Friday, May 10, 2019

চেকপোস্ট

দোলনের মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হয়েছে গতকাল, আজ চাকরীর ইন্টারভিউ ছিল। চাকরীর ইন্টারভিউ নিয়ে অনেক কথাই শুনে এসেছে এর আগে। কিন্তু আজকে প্রথম ইন্টারভিউ দিয়ে ধারণা বদলে গেছে। একটি বেসরকারি সংস্থায় আইসিটির উপর লোক নিবে। দোলনের এই বিষয়ে পড়াশোনা বিস্তর থাকায় বেগ পেতে হয়নি। কাজটাও তার নিজ এলাকা উখিয়ায়। তাই দোলনের আগ্রহও বেশি ছিল।

চাকরিটা তার বেশি দরকার ছিল চাপার জন্য। চাপাডাঙ্গার চাপা নয়, ঈদগাঁওয়ের চাপার জন্য এই সময়ে চাকরিটা দরকার। দোলন তখন কলেজের তৃতীয় বর্ষে আর চাপা প্রথম বর্ষে তখন থেকে‌‌‌ তাদের প্রেম শুরু। সেইতো সেদিন চাপা প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেছিল সেই প্রথম দেখা। এডমিট হাতে এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছিল সে। কোথায় সিট পড়েছে বুঝতে পারছে না।
একবার কলাভবনের দিকে যাচ্ছে আরেকবার মল চত্বরের দিকে। দোলন তখন বন্ধুদের নিয়ে মল চত্তরে বসে আছে। তখন তার চোখে পড়ল লাল জামা পড়া মেয়েটি একবার মল চত্বরের দিকে যাচ্ছে আবার কলা ভবনের দিকে যাচ্ছে। আজ ভর্তি পরীক্ষা। এই সময়ে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীর পদচারনায় মুখরিত থাকে। প্রথম বর্ষে যারা ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসে তাদের দেখলেই চেনা যায়। তাদের বেশির ভাগের সাথে থাকে একটা প্লাস্টিকের ফাইল। মুখে থাকে রাজ্যের চিন্তা।কারও কারও সাথে থাকে অভিভাবক। আবার কেউ কেউ দল বেধে একসাথে আসে।


চাপা একাই এসেছে মনে হল। তবে মুখ দেখে মনে হল কিছু একটা হয়েছে। পরীক্ষার তখন বেশি দেরি নেই। দোলন ভাবল কোন না কোন সমস্যা হয়েছে। তাই সে এগিয়ে গিয়ে নিজ থেকে বলল, আপু কোন সমস্যা?

চাপা ঠিক বুঝতে পারছিল না কি বলবে এই অপরিচিত ভাইয়াটাকে। তবে দেখে যেটুকু বুঝল উনাকে ভরসা করা যায়। তাই এডমিট এগিয়ে দিয়ে বলল, পরীক্ষা একটু পরেই, কিন্তু সিট খুঁজে পাচ্ছে না।

দোলন এডমিট হাতে নিয়ে কলাভবনের দিকে এগিয়ে গেল। ওখানে সিট প্ল্যান দেওয়া আছে। রোল নম্বর দেখে বুঝল কলাভবনের ১০২০ নম্বর রুমে সিট পড়েছে। তাড়াতাড়ি চাপাকে নিয়ে সেখানে পৌছে দিল। এই ফাঁকে জানা হয়েছে মেয়েটির নাম চাপা, বাড়ি কক্সবাজারের ঈদগাঁওয়ে। ঢাকায় বড় বোন থাকে তার বাসাতেই উঠেছে। ওখান থেকে পরীক্ষা দিতে এসেছে। চাপার পরিচয় শুনে দোলনের কেন যেন ভালো লাগার একটা অনুভুতি কাজ করলো। তার বাড়ি উখিয়ায়। ঢাকায় এসে এতদিন পর নিজ এলাকার কাউকে খুঁজে পেল। তাও কেউ একজনটা একটা মেয়ে। দেখতে খুব একটা যে আহামরি কিছু তা না তবে প্রথম দর্শনে নজর কেড়েছে।

কি ভাবছে এসব, তার এখন লেখাপড়া করার সময়, এটা প্রেম করার সময় না, আর এমন না যে তার মেয়েটিকে ভালো লেগেছে মানে মেয়েটিরও তাকে ভালো লেগেছে। সবচেয়ে বড় কথা মাত্র ভর্তি পরীক্ষা হয়েছে, এখনও রেজাল্ট হয়নি, এখনই এত ভাবলে চলে। এরই মাঝে বন্ধু সৈকত বলল, ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে। তার মামাত ভাই পরীক্ষা দিয়েছে। সে যাচ্ছে রেজাল্ট আনতে। দোলন যাবে কিনা জানতে চাইল।

রাত দশটার দিকে কলা ভবনে রেজাল্ট টানানো হয়েছে। দোলনের হাতে এক টুকরো কাগজে চাপার রোল নম্বর। নোটিশ বোর্ডের সামনে লাইটের ব্যবস্থা থাকলেও তা ঝাপসা, মোবাইলের আলো ফেলে দোলন নম্বরটি মিলিয়ে দেখলো। চাপা মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছে।

এত রাতে ফোন দিবে কি দেবে না ভাবতে ভাবতে মোবাইল বের করল দোলন, চাপার বোন জামাইয়ের নম্বর দিয়েছে, রেজাল্টের খবর যদি পারে দেওয়ার জন্য। প্রথম বার রিং হওয়ার পরই ধরল কেউ একজন। সালাম দিয়ে দোলন নিজের পরিচয় দিল, আরও বলল যে আজ রেজাল্ট দিয়েছে এবং চাপা ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। এই খবরটা যেন উনাকে পৌছে দেওয়া হয়।

চাপার বোন জামাই আন্তরিকতার সাথে দোলনের সাথে টুকটাক কথা বলল, একফাঁকে চাপার সাথে কথা বলিয়ে দিল।

সেই শুরু, চাপার সাথে সাথে তার বোনের পরিবারের একজন হয়ে উঠল দোলন। প্রতি সপ্তাহে একবার ঐ বাসায় দাওয়াত খেতে যেতেই হয়, চাপা দোলনের ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। চলতে চলতে এক সময় তারা বুঝতে পারল তাদের মাঝে যা সৃষ্টি হয়েছে সেটার নাম ভালোবাসা। তবে কেউ কাউকে মুখে বলেনি। ঢাকায় এসে একা একা বোধ করত দোলন, আজ চাপার সাথে পরিচয়ের পর আর একা লাগছে না, ওর পরিবারের সাথে যেন মিশে গেছে। প্রতি সপ্তাহে তারা ঘুরতে যায়। ক্যাম্পাসের সবাই জানে ওদের বিষয়টি।

দেখতে দেখতে মাস্টার্স পরীক্ষার সময় এসে গেল‌ দোলনের। চাপাও অনার্স ফাইনাল ইয়ারে উঠে গেল। দোলন কখনও চাপার বাবা মার সম্পর্কে জানতে চায়নি, সেও কিছু বলেনি। চাপার বাবা কিছুটা সেকেলে ধরনের একরোখা মানুষ। কোন কিছু তার মতের বিরুদ্ধে গেলে তাকে সেটা বোঝানো কারও সাধ্য নেই। গ্রামে বিস্তর জমিজমা আছে। পানের বরজ আছে কয়েকটা। এই দিয়েই চলে যায় তার সংসার। বেশ সচ্ছল বলা চলে। তার কানে কিভাবে কিভাবে যেন চলে গেছে, বড় মেয়ে তার ছোট বোনের জন্য পাত্র ঠিক করেছে। ছেলেটির বাড়ি নাকি পাশের উপজেলায়। তিনি চেয়েছিলেন মেয়ের বিয়ে দিতে। বড় হয়েছে, তাই সংবাদটি শুনে তেমন অখুশি হয়নি। চাপার বোন যখন দোলনের কাছে তাদের বিয়ের বিষয়ে বলতে চাইলো সেদিন দোলনও না করেনি।

তবে তার হাতেও বেশি সময় নেই, চাপার বাবা যেহেতু মেয়ের বিয়ের বিষয়ে কথা তুলেছে তাহলে সে বিয়ে দিবেই। সে দোলনের সাথেই হোক বা আর কোথাও। তাই চাকরি খোঁজা।

মাত্র পাশ করে বিয়ে করলে তার পরিবারও মেনে নিতে চাইবে না। যদিও রোহিঙ্গা আসার কারণে দোলনের পরিবারে বেশ স্বচ্ছলতা এসেছে। তাদের বসত বাড়িতে বেশ কয়েকটি অফিস ভাড়া দিয়েছে। বাজারে কয়েকটা দোকান ভাড়া দিয়ে দোলনের বাবার হাতে বেশ কিছু কাঁচা টাকা জমেছে।

তবুও দোলন চায় কোন চাকরিতে না ঢুকে বিয়ে করবে না। তাই আজ যখন চাকরিটা কনফার্ম করল তখন তার বেশ ভালো লাগার অনুভুতি কাজ করল। এবার আর বাঁধা থাকলো না।

চাপাকে বলে তাদের বাড়িতে দোলন তার বাবা মা ও ছোট বোনটাকে পাঠিয়ে দিল। মেয়ে দেখার জন্য। ছোট বোন ও মা আগেই জানত বিষয়টা, বাবাকে আগে বলা হয়নি। তবে দোলনের মা কিছুটা আভাসে বলেছে। মেয়েটির সাথে তার ছেলের একটা সম্পর্ক আছে। দোলনের বাবা মায়ের চাপাকে পছন্দ হয়ে গেল। তাদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ। তারাও দাওয়াত দিল চাপার বাবা মাকে। কথা রইল আগামী সপ্তাহে চাপার মা বাবা গিয়ে ছেলের বাড়ি দেখে আসবে। পছন্দ হলে তখন বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা হবে।

দোলনের মন খুশিতে ভরে উঠলো। একসাথে কয়েকটি সুসংবাদ। চাকরি হয়েছে আবার পছন্দের মানুষকে তার নিজের করে পাবে। এতদিনের একটি সম্পর্ক স্থায়ী কোন সম্পর্কে রূপ দিবে। চাপার মনেও আসন্ন আনন্দের দিন গুলো নিয়ে নানামুখী কল্পনায় ভরে উঠল। বিয়ের দিন কি পড়বে, কি কি সাজ দিবে। কিভাবে কিভাবে ছবি তুলবে এই নিয়ে দুজনের আলাপচারিতার যেন শেষ নেই। কত রাত ভোর হয় তার ঠিক নেই।

দেখতে দেখতে দোলনদের বাড়ি যাওয়ার দিন এসে গেল। চাপার বাবা কক্সবাজারের সেরা মিস্টির দোকান থেকে মিষ্টি নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেল। সাথে চাপার মা আর বড় বোনকে নিয়েছে। বোনের জামাই আসতে পারেনি ছুটি পায়নি তাই। কক্সবাজার থেকে সরাসরি টেকনাফের যে গাড়িটি যাতায়াত করে সেটায় উঠলে পালংখালি নামাটা সহজ হবে। গাড়িটির নামও সরাসরি। সেই গাড়িতে তিন সিট নিয়ে উঠে পড়লো।

পালংখালিতে গিয়ে দোলনের বাড়িঘর আর তার পরিবারের সাথে পরিচয় হয়ে চাপার বাবা বেশ খুশি হলেন। তিনি এই পরিবারে মেয়ে বিয়ে দিতে তেমন আপত্তি করলেন না তবুও ছেলের বাবার কাছে সময় চাইলেন। তিনি ভাবলেন যদি এখনই বিয়েতে রাজি হয় তাহলে ছেলের বাবা ভাবতে পারেন কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা। তিনি চলে আসার আগে জানালেন তাদের মতামত পরে জানাবেন।

দোলন তাদের সাথে গিয়ে কক্সবাজারে পৌছে দিতে চাইলেন। তবে সেটা চাপার বাবার কাছে ভালো ঠেকলো না তাই তিনি বউ ও মেয়েকে নিয়ে রওয়ানা হলেন। এবারও সেই একই সরাসরি গাড়ি পেলেন। ভাগ্যক্রমে তিনটি সিটও পেয়ে গেলেন।

একটাতে বউ ও মেয়েকে বসালেন আরেকটা বসলেন নিজে। গাড়ি চলতে চলতে তিনি দেখলেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিস্থিতি। একসময় গাড়ি থামলো উখিয়ার আগের স্টেশনে আর্মি ক্যাম্পে। দাঁড়ানো যাত্রি নামিয়ে একজন আর্মির লোক উঠলো গাড়িতে। বিশেষভাবে সব যাত্রীর ব্যাগ তল্লাশী করতে লাগলেন। সাথে গাড়ির সিটগুলো উল্টিয়ে পাল্টিয়ে পরীক্ষা করলেন। গাড়ির যাত্রীদেরও শরীর চেক করা হলো। এরসাথে আইডি কার্ড চাইলো সবার কাছে। চাপার বাবার কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র থাকলেও তার বউ ও মেয়ের কাছে নেই। তাদেরকে গাড়ি থেকে নামি ব্যাপক জিজ্ঞাসা করা হলো। চাপার মা খুব একটা বাড়ির বাইরে যায় না। তার ভাষার অনেকটাই আঞ্চলিক। মহিলা আর্মি দিয়ে তার শরীর চেক করা হলো। অনেক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হলো। এরপর গাড়ী আবার চলতে শুরু করলো। চলতে চলতে মরিচা বাজারে পুলিশ চেক পোস্ট। ওখানেও একই ভাবে চেক করা হলো। সেই যাত্রায় যদিও বেশি কিছু করা হলো না তবে একটু সামনে এগিয়ে বিজিবির চেকপোস্টে বেশ নাজেহাল করা হলো তাদেরকে। জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় মোটামুটি অনেকটা ঝামেলা করা হলো। তবে একসময় ছেড়েও দেওয়া হলো।

বেশ রাত হলো বাড়ি পৌঁছাতে। চাপার বাবার মুখটা থমথম করছে। ফোনটা হাতে নিয়ে দোলনকে ফোন দিল। থমথমে কণ্ঠে বলল, বাবাজী তোমার বাড়িঘর সব পছন্দ হয়েছিল, তোমাকেও পছন্দ হয়েছিল, কিন্তু তোমাদের ওখান থেকে আসতে যে পরিমান নাজেহাল হলাম তাতে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। আমি আমার মেয়েকে ওখানে বিয়ে দেব না, তুমি কিছু মনে করো না, আমার মেয়ের চেয়ে আরও ভালো মেয়ে তুমি বিয়ে করতে পারবে সেই দোয়া করি। তো‌মার কাছে মেয়ে বিয়ে দিলে ওখানে আমার কোন আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে যেতে পারব না। কিছু মনে করনা। তোমাকে কষ্ট দিলাম। তুমি আর কখনও আমার মেয়ের সাথে যোগাযোগ না করলে খুশি হবো।

দোলন একের একের পর এক চাপার ফোনে ফোন দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবার মহিলা বলছে নট রিচেবল। একফাঁকে চাপার বোনের ফোনেও ফোন দিয়েছে কিন্তু সেটাও বন্ধ।

কোনভাবেই আর যোগাযোগ করা যায়নি চাপার সাথে। আজ কয়েকমাস হয়ে গেছে, চাপার সাথে আর যোগাযোগ করা যায়নি, তবে লোক মুখে শুনেছে চাপাকে ঢাকাতে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন নাকি তার বাবাকে আসতে যেতে কোথাও কোন চেকপোস্টে দাঁড়াতে হয়না।

মুশফিকুর রহমান
কক্সবাজারে
১০ মে ২০১৯
আপনার মন্তব্য লিখুন

ফেসবুক লাইক ও শেয়ার