Thursday, December 6, 2018

শেষ চিঠি

ডালে পাঁচ ফোড়ন দিয়ে রান্না শেষ করল হাবিবা। আজ আয়োজন সামান্য, ডালের সাথে মাছ ভাজি আর ভর্তা। শরীরটা তেমন ভালো নেই তাই বেশি পদ রান্না করা হয়নি। ডালে পাঁচ ফোড়ন দিলে তেমন স্বাদ পান না, খেতে কষ্ট হলেও কিছু করার নেই। এই বাড়ির সবারই পাঁচ ফোড়ন পছন্দের। ডাল রান্না করলে এটা থাকতেই হবে।

ছোট ছেলেটা ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। মেঝো মেয়ে সেই সকাল আটটায় বের হয়ে গেছে, তখনও বিছানা ছাড়েনি হাবিবা। শরীরটা ভালো না থাকায় সকালে উঠতে ইচ্ছে হয়নি। আতোয়ার অফিসের কাজে দুদিন হল রংপুর গেছে। আরও তিনদিন থাকবে। বড় ছেলে কক্সবাজার মেডিকেলের হোস্টেলে থাকে। বাসায় তিনজন মাত্র সদস্য এখন। তাও কাজের কমতি নেই। ছেলেমেয়েদের কাপড় কাচা, রান্না, ঘরদোর পরিষ্কার করা সব তাকেই করতে হবে।


ছেলেটা বের হয়ে গেলে বাসা একেবারেই খালি হয়ে গেল। এই বাড়ির সেই কর্তী তাও যেন নিজের মতো করে কিছু করার নেই, চাইলেই এখন বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়তে পারেন না, শরীর অসুস্থ হলেও কাজ করতে হবে। ছুটি নেওয়ার কোন অপশন নেই।

সেই কত বছর আগে পড়াশোনার মাঝেই এই সংসারে এসেছিলেন তারপর থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে সেবা দিয়েই যাচ্ছে। একটা ভুলে তার আজ এখানে আসা। কলেজে থাকতে ভালোবাসা ভর করেছিল মনের কোনায়, তার মাশুল আজও গুনতে হচ্ছে। কলেজে পড়ার সময় বড় ভাইয়ের বন্ধু পড়াতে আসতো। ছেলেটি পড়াত কবিতা গল্প আর হাবিবা পড়ত ছেলেটির মন। তাই খুব দিন লাগেনি ছেলেটির প্রেমে পড়তে।

পড়াশোনা লাটে উঠত, ছেলেটি উঠতে দেয়নি। প্রেম ও পড়া দুটোই চালিয়ে যেতে সহায়তা করলো। ফলাফল হলো দারুণ, পড়াটা প্রকাশ পেল ক্লাশে ভালো ফল করায়, আর প্রেমটা প্রকাশ পেল অতি উৎসাহে। ভাইয়ের বন্ধু, দেখতে শুনতে পড়ায় মন্দ না, অবস্থাও ভালো এই সব ভেবে হাবিবা ভেবেছিল প্রকাশ পেলেই কি? না হয় জানলো সবাই। সেই জানাটাই কাল হলো। বাবা মানতে পারেনি এই সম্পর্ক।


জলদি ছেলে খুঁজে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন। তখন হাবিবার সাধ্য ছিল না বাবার মুখের উপর কিছু বলার। আর ছেলেটিও কিছু করতে পারেনি, সংসার করার মতো সামর্থ্য তখন ছিল না। মেনে নিতে হয়েছিল এই বিচ্ছেদ। তবে বিয়ের আগে শুধু বলতে পেরেছিল, তুমি হয়ত আজ থেকে অন্যের হবে। কিন্তু আমার থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না, তুমি সব সময় থাকবে আমার মনের মাঝে।


আজ থেকে শত বছর পরে হলেও আমি তোমাকে চাইব এখন যেমন চাই তেমন করে। তুমি কি আসবে তখন আমার ডাকে? একদিন আমি তোমার যোগ্য হবো তখন কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না।

হাবিবা সেই থেকে আজও অপেক্ষায় থাকে। কখন তার ডাক পাবে। তবে ডাকের অপেক্ষায় থাকে মানে এই না যে সংসার থেকে বিচ্যুতি ঘটেছে। সংসারে কেউ বলতে পারেনি হাবিবা তার প্রতি কর্তব্য পালন করেনি। আতোয়ার পেয়েছে আদর্শ স্ত্রী, না চাইতেই সব পেয়েছে হাতের কাছে। কোন কিছুর অভাব বুঝতে দেয়নি হাবিবা। ছেলে মেয়েরা পেয়েছে একজন আদর্শ মা। সব কিছু সব সময় তৈরি পেয়েছে। কেউ কোন কিছু নিয়ে অভিযোগ করতে পারেনি হাবিবাকে। পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজনদের কাছে যেন এক আদর্শের প্রতীক।

তবে হাবিবা কি পেয়েছে তার খোঁজ কেউ রাখেনি। সবাইকে খুশি করতে গিয়ে নিজের সকল স্বাদ-আল্লাদকে বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে সেই কোন বেলায়। এই সংসারে আসার প্রথম দিনেই বুঝে গেছে তার নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা বলতে কিছু নেই।

আগে প্রেমকে ভাবত স্বর্গীয় বিয়ের পর মনে হলো, এই প্রেমই তাকে সর্বনাশ করছে। আতোয়ারের মুখের উপর কোন কথা কখনও বলেনি, সব সময় ভালো থাকার চেষ্টা করেছে ভালো রাখার চেষ্টা করেছে, পিছে প্রেম নিয়ে খোটা দেয় তাই।

এই করতে করতে সে হয়ত আদর্শ স্ত্রী হয়েছে, তবে দামের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে। সবাই তাকে ভাবে সবার সব কিছু ঠিক করে রাখার জন্য নিয়োজিত কেউ। কেউ তাকে ভালোবাসার পাত্র মনে করেনি।

সংসারে একটা আসবাবের মতো থেকেছে। আতোয়ার কোন কিছু করতে হাবিবার পরামর্শ কখনও নেয়নি। হাবিবার দায়িত্ব ছিল শুধু কাজ করে যাওয়া। অনেকটা কর্মী শ্রেণির মতো, উপর মহলের নির্দেশে কাজ করে যায়, কোন ডিসিশন দিতে পারে না। নিজের পছন্দ বলতে কিছু থাকে না এই শ্রমিক শ্রেণির, ঠিক সেই রকম।

সকালের নাস্তা একা একাই শেষ করলো হাবিবা, ভাবল একটু ঘুমিয়ে নিলে কেমন হয়। কাজ আছে, তবে ইচ্ছে হলো কাজে ফাঁকি দেওয়ার। বিছানায় শুয়ে শুয়ে নানান কিছু ভাবছিল, এই সময়ে কলিং বেলের আওয়াজ। একটুও শান্তি নেই। একটু ঘুমানোর ইচ্ছে ছিল হল না, এই সময়ে কে আসতে পারে?

অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও গেটে গিয়ে দেখে কুরিয়ার সার্ভিসের লোক দাড়িয়ে আছে। তার নামে নাকি চিঠি এসেছে। এই ফোন মেসেঞ্জারের যুগে তার নামে চিঠি? কিছুটা অবাক হলো। নাম দেখে ভাবল ঠিকই তো আছে, কিন্তু কে দিতে পারে চিঠি। তার বাবার বাড়ি থেকে কেউ চিঠি দেওয়ার মতো নেই। বাবা মা সেই কবেই গত হয়েছে। ভাইয়েরা যোগাযোগের দরকার হলে ফোনে কথা বলে। তাকে চিঠি লিখবে কে?

সাতপাঁচ ভেবে ভেবে চিঠি খুলে ফেলল। একপ্রান্ত ছিড়ে একটু উপুর করতে বৃষ্টির মতো ফুলের পাপড়ি ঝরে পড়ল। একি পাগলামী, কে করতে পারে এমন, আতোয়ার তো জীবনেও এমন কিছু করবে না, তাছাড়া খামের উপর হাতের লেখাটা আতোয়ারের না। চেনা চেনা লাগছে আবার মনেও পড়ছে না। তাহলে কে এমন পাগলামী করতে পারে।


পাপড়ী শেষ হলে বের হয়ে এল একটা হলদে কাগজ। লাল কালিতে লেখা,

ভালোবাসি তোমায়, আজও সেই আগের মতোই।

পোড়া চোখ দেখবে তোমায় একটিবার আসতে পারো।


আর কিছু লেখা নেই, শুধু একটা ফোন নম্বর, তবে নাম না থাকলেও চিনতে ভুল হয়নি। হাতের লেখাটা অনেক পরিচিত। এত বছরে একটুও পরিবর্তন হয়নি, লেখার নিচে স্টাইল করে লেখা H লেখাটা লেখকের পরিচিতি আরও ফুটিয়ে তুলেছে। এই স্টাইল করে H একজনই লিখত। সে তার প্রিয়তম হাসিনুজ্জামান।

২০ বছর পর পুরনো প্রেমিকের চিঠি। দেখা করার আকুল আবেদন, সংসারে নিজের অবস্থান সব মিলিয়ে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। বাসায় কেউ নেই। সব যেন কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। কয়েকবার ফোন হাতে নিয়ে আবার রেখে দিলো। সে কি ফোন দিবে? কি বলবে ফোন দিয়ে?

এই করতে করতে দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়ে এলো। আজ সব এলোমেলো, কোন কাজই করা হয়নি, এমন কখনও হয়নি, আজ কেন যে সব ভুল হয়ে যাচ্ছে। দুপুরে খাওয়াও হয়নি। তার মাথায় শুধু একটাই চিন্তা, কি করবে এখন।

কারও কাছে একটু পরামর্শ নিবে সেই রকম কেউ নেই, এত বছরে কোন বন্ধু বান্ধবের সাথে তেমন যোগাযোগ নেই, আতোয়ারের পছন্দ না, তাই সবার থেকে দূরে দূরেই থেকেছে। তবে আজ একজন বন্ধুর খুব অভাববোধ করলো, যার কাছে গিয়ে অন্তত সমস্যাটা বলা যেত। নেই তেমন কেউ নেই। ছটফট করা ছাড়া আর কি করার আছে।

বিকেলের দিকে মেয়ে এলো বাসায়। ব্যাগ টেবিলে রেখে মোবাইল নিয়ে শুয়ে পড়লো। সারাদিনে কি খেয়েছে না খেয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। মোবাইল নিয়ে বসা মানে যতক্ষণ চার্জ থাকবে মোবাইলেই ঘাড় গুজে থাকবে, চার্জ শেষ হওয়া পর্যন্ত এটা চলবে, চার্জ শেষ হলে তবেই ক্ষান্ত।

বারান্দায় চলে এলো হাবিবা, কয়েকটা ফুলের গাছ লাগিয়েছে, সেখানে বসলে মনে কিছুটা শান্তির পরশ এনে দেয়, এই একটি জায়গাই আছে এই বাসায় যেখানে কিছুটা শান্তির পরশ পায়, তার নিজের নিজের মনে হয়।

হাবিবা হেলানো চেয়ারে বসে সকাল থেকে সবটা আবার মনে করার চেষ্টা করলো। এই সংসারে তার অবস্থান নিয়ে আবার ভাবতে বসল। বিয়ের পর থেকে শুরু হয়েছে সবাইকে খুশি রাখার নিরন্তর চেষ্টা। কে কি করলে খুশি হয় তা ভেবে চিন্তে পা ফেলে সে। এই করতে করতে তার নিজের বলতে আর কিছুই থাকেনি। বিয়েতে কোন শাড়ি পড়বে, ঘুরতে গেলে কি পোষাক পড়বে, ইদে কোন ড্রেস কিনবে সব কিছুতে কখনও স্বামী, কখনও ননদদের পরামর্শ নিয়েছে। নিজের চাওয়া পাওয়া বলতে কোন কিছু যেন তার নেই। কেউ কখনও বলেনি তোমার পছন্দে কেনাকাটা কর। কেন যেন নিজেকে এই মূহুর্তে বসার হেলানো চেয়ারের মতো লাগছে। সংসারে কাজে আসে কিন্তু নিজে কোথায় বসবে তার মতামত দেওয়ার জায়গা নেই। বাড়ির মানুষ যেখানে মন চায় সেখানেই বসিয়ে বাড়ির শোভা বাড়ায়। এভাবে আর কতদিন। হয়ত এটাই জীবনে একটা মুক্তির চিঠি, হাবিবা ভাবল এই চিঠিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এভাবে থাকা যায় না, ছেলে মেয়েরা বড় হয়েছে। এখন আর তাকে দরকার নেই। ওরা একাই থাকতে পারবে।

আর কত এভাবে আসবাব হয়ে থাকবে, জীবনে বাবা মায়ের মুখ চেয়ে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে আর না, এত ত্যাগ স্বীকার করায় কেউ জিজ্ঞেস করেনি সে কেমন আছে। তাহলে আর কি হবে এই সংসারে থেকে। হয়ত সমাজ তাকে অনেক কথা শোনাবে। শোনাক, সে কি এতদিন সমাজের কেউ ছিল, যার ঘরেই কোন মত প্রকাশের ক্ষমতা নেই সে সমাজের সদস্য হয় কি করে?

ফোনটা হাতে তুলে নিলে। সকালে চিঠিতে দেওয়া নম্বরটা মুখস্ত করে নিয়েছে। চিঠিটা কোথাও রাখার মতো জায়গা পায়নি, তাই নষ্ট করে দিয়েছে তবে মনের খাতায় লিখে রেখেছে সবকয়টি কথা। একে একে নম্বরগুলো ফোনের ডায়াল কলে লিখে নিয়ে কল বোতামে টাচ করলো। কল চলে গেল সেই কতক্ষণ, কেউ ধরছে না ওপাশে। টানা রিং বেজে একসময় বন্ধ হয়ে গেলে ডায়াল টোন, তবুও কানে ধরা ফোনটি। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ফোন নামিয়ে রাখল কান থেকে।

একজন মানুষ নানান কারণে ফোন নাও ধরতে পারে। তবুও কেউ ফোন না ধরলে বিরক্ত লাগে। কিন্তু বিরক্ত লাগার কি আছে। ফোন সব সময় কাছে থাকে ইয়ং বয়সীদের। তার বয়সী বা তার চেয়ে বেশি বয়সীরা ফোন একটু দূরেই রাখে। এই বয়সে ফোন নিয়ে কি করার আছে?

আর ফোন দিবে না হাবিবা, কেন যেন একরাশ অভিমান ঘিরে ধরলো তার মনে। কেন ফোন পাওয়া মাত্র ফোন ধরলো না, সে কি জানে না, তার জন্য কত বছর অপেক্ষায় আছে। ফোন নম্বর দিলই বা যদি তবে কেন ফোনকে দূরে রাখলো? আর কখনও ফোন দিবে না। এতদিন এভাবে থাকতে পারলে এখনও পারবে। তার কাউকে লাগবে না।

রাতে ছোট ছেলেটাও বাসায় ফিরল। রাতে খাওয়ার সময় সবাইকে একসাথে পাওয়া যায়। বাকি দিন যে যার মতো। টুকটাক কথা হয় তখন। তবে ইদানিং তাও কমে যাচ্ছে। খাবার টেবিলেও ওরা মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কেমন যেন সবাই সবার মতো ব্যস্ত, পাশের জনের খবর নেওয়ার মতো অবস্থাই নেই, সময়ও যেন নেই। তবে বন্ধুরও অভাব নেই কারও। ফেসবুকে হাজার হাজার বন্ধু, পাশে যে বসে আছে তাকে যেন চেনেই না।

আজ ছেলেমেয়েদের খোঁজ নিতে ইচ্ছে হলো, আসলে নিজেকে ভুলে থাকার চেষ্টা মাত্র। দুয়েক কথায় বুঝল ছেলে মেয়েরা কথা বলতে আগ্রহী না, হয়ত তাদের সাথে এতদিনে অনেক দূরুত্ব সৃষ্টি হয়ে গেছে। ওরা খেয়ে যে যার রুমে চলে গেল। খাওয়ার টেবিলে বসে ভাবল এ কেমন জীবন, সে কি এই সংসার চালানোর একটা যন্ত্র মাত্র?

রাতে সবাই ঘুমানোর পর আবারও ফোন দিল, একবার দুইবার রিং হতে ফোন ধরলো কেউ একজন, হ্যালো বলতেই কি যেন হয়ে গেল হাবিবার। এতবছর পর কণ্ঠটা শুনল কিন্তু একই আছে। এর আগে কখনও ফোনে তার কণ্ঠ না শুনলেও এখন শুনে বুঝতে অসুবিধা হয়নি, এটা তার সেই হাসিমুজ্জামান।

সারাদিন ধরে যে অভিমান ছিল তা এক নিমিষে দূরে সরে গেল। কথা বলতে গিয়ে দেখলো গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। কি বলবে সে, কোন কথাই খুঁজে পেল না, ফোনটা কানে ধরে রইলো। ওপাশ থেকে দুয়েকবার হ্যালো বলার পর নিরব থাকলো।

হাবিবা ভেবেছিল হয়ত ওপাশে ফোন রেখে দিয়েছে, তার ভাবনায় ছেদ পড়লো ফোনে আওয়াজ শুনে। ওপাশ থেকে বলল, আমি জানি তুমি কে, জানি কথা বলতে ইচ্ছে করছে বাট বলতে পারছ না, বলতে হবে না, শুধু একটু আওয়াজ করলেই হবে, আমি বুঝে নেব সেটা তুমি।

মনে হলো অনেক কষ্ট করে কেউ বলছে। তাহলে কি হাসিমুজ্জামান অসুস্থ? তার কিছু হয়েছে। অস্থির অস্থির লাগল কিন্তু কিছু জিজ্ঞাসাও করতে পারল না। লজ্জা, ভয় না সংকোচ? বুঝতে পারলো না তার মাঝে কি কাজ করছে।

ফোন কেটে রেখে দিল মাথার কাছে। সারারাত ঘুম হবে না, ওষুধের বাক্সে রাখা নানান বর্ণের ওষুধ থেকে রিলাক্সেন বেছে নিয়ে তার থেকে একটা খেয়ে নিল। ডাক্তার দিয়েছে ঘুম না হলে খাওয়ার জন্য। সব সময় থাকে ঘরে, তবে খাওয়া হয় না। আজ একটা খেয়ে নিলো।

ভেবেছিল ঘুম হবে না কিন্তু চমৎকার ঘুম হল, সাথে স্বপ্নও ছিল, কি আশ্চর্য এতবছর পর লোকটা স্বপ্নে দেখা দিল, একটুও বদলায় নি, সেই আগের লোকটাই রয়ে গেছে। সবার জন্য নাস্তা বানিয়ে নিজে খেয়ে বারান্দায় চায়ের কাপ হাতে বসে ভাবছে হাবিবা। এটা কি হলো। কেন তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবে।

হঠাৎ কি মনে হতে ফোনটা তুলে নিল হাতে। ডায়াল করল রাতেই সেই নম্বরে। একবার রিং হতে না হতেই ফোন রিসিভ করলো ওপাশে। মনে হলো কেউ একজন ফোন হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছিল কখন রিং হবে।

এবার আর জড়তা নেই। হ্যালো বলতেই হাবিবা বলল, কেমন আছো? একটু বিরতি। মনে হলো ওপাশে কেউ কি বলবে তা মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছে। হাবিবা আবারও সেই কণ্ঠটা শুনতে পেল, তবে স্পষ্ট বোঝা গেল সে অসুস্থ। একটু দম নিয়ে হাসিমুজ্জামান বলল, ভালো আছি, অনেক ভালো আছি এখন, তুমি কেমন আছো।

হাবিবা যেন অনেকটা সহজ হতে পারছে। হাসি হাসি মুখে বলল, তুমি ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকি। কোথায় আছো এখন, কোথায় গেলে পাবো তোমায়?

হাসিমুজ্জামান বলল, আমি তো আছি তোমার কাছে, খুঁজে দেখ আমায় পাবে। তুমিতো আমায় পেলে তোমার কাছেই আছি হারাই নি, আমি কি আছি তোমার কাছে?

হাবিবা উত্তর দিলো, আমি তোমারই আছি। হয়ত এতবছর ঘর সংসার করতে হয়েছে কর্তব্যের খাতিরে কিন্তু আমি তোমারই ছিলাম আছি সব সময়। তুমি আমায় নিয়ে যাও আমি আর পারছি না এই সংসারে টিকে থাকতে।

হাসিমুজ্জামান বলল, তুমি পারবে সব ছেড়ে আমার কাছে চলে আসতে। আমি আজও তোমার অপেক্ষায় আছি, তোমাকে না পাওয়ার ব্যাথা একবারের জন্যেও ভুলতে পারিনি, আজও তোমায় ভালোবাসি ঠিক আগেরই মতোই।

হাবিবা বললে, আমি পারব, সব ছাড়তে, আসলে কি বলব তোমায়, যদিও বলছ সব ছেড়ে, সব পাবো কোথায়, আমি কারও আপন হতে পারিনি। সব বলতে তাই আমার আমি ছাড়া কেউ নেই। তুমি আমায় গ্রহণ করবে? আমি অনেক ক্লান্ত আর চলতে পারছি না। আমাকে উদ্ধার কর। আমি বাঁচতে চাই।

হাসিমুজ্জামান তার ঠিকানা দিয়ে বলল, আমি এখানে আছি, যে কোন সময় তুমি আসতে পারো, আমি তোমার অপেক্ষায় আছি।

ফোন কেটে দিয়ে ভাবতে বসল হাবিবা, কি করবে এখন। আজ ওর স্বামী আসবে। বাসায় কেউ নেই, ছেলেমেয়েরা সবাই বাইরে চলে গেছে। অস্থির অস্থির লাগছে। কি করবে ভাবতে বসল। এতদিন থাকতে থাকতে এই সংসারের প্রতি মায়া জন্মে গেছে কিন্তু তার প্রতি কারও মায়া জন্মেনি, ওরা বাইরে গেল কেউ বলেও গেল না যে যাচ্ছে। যেন মা বলতে কেউ নাই।

অনেক ভেবে মনটা ঠিক করলো। এভাবে আর না, এই সংসার আর করবেনা। টেবিল থেকে খাতা কলম বের করে লিখতে বসলো-

       'আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি এই সংসার সংসার অভিনয় করতে গিয়ে। মুক্তি চাই। আমায় ক্ষমা করো।'


আর কিছু লেখার মতো পেল না, কি লিখবে আর, যে এতবছরেও তাকে বুঝতে পারেনি, কোন মূল্য দেয়নি তাকে বিস্তারিত লেখার প্রয়োজন মনে করল না।

ভেবেছিল বড় একটা ব্যাগে কিছু দরকারি জিনিস নিয়ে বের হয়ে আসবে। কিন্তু এই সংসার থেকে কিছু নেওয়ার মতো পেল না, হাসিমুজ্জামান নীল রং পছন্দ করে। অনেক বছর আগে নীল রংয়ের একটা শাড়ি কিনেছিল, যদিও ওর স্বামীর নীল রং পছন্দ না, তবুও একটু জিদ করেই কিনেছিল, সেই শাড়িটা পড়ে নিল। মাথায় চিরুনি দেয় পরিপাটি হয়ে বাইরে বের হয়ে এলো, হাসিমুজ্জামান বেশি প্রসাধন পছন্দ করেনা, তাই বেশি সাজার ইচ্ছে জাগলো না, এমনিতেও হাবিবা সাদামাটা থাকতে পছন্দ করে।

বাসার কাছেই সিএনজি পেয়ে গেল, মোবাইলে বলা ঠিকানার কথা বলতে সিএনজিওয়ালা চিনতে পারলো। ভাড়া ঠিক করে হাবিবা উঠে বসলো সিএনজিতে। যেতে যেতে কত কথাই মাথায় এলো, একদিকে অনাগত দিনের ভাবনা একদিকে ফেলে আসা ঘরের কথা দুটোই মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো।

সিএনজিওয়ালার ডাক শুনে বুঝতে পারলো চলে এসেছে, ভাড়া মিটিয়ে নির্দিষ্ট বাড়ির সামনে দাঁড়ালো, দুরু দুরু বুকে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেলে চাপ দিল। একটা ছোট ছেলে এসে দরজা খুলে দিল। হাবিবা কিছু বলার আগেই বলল, স্যার ঐ ঘরে আছে চলুন।

হাবিবা ধীর পায়ে এগিয়ে চলল ভেতরের দিকে একটা ঘরের দিকে। পর্দা সরিয়ে বিছানায় যাকে শুয়ে দেখতে পেল সেই যে হাসিমুজ্জামান তা ভাবতে কষ্ট হলো। এ কি হাল হয়েছে, শুকনো একটি মানুষ শুয়ে আছে বিছানায়, ভাবতে কষ্ট হচ্ছে এ তারই হাসিমুজ্জামান। গুটি গুটি পায়ে বিছানার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তার আসা টের পেয়ে চোখ খুলল হাসিমুজ্জামান। আগের চেহারা না থাকলেও হাসিটা আছে। এই হাসি দেখেই প্রেমে পড়েছিল হাবিবা।

কষ্ট নিয়ে বলল, তুমি এসেছো। জানো না কি খুশি হয়েছি আজ আমি। জানতাম তোমাকে দেখতে পারব, আমার ইচ্ছেটা পূরণ হলো আজ। খুব ইচ্ছে ছিল অন্তত মৃত্যুর আগে হলেও যেন একবার তোমাকে দেখতে পাই। আজ আমার আশা পূরণ হয়েছে। জানিনা কতদিন বাঁচব, আমার আশা পূরণ হয়েছে আজ মরে গেলেও শান্তি।

যতটুকু কথায় বুঝল হাসিমুজ্জামান এতদিন বাইরেই ছিল। হঠাৎ করে লিভারে প্রবলেম দেখা দেওয়ায় তারা দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। বেশিদিন বাঁচবে না, অনেক কষ্টে ঠিকানা বের করেছে হাবিবার। একবার দেখার আশায় চিঠি পাঠিয়েছে, ভেবেছিল হাবিবা হয়ত আসবে না, হয়ত ভুলেই গেছে।

হাবিবা কিছুই ভুলেনি। সে যে একেবারে চলে এসেছে তা বলার মতো সুযোগ আর হলো না, এর মাঝেই অসুখ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেল। যে ছেলেটি দরজা খুলে দিয়েছিল সেই ছেলেটিই কয়েক জায়গায় ফোন দিল, একটু পরই ডাক্তার চলে আসলো। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিতে বললো। হাবিবা আর ছেলেটি মিলে এম্বুলেন্স ঠিক করে হাসপাতালে নিয়ে গেল। তবে সেখানে ডাক্তারেরা কোন আশ্বাস দিতে পারলো না। আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হলো। কিন্তু কোন লাভ হলো না, ঢাকায় তেমন কেউ নেই, যে দুয়েকজন ছিল তাদের ফোন দেওয়া হলো। একটু পর দুএকজন এসে হাজির হলো।

হাবিবা দেখলো এখানে তার তেমন কোন কাজ নেই। আস্তে করে সবার অগোচরে বাইরে চলে এলো। সামান্য বৃষ্টি হচ্ছে। আজকের বৃষ্টিটা অনেক কাজে লাগল। তার চোখের জল কেউ দেখতে পেল না।

রাস্তায় হাঁটছে হাবিবা। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে সেদিকে কোন খেয়াল নেই। নিজের মতো হেঁটে যাচ্ছে। রাস্তার পাশে লোকগুলো তাকিয়ে আছে। ভাবছে এই মধ্য বয়সী মহিলা কি পাগল হয়ে গেল? এই বয়সে কেউ এভাবে ভিজে?

না আজ আর কোন ভাবনা নেই মাথায়। পথ চলতে অনেকটাই ভালো লাগছে। হাঁটতে হাঁটতে মনে ভাবল কোথায় যাবে সে?


মুশফিকুর রহমান
কক্সবাজার
০২-১২-১৮ থেকে ০৪-১২-১৮
আপনার মন্তব্য লিখুন

ফেসবুক লাইক ও শেয়ার