Sunday, October 19, 2014

এই তো জীবন


ঝাড়ু হাতে তেড়ে আসছে গিন্নি!

পূর্বকালে রমণীরা যখন তরবারি হাতে নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ করতে নামতেন তখন যে রূপে তাদের দেখা যেত, ওকে ঠিক তেমনই লাগছে।

কোমরে শাড়ি গুছিয়ে, হাতে একটি ঝাড়ু নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।

ঘটনা বেশি কিছু নয়। ক’দিন ধরেই বাপের বাড়ি, বাপের বাড়ি করছে। তার উত্তর দিতে কেবলই ‘বা’ বলেছি অমনি এই অগ্নিমূর্তি।

অনেকটা শুকিয়ে গেছে শানু। পরিশ্রম তো আর কম করতে হয়না। কাজের কোন লোক নেই। সব কাজ ওকেই করতে হয়। ফর্সা মুখখানায় আজ বয়সের ছাপ বোঝা যায়। কিন্তু এই মূহুর্তে চোখ খানা অগ্নিসম।

আহা! সেই একই চোখ জোড়া। যা দেখে একদিন কত কবিতাই না বলতাম। এখনও কান পাতলে শোনা যাবে...


পাখির নীড়ের মতন দুটি চোখ তোমার

ঠিক যেন নাটোরের বনলতা সেন।

আজ কোথায় সেই বনলতা! কোথায় সেই নীড়!

নীড় বলতে যা আছে তাকে ঠিক নীড় বলা যায় না। কোন রকমের মাথা গোঁজার ঠাঁই।‌


সস্তা মানের দু’কামরার বাসা। তবে তা উঁচু দরের। এর জন্য ব্যয় করতে হয় বেতনের সিংহ ভাগ।

আসবাবের তেমন বালাই নেই। দু’রুমে দুটো খাট, বাচ্চার পড়ার টেবিল, গোটা চারেক চেয়ার, একটা টেবিল ব্যস এই হল আসবাব!

আর বাইরের পরিবেশ সে তো আজব এক স্থান। চাপা গলি, এক সাথে দুটো রিক্সা চলতে গেলে কুরুক্ষেত্র হয়ে যায়। চারিদিকে কোলাহল মুখর ব্যস্ত পরিবেশ। বিদ্যুৎ যেন চোখের দৃষ্টির মত, এই আছে; এই নেই। নেই তো নেই, আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। চারপাশ তীব্র অন্ধকার। নিজের হাতটি দেখার উপায় নেই।

মনে পড়ে শানুকে বলা সেই কথা-

তুমি ঘরে থাকলে আলোর কি প্রয়োজন। তোমার আলোতে সব আলোকিত। তুমি যেন চাঁদকেও হার মানিয়েছ ।

আর আজ! সেই শানুই আমার ঘরে ,কিন্তু তার আলোতে ঘর আলোকিত হয়না । তার বদলে শোনা যায় শানুর গলা, বসে না থেকে যাও মোম নিয়ে আসো । ছেলের পরীক্ষা।

দোকানে যেতেও ভয় লাগে।


আজ কাল তো পথে কত কিছুই ঘটে। হুটহাট করে গাড়ি এসে চাপা দেওয়া। গলির মোড়ে দুই তিন জন দাড়িয়ে হয়ত বলবে, যা আছে দিয়ে যা, অথবা পুলিশী হয়রানি।


কিন্তু সেসব কিছুই নয়। ভয়টা আমার অন্যখানে।

দোকানদার আমার কাছে বেশ কিছু টাকা পাবে। গত মাসে ছেলের চিকিৎসার জন্য বেশ কিছু টাকা খরচ হয়ে ছিল। তাই দোকানদারের টাকা পরিশোধ করা হয়নি ।

দোকানদার অবশ্য কিছু বলবেনা।

দোকানে গেলে সুন্দর করে হাসি দিবে। হয়ত ওটা ব্যবসার একটা পুঁজি। তার পর জিজ্ঞাসা করবে আমার কুশলাদি। ভদ্রতাবশত আমাকেও তার কুশলাদি ও জিজ্ঞেস করতে হবে। আর তখন বাজতে শুরু হবে তার ভাঙ্গা রেকর্ড। অনেক বার শুনেছি,তার পরও শুনতে হবে;

ছোট ছেলের অসুখ বড়টা এসএসসি দিবে তার ফি বাকি দুই একদিনের মধ্যে জমা দিতে না পারলে পরীক্ষা দিতে পারবে কিনা সন্দেহ !

ওদিকে জিনিস পত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে চলাটাই মুশকিল।

যাক সে কথা !!

আপনি পুরাতন কাস্টমার বলেই আপনাকে এত দুঃখের কথা বলছি। সবাই কে তো আর দুঃখের কথা বলা যায় না। এবার বলুন কি কি লাগবে।

দোকানদার এমন ভাবে বলবে যেন আমি তার কত কালের চেনা; আত্মার আত্মীয়। হয়ত সবার সাথেই এভাবেই পাওনা টাকা চায়। কথা শুনতেই হবে, সত্যি বলতে কি এসব দোকানদার না থাকলে আমাদের মত মধ্যবিত্তদের কি যে হত। ভাবলাম আগামী মাসের বেতন পেয়ে টাকাটা শোধ করে দিতে হবে।

ওদের ও তো খেয়ে বাঁচতে হবে।


হয়ত এই দোকানের আয়েই সংসার চলে আর কোন আয় নেই।

খোঁজ নিলে দেখা যাবে আর দশজনের মত দুই তিনটি ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ, সংসারের অন্যান্য খরচ, সন্ত্রাসীদের চাঁদা সব জোগাতে হয় ঔ দোকানের সওদা বিক্রি করেই। এজন্যেই তাগাদা। না হলে তাদের চলে কি করে!!

আজ মাসের পাঁচ তারিখ।

বেতনের টাকাগুলো পাওয়ার পর আর দেরি করিনি। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছি। রিক্সায় গেলে দশ মিনিট আর হাঁটলে আধ ঘন্টা।

হেঁটেই রওনা দিলাম। রিক্সায় গেলে সবাই ভাবে বেশ টাকা পয়সা কামাই করছে। তখন দোকানদার ও বাকী দিতে চায়না। আর তাছাড়া আজ বেতনের টাকাটা পেয়েছি। তাই এ হাঁটা। এটাই এখন নিরাপদ। আজকাল রিক্সায় ছিনতাই হচ্ছে বেশি। হাঁটতে গেলে যা থাকা লাগবে তা হল মনের জোর।

পকেটের টাকা নাকি ছিনতাইকারীর সাথে কথা বলে। কিন্তু আসল ঘটনা তা নয়। পকেটে টাকা থাকলে তার দিকে সব সময় নজর থাকে। হয়ত বারে বারে হাত বুলিয়ে টাকা অনুভব করা হয়। এতে করেই ছিনতাইকারীরা বুঝে যায়, কার কাছে টাকা আছে।

রাস্তায় হাঁটতে গেলে কত কিছুই তো চোখে পড়ে। কোথাও ফুটপাতের পাশে বসে ছোট্ট মেয়েটি ভিক্ষা চাইছে, কোথাও ডাস্টবিনের ময়লা ঘাঁটছে রনবীর টোকাই। কোথাও বা ফুটপাত জুড়ে পসরা সাজিয়েছে দোকানদার। এসব কিছু নজরে আসে কিন্তু এগুলো দেখতে হয় না। তাহলে আর ঠিক ভাবে চলাটাই মুস্কিল হয়ে পড়ে।

অবশেষে নিরাপদেই বাসায় ফিরে আসা। কলিং বেলের শব্দ শুনে দরজা খুলে দিল আমার একমাত্র ধন, আদরের ছেলে আহাদ। আজ ওকে একটু শুকনো দেখাচ্ছে। কিছু দিন হল অসুখ থেকে সেরে উঠেছে। এখন ওর দরকার পুষ্টিকর খাবার, কিন্তু তার জন্যও দরকার টাকার।

রুমে বসে বিশ্রাম নিচ্ছি, ছেলেটা এসে বলল, বাবা আমার স্কুলের বেতন বাকি, এ মাসে দিতে না পারলে স্যার বলেছে নাম কেটে দিবে।

আচ্ছা দেব।

ছেলেটা আর কিছু না বলে চলে গেল, আমি ওর চোখ দেখে, আরও অনেক না বলা কথা, আবদারের ছবি দেখতে পেয়েছি।

শানু এসে বলল, হাত মুখ ধুয়ে টেবিলে যাও, আমি খাবার দিচ্ছি।

খাবার টেবিলে বসলাম, কোন একদিন হয়ত বলেছিলাম শুটকি আমার প্রিয় খাবার, আর তার জের আজও চলছে। অবশ্য শুঁটকিতে অনেক সুবিধা, একদিন বাজার করলে অনেকদিন চলে যায়, আর ডাক্তারের ভাষায় এতে নাকি অনেক পুষ্টিগুণ বিদ্যমান।

হয়ত এসব কিছু মিলেই নিয়মিত শুটকি রান্না হয়। আমার অবশ্য কোনটাতেই সমস্যা হয় না।

নিজ হাতে সব পরিবেশন করছে শানু। বুঝলাম কোন মতলব আছে। এত বছরের অভ্যাসের কথা আজ আর অজানা নেই।

তিন আঙ্গুলে ভাত মাখাচ্ছি আর ভাবছি, কি মতলব হতে পারে। নানান ভাবনা মাথায় চলে আসল, এমন সময়ই মতলব জানা গেল।

একটা শাড়ী কিনে দিবে? পুরনো শাড়িতে আর কত দিন? অতীত ঘেটে দেখলাম, একটা শাড়ি কিনে দেওয়া আবশ্যক। কিন্তু কি করি, আমারও একসেট পোশাক চাই। আজ দু বছর দুই সেট পোশাক পড়ে চাকরী ক্ষেত্র বনাম বাসা এই দুই জায়গায় আসা যাওয়া করতে হচ্ছে।

ভয়ে ভয়ে বললাম, শাড়িটা এই মাসে না হলে হয় না?

হবে না কেন? হবে, এ মাসে কেন, একেবারে না হলেও হবে। ছেড়া মলিন শাড়ি পড়ে বাইরে গেলে কেউ তো আর বলবে না, ঐ শানু যাচ্ছে, বলবে ঐ তো শাহেদ সাহেবের বউ যাচ্ছে। আমার কি তখন শুনে ভাল লাগবে?

কথা আর কান্না সমান তালে চলছে। এই কান্নার অভ্যাস আগে ছিল না। ইদানিং হয়েছে। আগে কখনও কাঁদতে দেখি নাই। সব সময় হাসি খুশি থাকত, একেবারে মুক্তো ছড়ানো হাসি। অবশ্য একদিন কাঁদতে দেখেছিলাম।

এই তো সেই দিনের কথা। কতদিন আর হবে, ১০/১১ বছর। মনে হচ্ছে এই তো সেদিন।

সেদিনের স্মৃতি আজও চোখের সামনে ভেসে উঠে। কি সুন্দর দিন কাটাতাম। তাই কি মুরুব্বীরা বলে-

'যায় দিন ভাল, আসে দিন খারাপ।'

কলেজ পাশ করে সবে মাত্র ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি, দিনগুলো ভালই কাটছে, আড্ডা, পড়া, ঘুরে বেড়ানো আর এর সাথে যোগ হল প্রেম।

শানু পড়ত এক ইয়ার নিচে। তারপরও প্রেম হয়ে গেল। কত রং বেরংয়ের কথা শোনাতো। আজ তার ছিটে ফোটাও শুনতে পাইনা।

সুখের সময় দ্রুত কাটে। তাই মেঘে মেঘে অনেকটা বছর পার হয়ে গেলেও মনে হয় এই তো সে দিনের কথা।

তখন ফাইনাল ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে। ব্যস্ততা, হাতে সময় নষ্ট করার মতো এক ফোটাও সময় নেই। এমনই একদিনে রুমে কয়েকটা ছেলে এসে বলল, নিচে আমার গেস্ট বসে আছে।

আমার কাছে কে আসতে পারে? বাড়ী থেকে কেউ আসেনি তো? এমনই হাজারো প্রশ্ন নিয়ে নিচে এসে দেখি শানু বসে আছে। আমাকে দেখে হাত ধরে বাইরে নিয়ে আসল। মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, চোখ দুটো ফোলা ফোলা, বুঝলাম কিছুক্ষণ আগে কান্নার পাঠ চুকিয়ে এসেছে। বললাম, কি হয়েছে?

কান্নার সাথে যা বলল, তার মর্মার্থ করলে যা দাঁড়ায় তা হলো, ওর বাবা ওর বিয়ে ঠিক করেছে। কোন মতে ঠেকানো যাচ্ছে না, এখন একমাত্র উপায় নিজেরা বিয়ে করা।

বয়সটা তখন অল্পই ছিল, কিন্তু আবেগের কমতি ছিল না। তাই সেদিন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটা নিতে দেরি করিনি। আর তারই পরিনতিতে নিজ শহরে পরবাসী।

প্রজাপতির কোন পক্ষই মেনে নেয়নি আমাদের এই সম্পর্ক। সেই দশ বছর আগে শুরু করা সংসার, ছোট বাসা আজও তেমনি আছে। বেড়েছে শুধু সদস্য সংখ্যা।

অফিসে গিয়ে শুনলাম, আহমেদ সাহেবের প্রমোশন হয়েছে। চাকুরীতে আমার চেয়ে জুনিয়র হলেও অন্যান্য দিক দিয়ে অনেক বেশিই অভিজ্ঞ। কাউকে কিভাবে তোয়াজ করলে কাজ দ্রুত আদায় করা যাবে, সব তার নখদর্পণে। এ প্রমোশনের ব্যাপারে আগেই কানাঘুষা শুনেছি, কিন্তু কিছু করার নাই বিধায় চুপ করে থেকেছি।

অনেকেই আমাকে তদবির করতে বলেছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি একদমই অজ্ঞ। তাছাড়া এরকম তদবির আমার ভালো লাগে না। একবার ভাবলাম চাকরী ছেড়ে দেই। কিন্তু এই বয়সে চাকরী ছাড়লে খাব কি? তাছাড়া আজকাল সব জায়গায় একই সমস্যা।

অফিসে আজ আর মন টিকছে না, বসকে বলে ছুটি নিয়ে নিলাম, তারপর সোজা বাড়ি।

অনেকদিন পর দুপুরের খাবার সবার সাথে খাওয়া হল। বাহিরে শত ঝামেলা থাকা স্বত্ত্বেও কি এক অনাবিল সুখে মনটা ভরে গেল তা বলে বোঝানো যাবে না।

টিভিতে কি একটা পুরনো সিনেমা চলছে তাই বসে বসে দেখছি। দুপুরের খাবারের পর ঘুমানোর অভ্যাস নেই, তারপরও তন্দ্রা মতো এসেছিল, সেই তন্দ্রা ভাঙ্গল শানুর ডাকে।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সন্ধা হয়ে এসেছে। শানুকে বললাম, ডাকছ কেন?

বাড়িওয়ালী এসেছে। তোমার সাথে দেখা করতে চায়।

হাতে মুখে পানি দিয়ে এসে বসার ঘরে বসলাম, সামনে বাড়িওয়ালী বসে আছে। ঠোঁটে বিশ্রীভাবে পানের পিক লেগে লাল হয়ে আছে, ভদ্র মহিলার পান খাওয়ার দূর্দান্ত অভ্যাস আছে, এক মুহূর্তও পান খাওয়া ছাড়া থাকতে পারেন না, পান খাওয়ার অলিম্পিক থাকলে নির্ঘাত স্বর্ণ পদক পেয়ে যেত।


আমার উপস্থিতি টের পেয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করল। এরপর খুলে বসল গল্পের ঢালী। গল্প মানে ছেলে মেয়েদের গুনগান। প্রতিমাসেই শুনতে হয়, শুনে শুনে আমার মুখস্ত হয়ে গেছে। তারপরও হাসি হাসি মুখে শুনতে হবে, মাঝে মাঝে হু-হা করতে হবে। কারণ তিনি বাড়িওয়ালী আর আমি ভাড়াটে। এই বাজারে এমন বাড়ি এই ভাড়ায় পাওয়া মুস্কিল।

এখন বলছে মেঝ ছেলের কথা, এই বাসায় আসার পর একবারই মাত্র দেখেছি। টেক্সাস থাকে, পারিবারিক এক অনুষ্ঠানে এসেছিল। সেই একবারই তারপর আর দেশে আসেনি।

তারপর বলবে ছোট ছেলের কথা, শেষে মেয়ের গল্প। গল্প শুনে মনে হয় সুখী এক মহিলা। কিন্তু আমি বুঝতে পারি তার মনের ব্যথা।

এতগুলো ছেলে মেয়ে থাকতেও মহিলাকে একা একা দিন কাটাতে হয়। ছেলে মেয়েরা অবশ্য কাছে নিয়ে রাখতে চান, কিন্তু তিনিই যেতে চান না। তার নাকি ঐ সব দেশে দম বন্ধ হয়ে আসে। একদিক থেকে ভালই, সেখানে গিয়ে পরবাসীর মতো না থেকে নিজ দেশে পড়ে থাকা ঢের ভাল।
বাড়িওয়ালী সব শেষে যা শোনায় তা মারাত্বক। ছেলে-মেয়েরা যে টাকা পাঠায় তাতেই তার ভাল ভাবে দিন কেটে যায়, তারপরও সময় মতো বাড়ি ভাড়ার টাকা তার চাইই চাই। তার অদ্ভুদ শখ আছে, বাড়ি ভাড়ার টাকা দিয়ে নাতি নাতনীদের এটা ওটা কিনে উপহার পাঠায়। হয়ত এটা দ্বারা প্রমান করতে চান তার আর্থিক স্বচ্ছলতার কথা। এতে হয়ত তার ছেলের বউরা তাদের স্বামীর মাকে টাকা পাঠানোর জন্য কিছু বলতে পারে না।

বাড়িওয়ালী হয়ত আরও কিছুক্ষণ এই গল্প চালিয়ে যেত, কিন্তু ছেলের ফোন আসায় তিনি চলে গেলেন, আর আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

ইদানিং বুকের বাম পাশে হালকা ব্যাথা অনুভব করি। ডাক্তার দেখানো উচিত, কিন্তু যাওয়া হচ্ছে না। সময় কোথায়, তার উপর চিন্তা হয়, যদি কঠিন কিছু ধরা পড়ে, তাহলে কি হবে?

এর চেয়ে এই ভাল, চুপচাপ থাকা।

অফিসে বসে ব্যাথার কথা ভাবছি, সহকর্মীরা একেক জন মনে হল এই ব্যাপারে পাশ করা ডাক্তার। কেউ বলছে এটা কর, কেউ বলছে ওটা কর, কেউ এ টেস্ট কেউ ও টেস্ট।

কিন্তু আমি তখন ভাবছি অন্য কথা। দেশে এত ডাক্তার থাকতে আমরা কেন বিশেষজ্ঞের কাছে যাই?

অফিস পিয়নের কথায় বাস্তবে ফিরে এলাম। পরিপাটি পোষাক পড়া পিয়ন এসে বলল, আপনার ফোন।

অফিসের ফোন থাকে বসের রুমে। খুব বেশি জরুরী না থাকলে আমাকে কেউ ফোন দিবেনা, তাহলে বাসায় কিছু হয়েছে কি? নানান কিছু ভাবতে ভাবতে ফোন ধরলাম, ওপাশে শানু। কণ্ঠ শুনে কিছুটা নিশ্চিত হলাম অমঙ্গলের কিছু হয়নি। শানুর কণ্ঠে খুশির আমেজ। খুশির আমেজে কোন মতে বলতে পারল, বাসায় আস তাড়াতাড়ি।

বসকে বলে কয়ে বাসায় রওনা হলাম, রাস্তায় ভাবলাম, এত খুশির কারণ কি হতে পারে? তাহলে কি বাবা মা এত বছর পর আমাদের মেনে নিল? না অন্য কিছু?

বাসায় আসার পর যা শুনলাম তার মর্মার্থ হল, কয়েক মাস আগে শানু আমেরিকা যাওয়ার জন্য ডিভি লটারি পূরণ করেছিল। প্রতিবছরই করে। ছোট বেলায় কে নাকি বলেছিল বড় হয়ে আমেরিকা যাবে, সেই আশায় করে।

এতদিন কিছু হয়নি, আজ ভাগ্য মনে হয় খুলে গেছে।

সকাল নয়টায় ফ্লাইট। এতদিন অনেক কাজ করতে হয়েছে। আত্মীয় স্বজন কেউ বিমুখ করেনি, হয়ত ভেবেছে, যাক এতদিনে ছেলে-মেয়ের গতি হল।
তারপরও কত কাজ থেকে যায়। পাসপোর্ট, টিকেট, ভিসা কনফার্ম- কিন্তু কি করে যেন সব হয়ে গেল। বোডিং পাশ দিয়ে অপেক্ষায় আছি, ওপাশে সব আত্মীয় স্বজন। বিদায় জানাতে এসেছে। এভাবে যদি আরো আগে তারা আমাদের দিকে এগিয়ে আসত তাহলে কি আমি এই দেশ ছেড়ে বিদেশ যেতাম?

সবার সাথে থেকে এখানেই যা হোক কিছু করে কাটিয়ে দিতাম। সত্যি দুঃখের দিনে কে আর সাথী হতে চায়? সুখের দিনে সবাই এগিয়ে আসে।

জানি না শানু কি ভাবছে।

এর আগে কখনও বিমানে উঠিনি, ছেলে এদিক ওদিক তাকিয়ে অবাক নয়নে সব দেখছে। শানুর দিকে চেয়ে দেখি ওর দু চোখে অশ্রু।

প্লেন রানওয়ে দিয়ে ছুটে চলছে পরবাসের উদ্দেশ্যে। আর হয়ত আসা হবে না এই দেশে। দেখলাম শানুর চোখে জল, কিন্তু বুঝতে পারলাম না কার জন্য।

আত্মীয় স্বজন না কি ওর ভালবাসা এই সবুজ শ্যামল সুজলা সুফলা দেশের জন্য।।

(মুশফিকুর রহমান)

(২০০৪ সালের লেখাটা হঠাৎ খুঁজে পেলাম। ব্লগে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। এটাই আমার প্রথম গল্প যা ছাপার হরফে বের হতে গিয়েও থেমে গিয়েছিল। যদিও তা ছিল স্থানীয় দেয়ালিকায়, যাই হোক হাজার হলেও ছাপার হরফ। তখন তো আর ব্লগের এত প্রচলন ছিল না।)
আপনার মন্তব্য লিখুন

ফেসবুক লাইক ও শেয়ার