খুব বিরক্ত সৃষ্টি করে।
কতবার না বলা কথাগুলো এবার নিজেই গিয়ে জানাব। আর তার উত্তরও নিজের কানেই শুনব।
বাড়ি গিয়ে দেখি সকলেই তৈরি হয়ে বসে আছে। কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ বাড়িতে রেখে বিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম। ছোট বাসে সবাই উঠেছি। বাসটি কিছু দুর যাওয়ার পর রাস্তাটি কেন যেন বেশি পরিচিত লাগল। গাড়ি যতই যাচ্ছে রাস্তাকে ততই বেশি পরিচিত মনে হচ্ছে। এক সময় গাড়ি থামল। নেমে সবার সাথে এগিয়ে গিয়ে দেখি গেট সাজানো। বাড়িটি অনেক চেনা, কত এসেছি তার ঠিক নেই। এই বাড়ি আমার প্রিয় বান্ধবী আর আমার মনে মনে ভেবে রাখা আমার প্রেয়সী ফাবিলার বাড়ি। ওদের বাড়িতে গেট সাজানো। যতদুর জানি এই বাড়িতে আর কোন মেয়ে নেই, তাহলে কি??
যতটা সম্ভব ভীর কাটিয়ে বিয়ে বাড়িতে চলে গেলাম, এই বাড়ির সবাই আমাকে চিনে তাই কেউ কিছু বলল না, সরাসরি ফাবিলার রুমে গিয়ে দাঁড়ালাম। যা ভেবেছিলাম তাই। বিয়ের সাজে খাটে বসে আছে ফাবিলা। আমাকে দেখে ছলছল চোখে তাকালো, হয়ত কিছু বলত, কিন্তু মুখে কোন কথাই শোনা যাচ্ছিল না।
আমার চোখ জুড়ে কান্না আসছিল, সেটা ঢাকতে বাইরে চলে এলাম, বুকের বাম পাশে কেমন যেন একটা ব্যাথা অনুভব করছি। হাত দিতে দেখতে গিয়ে পকেটের কাগজটা হাতে ঠেকল, মনে পড়ল, সকালের ডাকে পাওয়া চিঠির কথা। খুলে পড়লাম। ফাবিলা লিখেছিল বেশ কয়েকদিন আগে। তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। আমি যদি ভালোবাসি তাহলে কিছু একটা যেন করি।
বুঝলাম দোষ ফাবিলারও না আমারও না। চিঠি পেতে সময় লেগেছিল এটাই কাল হয়ে দাড়িয়েছে।
ভাবলাম কিছু করা দরকার। সামনে তাকিয়ে দেখি বরের বেশে চাচ্চু বসে আছে। তার মুখে একটা সুখের ছায়া। এই ছায়াটাকে আমার আধারে ঢাকতে ইচ্ছে করছে না তাই আমি কিছু না বলে ঐছায়াটাকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হতে দিলাম।।
(২৫-১১-০৭ থেকে ০৬-১০-২০১৬ ইং)