দুইটি
অপরিচিত ছেলেমেয়ে বিয়ে নামক
একটি সামাজিকতার মধ্য দিয়ে
একে অপরের জীবন সাথী হয়ে গেল।
ছেলেটি আমাদের রাসেল। মাত্রই
চাকুরী পেয়েছে। বাবা-মার
একমাত্র সন্তান। তার ইচ্ছে
ছিল আরও কিছু দিন পর বিয়ে করার।
সবে মাত্র চাকুরী পেল। এখন
কিছুদিন আনন্দ ফূর্তি করে
কাটানোর সময়। ঢাকায় এসেছে
চাকুরী নিয়ে। এর আগে কখনও এতো
দিন ঢাকা থাকা হয়নি। গ্রামের
ছেলে সে। পড়াশোনা করেছে জেলা
শহরে। ঢাকায় যা দেখে তাই ভালো
লাগে।
গ্রামে
তার মা-বাবা
বাস করে। তারা চায়না এখন এই
বৃদ্ধ বয়সে একা একা বাস করতে।
তারা চায় ছেলে বিয়ে করে তাদের
জন্য বউ নিয়ে আসুক। মেয়েও
দেখেছে তারা। মেয়েটি আরেক
গাঁয়ের কল্পনা। সবে মাত্র
এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি
হয়েছে। রূপে যেন অদ্বিতীয়া।
এমন মেয়ে পেলে যে কেউ তাদের
ঘরের বউ করতে চাইবে। কল্পনার
মায়ের, মেয়ের
চিন্তায় ঘুম হয় না। মেয়ে এখন
কলেজে যায়। পথে কতই না বিপদ
ওত পেতে থাকে। তার উপর মেয়ে
রূপবতী, আর
কে না জানে রূপবতী মেয়ের উপর
নজর সবারই থাকে। তাই কখন কি
হয়, না
হয় এই চিন্তায় তারা অস্থির।
এই
গাঁয়ের ঘটক মুন্সীর নানান
দিকেই চোখ। বিশেষ করে কার
বিয়ের বয়স হয়েছে,
কে কি চাকুরী
পেল। কে কোথায় কি করে সে দিকে
নজর রাখাই তার কাজ। এই নজর
রাখা তার পেশার অন্যতম মূলধন।
নজর রাখতে গিয়েই তার চোখে পড়লো
কল্পনাকে। কয়েকদিন আগেই
রাসেলের বাবা মা তাকে ধরে ছিল
রাসেলের বিয়ের জন্য মেয়ে
দেখতে। হঠাৎ মনে
হল রাসেলের সাথে কল্পনার বিয়ে
হলে মন্দ হয় না। একটি শুভ দিন
দেখে তিনি রাসেলের বাবা মার
কাছে প্রস্তাব তুললেন।
মেয়ে
দেখতে শুনতে ভালো তার উপর
বাবার টাকা পয়সাও আছে,
তাই আর রাসেলের
বাবা মা অমত করলো না। তারা
ঘটককে পাঠালো বিয়ের কথা বার্তা
বলতে, ঘটক
পরদিনই কল্পনার বাবা-মার
কাছে প্রস্তাব দিলেন। বাবা
চায়না এই মুহূর্তে মেয়ের বিয়ে
দিতে। মা নাছোড় বান্ধা। তিনি
মেয়ের বিয়ে দিবেনই। তার উপর
বেঁকে বসলো কল্পনা। এই বিয়েতে
তার মত নেই। শুধু এই বিয়ে নয়,
কোন বিয়েতেই তার
মত নেই।
কল্পনা
এখন কলেজে পড়ে। তার এখন অনেক
কিছু বোঝার বয়স হয়েছে। ওর
ইচ্ছা, পড়াশোনা
শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে।
বাংলা ম্যাডামের মতো চাকুরী
করবে, নিজের
মতো করে নিজেকে চালাবে। তার
বেঁকে বসার এটাই কারণ। যদিও
ফিসফাস নানান কথাই ভেসে আসে।
কিন্তু সে ফিসফিসানি ফিসফিসানিই
থাকে জোড় গলায় কথা আর হয় না।
কল্পনার
ফুপু খালা সবাই কোমর বেঁধে
বসলো তাদের ভাইজি বোনজিকে
রাজি করাতে। অবশেষে তারা রাজি
করাতে পারলো কল্পনাকে। সেই
সাথে কল্পনার বাবাকেও। বাঙ্গালীর
টিপিক্যাল ইমোশনের সবকয়টি
অস্ত্রই প্রয়োগ করা হয়েছিল
এই কাজে। তাই তার রাজি না হয়ে
উপায় ছিল না।
বিয়ে
মানে একটি উৎসব। বাড়ি জুড়ে
নানান আয়োজন। কত কথা,
কত গল্প। হাসি
তামাশা। কত মেহমান। চারদিকে
খুশির বন্যা। আজ কল্পনার বিয়ে।
রাসেল বর সেজে স্টেজে বসে আছে।
তার মনে আর খুশি ধরে না। একটি
মেয়ে আজ থেকে তার চিরসঙ্গী
হবে। সুখে দুঃখে তার পাশেই
থাকবে। এর চেয়ে সুখের আর কি
থাকতে পারে?
যদিও প্রথমে বিয়ে
করতে রাজি ছিলনা,
কিন্তু এত রূপবতী
মেয়ে দেখে আর না করতে পারেনি।
ঘটক
মুন্সীও আজ খুশি। বিয়ে মানে
তার পকেটে কিছু টাকার আমদানী।
ইদানিং তার ঘটকালী ব্যবসায়
মন্দা যাচ্ছে। ছেলে মেয়েদের
ইদানিং কি যেন হয়েছে। তারা
নিজেরাই নিজেদের বিয়ে ঠিক
করে। কেউ আর আগের মতো ঘটক ধরে
না। এই বিয়েটার কল্যাণে আজ
তার কিছু ইনকাম হবে। বিয়ের
কাজে তার তাড়াই বেশি। বাড়ে
বাড়ে তাগাদা দিচ্ছে বিয়ে
পড়াতে। একবার ছেলের বাবা একবার
মেয়ের বাবাকে ধরছে বিয়ে যেন
তাড়াতাড়ি পড়ায়।
বিয়ে
পড়ালে কাজি সাহেবেরও কিছু
ইনকাম হবে। তার আবার আরেকটি
বিয়ে পড়াতে হবে। তাই সেও তাগাদা
দিচ্ছে। এই বিয়ে শেষ না করে
আরেক বাড়ি যেতে পারছেনা।
অবশেষে সবার তাগিদে বিয়েটা
হয়েই গেল। এদিকে বেলাও প্রায়
গড়িয়ে গিয়েছে। বউ নিয়ে যেতে
নির্ঘাত রাত হবে। অবশ্য গ্রাম
দেশে রাত করেই বউ নিয়ে যাওয়া
হয়।
গ্রামের
নাম আনেহলা। শামখালী নদীর
তীরে ছোট্ট ছিমছাম ছবির মতো
একটি গ্রাম,
নদীটিও গ্রামের
মতোই ছোট খাট। বর্ষায় নৌকাই
একমাত্র বাহন। একটি বড় নৌকায়
বরযাত্রী বউ নিয়ে বাড়ি আসলো।
তখন অনেক রাত। অবশ্য গ্রামে
সন্ধা মানেই রাত। বউ নিয়ে আসায়
বাড়ি জুড়ে হুলুস্থুল কান্ড।
কেউ হারিকেন নিয়ে আসে,
কেউ বরণ ডালা
সাজিয়ে সামনে নিয়ে আসে। রাসেলের
মা তার ছেলের বউকে বরণ করে
নিল।
এই
বাড়িতে আরেক জন অনাহূত অতিথি
আজ বিয়ের বর যাত্রীর বেশে এই
বাড়িতে এসেছে। এক্ষণে তার
পরিচয় তুলে ধরা উচিত। না হয়
গল্প যেন আর দশটি কাহিনীর মতোই
সহজ হয়ে যাচ্ছে। এই অনাহূত
অতিথি হলো মনসুর। এককালে
আর্মিতে চাকুরী করেছে। কিন্তু
স্বভাব দোষে চাকুরীটাই হারায়।
তার এই স্বভাব দোষটা আদিম এক
পেশার সাথে জড়িত। মনসুর চোর
বিদ্যায় স্বতঃসিদ্ধ। তার বয়স
প্রায় চল্লিশের কোঠায়। এত
বছর ধরে সে চুরি করে কিন্তু
কখনও ধরা পড়েনি। তার একটি
সংকল্প ছিল,
যেদিন সে ধরা
পড়বে সেদিন থেকে চুরি ছেড়ে
দিবে। কিন্তু কোন এক অজানা
কারণে সে ধরাও পড়েনা,
তাই চুরিটাও ছাড়া
হয় না। তার কপালটাই মন্দ।
মনসুর
চোরার চুরি করার বাতিকটাও
অদ্ভুত। সে যে সব সময় চুরি করে
না। তবে সে চায় প্রতিনিয়ত
নিত্যনতুন ভাবে চুরি করার।
এই যেমন গত কয়েকদিন আগে রাস্তা
দিয়ে শহরে যাওয়ার সময় দেখলো
এক দম্পত্তি বারান্দায় বসে
মোবাইলে গান শুনছে। এটা দেখেই
তার শখ জাগলো,
এই নতুন সেটটা
তার চাই।
যেই
ভাবা সেই কাজ। সারা রাত বসে
রইলো বারান্দার কাছে ঘাপটি
মেরে। শেষ রাতের দিকে আগুন
আগুন বলে চিৎকার দিল। তার ডাকে
সবাই জেগে উঠলো। হাতের কাছে
যে যা পেল তাই দিয়ে আগুন নেভাতে
চলে গেল। আগুন অবশ্য লেগেছিল
তবে তা যৎসামান্যই। কয়েক মুঠো
খড় দিয়ে বানানো কুন্ডলীতে
আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল সে। সবাই
যখন সেই আগুন নেভাতে ব্যস্ত
সেই সুযোগে হাপিস করে দিল
সেটখানা।
আজ
আবার তার শখ হয়েছে চুরি করার,
কিন্তু সাথে চাই
অ্যাডভেঞ্চার। যেই ভাবা সেই
মতোও কাজ শুরু করলো। প্রথম
ধাপে তার প্রয়োজন এই বাড়িতে
ঢোকা। তাতে সে সফল। এই রাতে
কেউ তার দিকে নজর দেয়নি। বর
পক্ষের লোক ভাবলো কনের সাথে
এসেছে। তাই তাকে আলাদা আপ্যায়ন
করলো। সেই ভালো মানুষের মতো
আপ্যায়িত হল। খাওয়া শেষে এক
ফাঁকে ঢুকে পড়লো বাসর ঘরে।
ঘরে তখন কেউ নেই। মনসুর নিজের
স্থান করে নিল বাসর ঘরের খাটের
নিচে। আজ এই ঘরেই চুরি করার
মতো মশলা থাকবে। এই ঘরের মতো
নিরাপদ আর কোন ঘরই হবে না।
তার
জীবনেও এমন একটা ঘরে থাকার
অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সে অনেকদিন
আগের ঘটনা। তারপরও স্মৃতির
পাতায় তা অমলিন। এখনও প্রায়
সব ঘটনাই তার চোখের সামনে ভেসে
উঠে। এ কারণে নিশ্চিত হয়ে
মনসুর ঘুম দিল। মনসুরের ঘুম
অনেক পাতলা। তাই সে নিশ্চিত,
মাঝরাতে একবার
এই ঘরের দরজা খোলা হবেই।
অবশেষে
সকল জল্পনা কল্পনার অবসান
ঘটিয়ে মাঝরাতে খুলে গেল বাসর
ঘরের দরজা। একটু খুট করে আওয়াজ
হয়েছিল। এতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল
মনসুরের। দেখে ঘর একদম খালি।
এই সুযোগ। মনসুর দ্রুত হাতে
নতুন বউয়ের খুলে রাখা স্বর্ণের
গহনা তার পকেটে তুলে নিল। ঘরে
আরও মূল্যবান অনেক কিছু আছে।
কিন্তু সবকিছু নিতে গেলে তার
ধরা পরার সম্ভাবনা বেশি। তাই
বেশি লোভ না করে গহনা নিয়ে
রওয়ানা হলো বাড়ির দিকে।
সকালবেলায়
কল্পনার চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গল
সবার। রাতে খুলে রাখা গহনা
নেই। নেই তো নেই। ঘরের আর সবকিছু
ঠিক আছে শুধু গহনা নেই। চোর
আসলে তার আলামত থাকতো,
কিন্তু ঘরে সেও
আলামত নেই। তাহলে গহনা কি হবে।
কল্পনা সাথে এসেছিল তার দুই
দুলাভাই তারা কল্পনার কাছে
এল, ঘটনা
শুনে তো তারাও স্তম্ভিত।
কল্পনার সাথে যারা এসেছে তাদের
সবার দেখা পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু
রাসেলের বাবা মা যাকে রাতে
কল্পনার সাথে এসেছিল বলে
ভেবেছিল সেই লোকটি নেই। নেই
তো নেই। কোথাও খুঁজে পাওয়া
যাচ্ছে না।
কল্পনাও
বুঝতে পারছে না কার কথা বলা
হচ্ছে। তার সাথে আসা দুলাভাইয়েরাও
বুঝতে পারছে না কার কথা বলা
হচ্ছে। কিন্তু রাসেলের বাবার
কথা একটাই। কল্পনা ঐ লোকটির
সাথে মিলে মিশে গহনাগুলো
সরিয়েছে। তাকে যতই বোঝানোর
চেষ্টা করে তাদের সাথে তার
দুই দুলাভাই ছাড়া আর কেউ আসেনি,
রাসেলের বাবা
ততই অস্বীকার করে।
পরিস্থিতি
নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
রাসেলের বাবার কথা কল্পনার
সাথে আসা ঐ লোকটিই গহনা সরিয়েছে,
আর তাকে সহায়তা
করেছে কল্পনা। এই সময়ে কল্পনার
বাবা এলো মেয়েকে দেখতে। এবার
রাসেলের বাবা ধরলো তাকে। হয়
গহনা বের করে দিতে হবে,
নচেৎ তারা অন্য
ব্যবস্থা করবে। কিন্তু কল্পনার
এক কথা, তার
সাথে তার দুই দুলাভাই ছাড়া
আর কেউ আসেনি। দিন যত বাড়লো
ঘটনা ততই অন্য দিকে মোড় নিতে
লাগলো। ঘটনায় ছড়াতে লাগলো
নিত্যনতুন রং। শেষে শুরু হলো
কল্পনার নামে কাল্পনিক নানান
দুর্নাম। শেষে স্থির হলো,
এমন মেয়েকে তারা
আর তাদের বাড়িতে স্থান দিবে
না। এখনই তাকে চলে যেতে হবে
বাপের বাড়ি।
কল্পনার
বাবারও জিদ কম না। তিনিও মেয়েকে
এই রকম একটি ঘরের বউ হিসাবে
কল্পনাকে থাকতে দিতে রাজি
না। তিনি মেয়েকে নিয়ে রওয়ানা
হলো বাড়ির দিকে।
সকাল
বেলায় যখন মনসুর চোরা পকেট
থেকে গহনাগুলো বের করে আলোর
নিচে নিয়ে দেখছে তখনও সে ভাবতে
পারেনি, কত
বড় এক সর্বনাশ সে করে এসেছে।
তার এই গহনা চুরির জন্য একটি
মেয়ে হারাচ্ছে সংসার। গহনাগুলো
দেখে তার চোখে তখন এক বিশ্বজয়ের
ঝিলিক দেখা যাচ্ছে।।