সকাল থেকে বৃষ্টি পড়ছে। আজকাল সব কিছুতেই বিজ্ঞাপন বিরতি, কিছুক্ষণ কোন অনুষ্ঠান হয় তার পরই থেমে যায় আর এসময় শুরু হয় বিজ্ঞাপন বিরতি। কিন্তু আজকের বৃষ্টি বিজ্ঞাপন বিরতি ছাড়াই চলছে। সকাল দুপুর গড়িয়ে বিকেল তারপরও বৃষ্টির থামার কোন লক্ষণ নেই।
শশীর মনটা খুব খারাপ। আজ আজিজ স্যারের একটি ক্লাশ ছিল। খুব গুরুত্বপূর্ণ। করা হল না। কিছু করার নেই। বৃষ্টি যে হারে চলছে তাতে বিকেলে বের হওয়া যায় কিনা সন্দেহ। হাতে শরৎ সমগ্র নিয়ে পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল নিজেও জানে না।
মোবাইলের একটানা রিংটোনে ঘুমিয়ে থাকতে পারলো না। এই হয়েছে এক যন্ত্রনা। যখন তখন সময়ে অসময়ে ডেকে উঠে। মোবাইলে স্ট্যাটাস দেওয়ার পদ্ধতি থাকলে ভালই হত। তাহলে যে কল দিত সে কল দেওয়ার আগেই দেখতে পেত ওখানে লেখা আছে যাকে কল দিচ্ছেন সে এখন ঘুমায়।
সে ব্যবস্থা এখনও হয়নি, তাই কল আসবেই, সময়েও আসবে, অসময়েও আসবে কিছুই করার নেই। ফোন রিসিভ করতেই হবে। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখেছে কেউ যদি কল করে ঐ সময় না পায় তাহলে কল দিতেই থাকে দিতেই থাকে। বারে বারে কল আসার চেয়ে কষ্ট করে ধরে ফেলাই ভাল। তাই শশী কার ফোন না দেখেই রিসিভ করল।
ঘুম এখনও পুরোপুরি কাটেনি। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল, হ্যালো, কে বলছেন?
জামান দুষ্টুমিটা উপভোগ করে। সেও অচেনার মতো করে বলল, আমাকে তো আপনি চিনতে পারবেন না, আমি মন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ থেকে বলছি। খবর পেলাম যে, আপনার মনে নাকি কি সব গণ্ডগোল চলছে। সেটা মেরামত করতে এসেছি। আপনি কি দয়া করে একটু বাইরে আসবেন?
একে তো ঘুম এখনও পুরো ভাঙ্গেনি, তার উপর ওপাশে কি বলছে তাও মাথায় ঢুকছে না। শশী বিরক্তি নিয়ে বলল, আপনি ভুল নম্বরে কল দিয়েছেন। আর বিরক্ত করবেন না। কথা কয়টা শেষ করেই কল কেটে দিল।
জামান ফোনের দিকে চেয়ে রইল। বুঝতে পারছে না কল কি কেটে গেল না কেটে দিয়েছে। একটু সময় নিয়ে আবার ফোন দিল। একবার দুইবার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ করল শশী। তার ঘুম এবার চলে গিয়েছে। প্রথমবার ফোন রিসিভ করেছিল ঘুম জড়ানো কণ্ঠে কে দিয়েছিল কি বলেছে ভাবতে ভাবতেই আবার ফোন। ভেবেছিল সেই একই নম্বর থেকে এসেছে। কঠিন এক ঝাড়ি দেওয়ার পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছিল। ফোন নিয়ে দেখে জামান ফোন দিয়েছে।
হ্যালো, এতক্ষণে ফোন দেওয়ার সময় হলো? সারাদিন অপেক্ষায় ছিলাম কখন ফোন দিবে। কতক্ষণ হলো তোমার কণ্ঠ শুনিনা। কি কর? কোথায় আছো এখন? ক্লাশ করেছ?
একটানা কথা বলে থামলো শশী। এতক্ষণে বুঝতে পারল জামান তখন কেন ফোন কেটে গেছে। শশী তখন হয়ত দেখেনি সে ফোন করেছিল।
দাঁড়াও দাঁড়াও এত প্রশ্ন একেবারে করলে কোনটার উত্তর দেব? একে একে দিচ্ছি, কিছু একটা করছি একটু পরেই জানবে। কোথায় আছি সেটাও। ক্লাশ করেছি। তুমি আসলে না কেন? স্যার আজ অনেক মজার বিষয় নিয়ে বলেছে।
দেখ না কি বৃষ্টি, এর মাঝে বের হওয়া যায়? তোমার সাথে দেখাও হল না। এই বৃষ্টি কবে যে ছাড়বে। শশীর আবেগ মাখা কণ্ঠে বৃষ্টির প্রতি অভিযোগ বর্ষিত হয়।
আমারও তো তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। কি করব বল, বৃষ্টি আমাদের মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে। শশী আজ একটা স্বপ্ন দেখেছি।
কি স্বপ্ন? শশীর প্রেমময় কণ্ঠ, যে কণ্ঠ পাগল করে দেয় জামানকে।
স্বপ্নে দেখি আজ তুমি আর আমি একসাথে বসে বৃষ্টি দেখছি। তারপর হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজে তোমার হলে তোমাকে দিয়ে আসছি। বিকেলে ঘুমিয়েছিলাম। স্বপ্নটা ঘুমাতে দিল না। ভাবলাম সত্যি করে আসি।
মানে কি? তুমি এখন কোথায়?
আমি তোমার হলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কি করব বল, সবার সব স্বপ্ন তো পূরণ হয় না। আমার এটাও না হয় পূরণ হলো না। একা একা ভিজতে ভালই লাগছে। সারাদিন তোমাকে দেখিনি, এখন এই দেয়ালের ওপাশে বসে আছো, আমি দেয়ালের এই পাশে এটা ভাবতেও ভাল লাগছে।
তোমাকে আর ভাবতে হবে না। একটু দাঁড়াও আমি আসছি। পাগল একটা ছেলে, এই অবেলায় ভিজলে ঠান্ডা লেগে যাবে সেটাও জানো না, কাল তো দেখা হতোই।
শশী ফোন কেটে দিল। তার সারাদিনের আলসেমি এক নিমিষেই উধাও। আয়নায় অবিন্যস্ত চুলগুলো বিন্যস্ত করে নিল। জামান বাইরে দাঁড়িয়ে ভিজছে, এখন আর প্রসাধন করার সময় নেই। একটা গামছা ব্যাগে ভরে ছাতা নিয়ে বের হয়ে হলে।
গেট পেরিয়ে বাইরে এসে দেখে জামান ওয়ালের সাথে ঠেক দিয়ে ভিজছে। শীতে হালকা কাঁপছে জামান। শশী ব্যাগ থেকে গামছা বের করে দিয়ে বলল, এমন পাগলামী করে কেউ? নাও মাথাটা মুছে নাও, ঠান্ডা লেগে যাবে।
শশী গামছা এগিয়ে দেয়, জামানকে ছাতার নিচে নিয়ে আসে। জামান গামছা হাতে নিয়ে বলে, গামছা ছাতা কেন? আজ আমরা বৃষ্টিতে ভিজব। দেখ না কি রোমান্টিক বৃষ্টি। এই বৃষ্টিতে না ভিজলে বৃষ্টিকে অপমান করা হবে।
বৃষ্টিতে ভিজতে শশীরও অনেক ভালো লাগে। বৃষ্টি হলেই ও ভিজতে চলে যেত। হলে এসে এত ভেজা হয়না। ছাতা, গামছা, ব্যাগ হলের গেস্ট রুমে রেখে শশীরা ভিজতে বের হল। হল থেকে বের হলে পাকা রাস্তাটা মূল সড়কে এসে মিশেছে। রাস্তার একপাশে পুকুর। পুকুর পাড়ে নানান জাতের ফুলগাছ, গাছে গাছে ফুল ফুটে আছে। এই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গলায় বেসুরো গানও চলে আসছে। জামান গুনগুন করে গাইছে দেখে শশী বলল, আস্তে আস্তে গাইলে কি শোনা যায়? আমিও শুনব, জোরে জোরে গাও।
জামান গান ধরল, শশী তার সাথে তাল মেলাতে লাগল।
প্রায় ঘন্টা খানিকের মতো ভেজার পর বৃষ্টি অনেক কমে আসছে দেখে জামানরা হলের দিকে রওয়ানা দিল। হলের সামনে কাদেরের দোকানে বসে গরম সিঙ্গারা আর চা খেল দুইজন। এই হলে সান্ধ্য আইন জারী আছে। সন্ধার আযান হতে বেশি দেরি নাই, তাই হলের দিকে রওয়ানা দিল শশী। গেট পর্যন্ত পৌছে দিল জামান। শশী হলে গেলে জামান একটা রিক্সা নিয়ে চলে আসলো ওর হলে।
এরপর কত বৃষ্টির দিন এলো আবার চলেও গেল। মাস গেল, বছর এল আবার মাস গিয়ে বছর এলো।
পাঁচ বছর হলো জামান শশী বিয়ে করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে জামান ব্যাংকে চাকরী পায়। নিজ শহরেও পোস্টিং পায়। শশী আর চাকরি করেনি। বিয়ের পর সংসারের হাল ধরেছে। এটাই এখন ওর কাছে বড় চাকরী। সারাদিন মেয়েকে দেখাশোনা করা, সবার জন্য খাবার তৈরি করা। সংসারের আরও অনেক কাজ করা।
নিজ শহরে জামানের বাবা যে বাড়ি করে গিয়েছিল সেখানেই সংসার পেতেছে জামান শশী। একটা মেয়েও হয়েছে ওদের। দেখতে শশীর মতোই। মেয়েও তার মায়ের অংশ পেয়েছে। চার বছরের মেয়েটি যখন বাবা বাবা বলে এটা ওটা আবদার করে তখন জামানের মনে হয় জীবনটা স্বার্থক।
মাসের প্রথম দিকে ব্যাংকে বেশি ভীড় থাকে, তার উপর আজ রবিবার, দুইদিন ব্যাংক বন্ধ ছিল। সব কাস্টমার মনে হয় আজ ব্যাংকে এসেছে। লেনদেনের কাজ শেষ করে হিসাব মেলাতে মেলাতে সন্ধা পার হয়ে গেল। জামান ব্যাংক থেকে বের হয়ে দেখে বাইরে বৃষ্টি। ছাতা আনা হয়নি। একটা রিক্সা ছিল ব্যাংকের সামনে, ওটাতেই উঠে বাসায় এল জামান। আসতে আসতে বেশ কিছুটা ভিজে গেল।
এই বাসাটা বেশ কিছু জায়গা নিয়ে। মুল বাসার বাইরে অনেকটা উঠোন। এরপর সদর দরজা। উঠোনে নানান জাতের গাছপালায় ভর্তি, তবে গোছালো বাগান।
জামান বাসার সামনে এসে কলিং বেল টিপলো। বৃষ্টি হচ্ছে অনেক। রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে ওটা ছেড়ে দিয়েছে। কলিং বেল টিপে কিছুটা অধৈর্য্য হয়ে গেল। ভিজে প্রায় একাকার হয়ে গেছে। শশী রান্না বসিয়েছিল, আওয়াজটা প্রথমে শুনতে পায়নি। দ্বিতীয়বার কলিং বেল শুনে দৌড়ে আসে দরজা খুলতে। তাড়াহুড়ায় ছাতাটা আনতেই ভুলে গেছে। বাইরে বৃষ্টি ঝরছে। দরজা খুলতে গিয়ে নিজেও কিছুটা ভিজে গেছে।
কতবছর ভেজা হয়না। আজ কেন যেন এই অল্প বৃষ্টির পানি শরীরে পড়ায় মনটা কেমন করে উঠলো। সামনে তাকিয়ে দেখে জামান ভিজে প্রায় একাকার। দরজা লাগিয়ে বলল, চলো ভিজি। কতবছর ভেজা হয়না।
জামান এমনভাবে তাকালো যেন মনে হল সামনে কোন এলিয়েন দেখছে। মুখে একটু সিরিয়াস ভাব এনে বললো। পাগল হলে নাকি? এই বৃষ্টিতে কেউ ভিজে নাকি। বৃষ্টিতে ভেজার কি আছে? ঠান্ডা লাগবে তখন বুঝবে। চল চল ঘরে যাই, আর আমাকে একটা তোয়ালে দাও। মাথা মুছতে হবে। জামান আর দাঁড়ালো না। সরাসরি ঘরে চলে গেল।
শশীর মনটা কেন যেন খারাপ হয়ে গেল। হঠাৎ তার মনে হল সেই দিনের কথা। সারাটা বিকেল ভিজেছে শুধু জামানের ভালো লাগবে বলে। তবে ওরও ভেজার খুব শখ। তবে জামান না এলে ঐদিন এভাবে ভেজা হত না। ঐদিন ভিজে তাকে টানা সাতদিন বিছানায় থাকতে হয়েছে।
আজ ভেজার অনেক ইচ্ছে করছিল। জামান পাত্তাই দিল না। আচ্ছা তারা কি বদলে গেল, নাকি সময়টা বদলে গেছে? শশী আর কিছু ভাবতে পারছিল না। রান্না ঘর থেকে কেমন যেন একটা গন্ধ আসছে। সে তাড়াতাড়ি চলে গেল রান্না ঘরের দিকে। ভেজার হয়ত আরও দিন পাওয়া যাবে কিন্তু রান্না না করলে আজ খাওয়াই বন্ধ থাকবে। দিন সময় না তারা বদলে গেছে সেটা ভাবার মতো তার আর অবসর রইলো না।
মহসীন হল
২০০৪