যেদিন
বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধন করা
হল সেদিন সবচেয়ে বেশি খুশি
হয়েছিলাম আমরা টাংগাইল বাসীরা।
ইতিহাসের অংশ হতে কে না চায়?
তাই
যখন টাংগাইলে দেশের সর্ববৃহৎ,
এশিয়ার
দ্বিতীয় বৃহত্তর ও বিশ্বের
এগারো তম সেতু তৈরি করা হল তখন
আমরা নিজেদের নিয়ে গর্ববোধ
করলাম। কিন্তু এই ইতিহাসের
গৌরব ধারণ করতে গিয়ে আমাদেরই
সবচেয়ে বেশি বিড়ম্বনার স্বীকার
হতে হবে তা কেই বা জানতো?
বঙ্গবন্ধু
সেতু শুধু যে একটি মামুলী সেতু
তাই না,
এটি
একটি সেতু বন্ধন,
বিশেষ
করে দেশের একটি অবহেলিত
জনপদ -উত্তরবঙ্গের
সাথে দেশের রাজধানীর যোগাযোগের
অন্যতম মাধ্যম। সেতু হওয়ার
আগ পর্যন্ত একটি নদী এই
উত্তরবঙ্গকে করেছিল দেশের
মূল ভুখণ্ড থেকে বিছিন্ন।
তাই যখন এই সেতু তৈরি করা হল
তখন উত্তরবঙ্গের সাথে সাথে
আমরাও উল্লাস প্রকাশ করেছিলাম।
কিন্তু তখন কি আর জানতাম এই
সেতুর জন্যই আমাদের সবচেয়ে
বেশি নাজেহাল হতে হবে?
ঢাকা
থেকে টাংগাইলের রাস্তা মাত্র
একশত কিলোমিটার বা তারও চেয়ে
কিছু কম। আমাদের দেশের বাস
গাড়ীর গড় গতিবেগ যদি হয় ঘন্টায়
৬০ কিলোমিটার তাহলে ঢাকা
টাংগাইলের রাস্তার পরিমাপ
সময়ের হিসাবে মাত্র দেড় ঘন্টার
রাস্তা (ননস্টপ
গাড়ীর ক্ষেত্রে)।
আর যদি কোন কারণে গাড়ীর গড়
গতিবেগ হয় ঘন্টায় ৫০ কিমি
তাহলে এর পরিমান দাঁড়ায় ২
ঘন্টা। আর তাই আমার কলিগ কিংবা
বন্ধুবান্ধব যখন শুনে আমার
বাড়ী টাংগাইল তখন বলে “ ও মাত্র
দুই ঘন্টার রাস্তা”।
কিন্তু
তাদের কি করে বোঝাই,
আমাদের
যন্ত্রণার কথা। চাকুরী ও
পড়াশোনার সূত্রে আমাকে গত
কয়েক বছর ধরে ঢাক-টাংগাইল-ঢাকা
যাতায়াত করতে হয়। তাই আমি জানি
এই দুই ঘন্টার কেচ্ছা কাহিনী।
যা নিয়ে লিখতে গেলে রীতিমত
এক আরব্য রজনী হয়ে যাবে।
বর্তমানে ঢাকা-টাংগাইলের
রাস্তায় প্রায় ১৭ টি জেলার
গাড়ি চলাচল করে। কিন্তু অপ্রিয়
হলেও সত্যি এই গুরুত্বপূর্ণ
রাস্তাটি মাত্র দুই লেন বিশিষ্ট।
তার
উপর আশুলিয়ার পর শুরু হয়
গার্মেন্টস এরিয়া। সেখানে
মানুষ ছাড়াও লোকাল বাস,
টেক্সি,
লেগুনা,
রিক্সার
মতো যানবাহনের জন্য হাইওয়ের
গাড়ি স্বাভাবিক গতিতে চলতে
পারেনা। তাদের চলতে হয় পিপঁড়ার
গতিতে। মাঝেই মাঝেই যাত্রা
বিরতি দিতে হয়। দীর্ঘ যানজটের
কারণে নষ্ট হয় ঘন্টার পর ঘন্টা
মূল্যবান সময়। এই অবস্থা চলে
চন্দ্রা পর্যন্ত। চন্দ্রার
পর রাস্তার গাড়ী বহরে যোগ হয়
গাজীপুর কোনাবাড়ী রোড ধরে
আসা গাড়ী সমূহ। এই বিশাল গাড়ী
বহরে ট্রাকের সংখ্যাই খুব
বেশি।
আর
রাস্তায় ট্রাক সবচেয়ে বেশি
নষ্ট হয় (অতিরিক্ত
মাল বোঝাইয়ের কারণে)।
এ ছাড়া ট্রাকের যেহেতু বেশি
দৈর্ঘ্য পাড়ি দিতে হয় তাই
রাস্তায় কোন কারনে একটু জ্যামের
আভাস পেলেই ট্রাক ড্রাইভাররা
ঘুমিয়ে নেয়। যদি কোন কারনে
গাড়ি রাস্তায় নষ্ট হয় তাহলে
তো কোন কথাই নেই। নষ্ট গাড়ির
সাইড দিয়ে চলতে আমাদের দেশের
অভিজ্ঞ ড্রাইভাররা পেছনে
তৈরি করে মাইলের পর মাইল দীর্ঘ
গাড়ির মিছিল। সে এক দেখার মতো
দৃশ্য। কোন লজিকাল কারণ ছাড়াই
গাড়ির বহর বসে আছে রাস্তায়।
এই
অবস্থা গাড়ি দূর্ঘটনার ক্ষেত্রেও
প্রযোজ্য। তবে এই ক্ষেত্রে
অবস্থা আরও করুণ হয়,
তখন
রেকার আসার আগ পর্যন্ত বসে
থাকতে হয় ঘন্টার পর ঘন্টা।
এইসময়ে যানজট বিস্তার লাভ
করে মাইলের পর মাইল। আমি আমার
এই সংক্ষিপ্ত জীবনে এমনও
পেয়েছি যে টাংগাইল থেকে সকাল
পাঁচটায় গাড়ীতে উঠে উত্তরা
পৌঁছেছি বিকাল তিনটায়। যা
রীতিমত অবিশ্বাস্য।
এটি
গেল এক দিক। আরো একটি দিক আছে
যা আরও করুণ। আমাদের টাংগাইলের
উপর দিয়ে ঢাকা-টাংগাইল
রোড ধরে চলে যায় বিলাসবহুল
সব গাড়ী। কিন্তু তাদের গাড়িতে
আমাদের জন্য থাকে না কোন আসন।
আমাদের সাধ থাকলেও আমরা ঐসব
গাড়িতে উঠতে পারিনা। সব গাড়িগুলো
আমাদের চোখের সামনে দিয়ে
হুস-হাস
করে বের হয়ে যায়। আর আমরা শুধু
চেয়ে চেয়ে দেখি। আমাদের জন্য
বরাদ্ধ থাকে লক্কর জক্কর
মার্কা কিছু গাড়ী,
যদিও
ভাড়ার ক্ষেত্রে তাদের থেকে
আমাদেরকে গড়ে অপেক্ষাকৃত
বেশি টাকা গুনতে হয়। কিন্তু
আমরা সেই তুলনায় সার্ভিস
পাইনা। বরং তাদের গাড়িগুলোর
গতি স্বাভাবিক রাখতে আমাদের
রাস্তা ছেড়ে দিতে হয়।
তবে
আমি এমন কিছু বলিনা যে,
তাদের
গাড়িগুলোকে আমাদের রাস্তা
দিয়ে চলতে দেব না,
আসলে
আমি বলতে চাচ্ছি যে,
যখন
একটি সেতু তৈরি করা হল তখন
ভেবে দেখা উচিত ছিল,
কি
পরিমান গাড়ি এই সেতু দিয়ে
চলবে,
তার
জন্য পর্যাপ্ত পরিমান রাস্তা
আছে কিনা। কোন কারণে রাস্তায়
সমস্যা হলে বিকল্প রাস্তার
সংস্থান আছে কিনা?
কিন্তু
তা না ভেবেই একটি বৃহত্তর সেতু
নির্মাণ করা হল। একটি জনপদকে
গড়ে তুলতে গিয়ে আরেকটি জনপদকে
অবহেলার দিকে ঠেলে দেওয়া হল।
রাজধানীতে
প্রতিনিয়তই লোকসংখ্যা বেড়েই
চলছে,
এটি
কমাতে যদি ঢাকার আশে পাশের
অঞ্চলগুলোর সাথে যোগাযোগ সহজ
করে দেয়া যায় তবে অনেকেই বাড়ী
থেকেই প্রতিদিন চলাচল করে
ঢাকার কাজকর্ম,
অফিস
আদালত ইত্যাদি শেষ করে বাসায়
ফিরতে পারবে। দুইঘন্টার যাত্রা
তেমন কিছু আহামরি নয়। এর ফলে
ঢাকার উপর চাপ কমবে। এর জন্য
এখন যা করা যায় তা হলো ঢাকা-টাংগাইল
রাস্তাকে চারলেন বিশিষ্ট
করা,
হাইওয়েতে
ছোট গাড়ী যথা রিক্সা,
টেক্সি
ইত্যাদির চলাচল নিষিদ্ধ করা,
লোক
হাঁটার জন্য বিকল্প রাস্তা
তৈরি করা ইত্যাদি। আর এর জন্য
সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সরকারের
ইচ্ছা। আমার মনে হয় সেটি সরকারের
পর্যাপ্ত পরিমাণেই আছে!!