Tuesday, September 6, 2011

ত্রিমাত্রিক এর তিন মাত্রার অপরাধ

পার্বত্য উপত্যাকার শিক্ষার্থীদের আইসিটি শিক্ষার উন্নয়নে ওয়ার্ড ফোর্জ ফাউন্ডেশন ও অঙ্কুর আইসিটি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন একটি যৌথ পদক্ষেপ নেয়। এর অংশ হিসেবে তারা রাঙ্গামাটি উপজেলার কয়েকটি বিদ্যালয়ে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপনে আগ্রহী হয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় প্রতিটি ল্যাবে বেশ কিছু সংখ্যক কম্পিউটার, প্রিন্টার ও প্রজেক্টর থাকবে।


ওয়ার্ডফোর্জ ফাউন্ডেশন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে সামাজিক ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। ২০০৬ সাল থেকে এটি তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণের সমতা নিশ্চিত করে আসছে। WFF বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়া তে মুক্ত সফটওয়্যার কে স্থানীয়করণ করে সরকার ও শিক্ষা ব্যবস্থার সহায়তায় তা বিতরণ করে থাকে। এছাড়াও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতেও কাজ করে যাচ্ছে এই দুই দেশে।

ওয়ার্ড ফোর্জের কাজে বাংলাদেশে তাদেরকে সহায়তা করছে অঙ্কুর আইসিটি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন। ওয়ার্ড ফোর্জের মতো অঙ্কুর আইসিটি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন একটি অবাণিজ্যিক ও সেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। অঙ্কুর আইসিটি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন বা এআইডিএফ কাজ করে যাচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নে। দেশের সবাই যাতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে তথা কম্পিউটারে অবাধ বিচরণ করতে পারে তার জন্য একজন ব্যবহারকারীর প্রয়োজনীয় সকল সফটওয়্যার স্থানীয়করণ করে আসছে ও তার জন্য ব্যবহারকারী মেনুয়্যাল তৈরি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে আসছে।

এই দুটি প্রতিষ্ঠান পরিকল্পনা করে যে রাঙ্গামাটি উপজেলার দুইটি বিদ্যালয়ে সাতচল্লিশটি কম্পিউটার, তিনটি প্রজেক্টর, তিনটি প্রিন্টার দেওয়া হবে। তাদের এ কাজে সহায়তা করে স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠান ত্রিমাত্রিক। যারা এই কাজে সংশ্লিষ্ট না থাকলে আমার এই লেখাটা লেখার কোন প্রয়োজন পড়তো না।

এখানে ত্রিমাত্রিকের কিছু পরিচয় দেয়া যাক। http://www.trimatrik.net/ তাদের এই ওয়েব সাইটে গিয়ে যতদুর জানা যায় যে তারা একটি আন্তর্জাতিক মানের মাল্টিমিডিয়া কোম্পানী। এই কোম্পানীর চেয়ারম্যান যতদুর জানা যায় মি: মো. ওমর ফারুক ফারুক, প্রথমে তিনি পরিচয়ের সময় বলেছিলেন যে আনন্দ মাল্টিমিডিয়ার সাথে তার কোন যোগাযোগই নেই। বরং তার করা এনিমেশন গুলো আনন্দ মাল্টিমিডিয়া চুরি করে নিজেদের বলে চালিয়েছে। কিন্তু নেট ঘেটে দেখা যায় তিনি আবার প্রযুক্তিবিদ মোস্তফা জব্বারের আনন্দ মাল্টিমিডিয়ার রাঙামাটি শাখার প্রধান-
http://www.dailykalerkantho.com/print_news.php?pub_no=81&cat_id=1&menu_id=56&news_type_id=1&index=1

রাঙ্গামাটিতে তিনি একজন আইটি বিশেষজ্ঞও বটে। তাই তাকে ছাড়া রাঙ্গামাটিতে আইটি বিষয়ক কোন কাজই হয়না!! যথারীতি তিনি রাঙ্গামাটিতে কোথায় কোথায় কম্পিউটার দেয়া যায়, কোন বিদ্যালয়ে কতগুলো কম্পিউটার দেয়া যায় তার পরামর্শ দাতা রূপে আবির্ভূত হলেন।



তিনি ওয়ার্ড ফোর্জের প্রেসিডেন্ট মি: জাভিয়ারের সাথে ব্যক্তিগত ভাবে আলাপ চালিয়ে গেলেন। তার কথা মতো রাঙ্গামাটিতে কম্পিউটার দিতে গেলে তার দেখানো নির্দিষ্ট দোকান থেকে তার মন মতো দাম দিয়ে কিনতে হবে। জাভিয়ার বিদেশি মানুষ, তিনি ভাবলেন কম্পিউটার দেয়া নিয়ে কথা তাই যেকোন দোকান থেকে নিলেই হলো। তাকে দামের তালিকা দেখানো হলো। এখানে দেখা গেল প্রতিটি কম্পিউটারের দাম পড়বে এক লাখ টাকার উপর। দেশীয় প্রতিষ্ঠান অঙ্কুর আইসিটি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের জেনারেল সেক্রেটারী বিষয়টির প্রতিবাদ করলেন। পরে তাকে ফোনে হুমকি দেয়া হলো। এব্যাপারে কোন কিছু করলে তাকে রাঙ্গামাটিতে কখনো প্রবেশ করতে দেয়া হবেনা।

এমনিতে আমরা দুর্নীতিতে সবার উপরের দিকেই থাকি, তাই অঙ্কুর আইসিটি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের জেনারেল সেক্রেটারী জাভিয়ারকে এ ব্যাপারে কিছু বললেন না। ভাবলেন আমাদের নোংরা দিক জাভিয়ারের কাছে খোলাসা না করাই ভালো। তিনি এ ব্যাপারে জেনে যদি বিদ্যালয়গুলোতে কম্পিউটার দেয়া থেকে বিরত থাকে তবে ক্ষতি হবে ঐ সব শিক্ষার্থীদের। তবে ঐ সময়ের প্রতিবাদে কিছুটা কাজ হয়েছিল। কম্পিউটারের দাম কিছুটা কমে যায়। কিন্তু ক্ষতি হয় অন্য দিকে। অঙ্কুর থেকে সাতচল্লিশটি কম্পিউটার, তিনটি প্রজেক্টর ও তিনটি প্রিন্টারের দাম ও তা সংস্থাপনের জন্য চার লক্ষ টাকা দেয়া হয় ত্রিমাত্রিককে।

গত ২৪ জুলাই কম্পিউটার ল্যাব উদ্বোধন করার জন্য মি: জাভিয়ার ঢাকা থেকে রাঙ্গামাটিতে যায়। তিনি সাথে করে নিয়ে যান অঙ্কুরের মাষ্টার ট্রেইনারকে। যিনি বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের বাংলায় স্থানীয়করণকৃত সফটওয়্যারগুলো কম্পিউটারে ইনস্টল করা শেখাবেন ও তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করবেন।

অঙ্কুরের মাষ্টার ট্রেইনার ওখানে গিয়ে দেখেন যে দুইটি বিদ্যালয়ে কম্পিউটার দেয়া হয়েছে মোট ৩৩ টি। একটি তে ১৮টি ও অন্যটিতে ১৫ টি। বাকি কম্পিউটারের কথা জানতে চাইলে ওখানকার উপজেলা চেয়ারম্যান জানায় বাকিগুলোর ১২ টি দেয়া হয়েছে আনন্দ মাল্টিমিডিয়াকে। বাকি দুটি নাকি অঙ্কুরের অফিসে।

চেয়ারম্যানের কথা যখন এসেই পড়েছে তাহলে তার সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা যাক। আমার দেখা মতে এই যুগে তিনি বেমানান। তিনি ৪৭ টি কম্পিউটার পেয়েছেন এই মর্মে সাক্ষর করেছেন। অথচ তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে ৩৩ টি কম্পিউটার। তিনি দুইটি বিদ্যালয়ের সভাপতি, তাকে এক প্রকার হুমকি দেয়া হয়েছে। ঐ ফরমে সাক্ষর না করলে তার বিদ্যালয়ে কম্পিউটার দেয়া হবে না। তাই তিনি বিদ্যালয়গুলো যাতে কম্পিউটার পায় তার জন্য অসহায় হয়ে সাক্ষর করেছেন। তাকে জানানো হলো যে অঙ্কুর থেকে ৪৭ টি কম্পিউটার ও তার সংস্থাপনের জন্য চার লাখ টাকাও দেয়া হয়েছে। তিনি ত্রিমাত্রিকের দুর্নীতি দেখে থ'। তার কাছে নাকি বেশ কিছু টাকাও চাওয়া হয়েছে, কম্পিউটারগুলো আনা নেয়ার জন্য। তিনি এখনো টাকা দেয়নি। ত্রিমাত্রিকের একাউন্টে দিতে চাইলে ত্রিমাত্রিক একাউন্ট নাম্বার দেয়নি ও নগদ টাকা চাওয়ায় তার সন্দেহ হয়। কারন যারা ৪৭ টি কম্পিউটার দিতে পারে তারা কি সামান্য সংস্থাপনের জন্য টাকা নিবে। পরে তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারে টাকা দাবি করেছে ওমর ফারুক।

কম্পিউটারগুলো দেয়ার ব্যাপারে আর্থিক সহায়তা করে ওয়ার্ড ফোর্জ ফাউন্ডেশন ও অঙ্কর আইসিটি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন। কিন্তু অনুষ্ঠানে কোথায় অঙ্কুরের নামও উচ্চারণ করা হয়নি। বরং জাভিয়ার যখন অঙ্কুরের নাম বলে তখন তার অনুবাদের সময় মি: ফারুক কৌশলে অঙ্কুরের নাম এড়িয়ে যায়। এছাড়া অঙ্কুরের মাষ্টার ট্রেইনারকে ত্রিমাত্রিক কোন রূপ সহায়তা করেনি। শিক্ষকরাও জানতেন না অঙ্কুরের অবদান।

কম্পিউটারগুলোতে জাভিয়ার চেয়েছেন বাংলায় অনুবাদকৃত সফটওয়্যারগুলো দিতে কিন্তু ত্রিমাত্রিক কম্পিউটারগুলোতে ডিপফ্রিজ দিয়েছেন। ফলে কম্পিউটারগুলোতে প্রশিক্ষণের সময় বাংলায় অনুবাদকৃত সফটওয়্যারগুলো দেয়া সম্ভব হয়নি। পরে অবশ্য ডিপ ফ্রিজ ডিজেবল করে রাখা হয়েছিল।

সবচেয়ে দুঃখের কথা হলো- জাভিয়ারের প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ড ফোর্জ কাজ করে বিনামূল্যে প্রাপ্ত, স্থানীয়করণকৃত ও মুক্ত সফটওয়্যার নিয়ে। যাতে মানুষ সহজে কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু তার উপহারের কম্পিউটার পেল আনন্দ মাল্টিমিডিয়া!!! যাদের নিজেদের সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান আছে। যারা কপি রাইটের জন্য মামলাও করতে পারে। যারা চায় যাদের টাকা আছে তারাই কম্পিউটার ব্যবহার করুক। তারা কি করে এই কম্পিউটারগুলো পায়??? গরীবের সন্তানের জন্য দেয়া কম্পিউটার দুই একজন মানুষের জন্য এভাবে হাত ছাড়া হয়ে যায়। আর আমরা অসহায় হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি।

আমাদের কিছুই করার নেই। স্থানীয় পত্রিকাগুলো এ বিষয়ে রিপোর্ট দেয় যে বিদ্যালয়গুলো মোট ৪০/৪১ টি কম্পিউটার পেয়েছে। কিন্তু সবাই দেখে ৩৩ টি । বাকিগুলো কোথায় সাংবাদিকরা তা জানতেও চায়না। যেন মনে হয় তারা জানেই, বাকি গুলো কোথায়??

কয়েকটি পত্রিকায় এ সংক্রান্ত লিংক দেয়া হলো-
http://bit.ly/q5KfEe
http://bit.ly/n07woW
http://bit.ly/o2UNtJ


আর কতদিন আমরা অসহায় থাকবো?? থাকবো ত্রিমাত্রিকের মতো প্রতিষ্ঠানের হাতে বন্দি??
আপনার মন্তব্য লিখুন

ফেসবুক লাইক ও শেয়ার