Wednesday, September 24, 2014

ওয়ারিশ

এক

কাসেম পুনরায় হিসাব লেখা খাতা হাতে নিল।

সব মিলিয়ে হাজার পঞ্চাশেক টাকা। এই বাজারে পঞ্চাশ হাজার টাকা অনেক টাকা। কাসেম মাকে বলল, তুমি আজকেই মামার বাড়ি যাবে। গিয়ে মামাকে বলবে তোমার প্রাপ্য যেন তোমাকে বুঝিয়ে দেয়।

মনোয়ারা বেগম কাপড় ভাঁজ করছিল, ছেলের কথায় কাপড় ভাঁজ করা বাদ দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। মৃদু গলায় বলল, কাজটি কি ভাল হবে, বাপের বাড়ির ওয়ারিশ আনলে লোকে কি বলবে?

লোকে কি ভাববে তাতে কিছু যায় আসে না।
বাইরের লোক কি আমাদের খাওয়ায় না পড়ায়। তাদের কথা অনুসারে চললে কি হবে?

মনোয়ারা বেগম ছেলেমেয়েদের কথার উপর কথা বলে না। শুধু তার ছেলেমেয়ে কেন কারও উপরই তিনি দৃঢ় গলায় কথা বলতে পারে না। চিরকালই মৃদুভাষী। এবারও তাই মৃদু ভাবে বলল, কিন্তু বাবার বাড়ীর ওয়ারিশ নিলে কিন্তু ও বাড়ীর সাথে সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে।

কাসেম এই কথায় কিছুটা উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল। কড়া কথা শোনাতে গিয়ে কি মনে করে শান্ত গলায় বলল, সম্পর্কটা কি এখনও তেমন কিছু আছে মা? তুমি যখন ও বাড়ীতে যাও তখন মামী তোমার সাথে কি আচরণ করে তা মনে নেই ? এমন ভাব করে যেন কি বিশাল রাজরানি আর আমরা সবাই হলাম পথের ভিখারি। যেন ওবাড়ীতে চিরদিনের মতো থাকতে গিয়েছি।

মনোয়ারা ভেবে দেখল কাসেম ঠিকই বলছে। ও বাড়ীতে বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন আদর সমাদর অফুরন্ত ছিল। কিন্তু যখনই বাবা মারা গেল তখনই আদর যত্ন সব শিকেয় তোলা হল।

মনোয়ারা চুপ করে থাকায় কাসেম বলল, কি হল কিছু একটা বল।

আমি কি বলব? দুঃখ তো আমারও হয়। কিন্তু হাজার হলেও...

কি বলবে মানে, কাসেম রাগের গলায় বলে, চল কালই যাই, তুমি মামাকে বলবে সে যেন হজ্বে যাওয়ার আগেই সব ঝামেলা মিটিয়ে যায়। না হলে কিন্তু...

কাসেম কথা শেষ না করেই ঘর থেকে বের হয়ে যায়। মনোয়ারা সে দিকে চেয়ে থেকে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে।

মনোয়ার কি করবে ভেবে পায় না। সে তার মেঝ ছেলেটাকে হাড়ে হাড়ে চিনে। ছেলেটা দুই দুইবার করে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েও পাশ করতে পারে নি। স্যারেরা বলে ওর মাথা নাকি গোবরে ভরা। কিন্তু মনোয়ারা জানে কি বুদ্ধি ও রাখে। তার তিন ছেলের মাঝে একমাত্র কাসেমই বিষয় সম্পত্তি সম্পর্কে ভাল জ্ঞান রাখে। কিসে তাদের মঙ্গল কিসে তাদের অমঙ্গল তা কাসেম ভাল করেই জানে।

মনোয়ারার বড় ছেলে মাজেদ পড়ালেখা শেষ করে বসে আছে। চাকরী পাচ্ছে না, জিজ্ঞেস করলে বলবে, চাকরী খুঁজছি কিন্তু পাচ্ছি না। আর পাবেই কি করে। ওরকম ছেলেকে চাকরী দিবেই বা কে? ছোট বেলা থেকেই কিছুটা বোকা সে। সারাদিন ঘরের কোনায় বসে থাকে। বাস্তব বুদ্ধি তার অনেক কম। শুধু পাঠ্যবইই শিখতে পেরেছে আর কিছু শিখতে পারেনি।

আর ছোট ছেলেটা এবার মাত্র এসএসসি পরীক্ষা দিবে। দেখে মনে হয় বড় ভাইয়ের মতোই হবে। সারাদিন বই নিয়ে বসে থাকে। আর দশটা ছেলের মতো মাঠে খেলতেও যায় না। বাইরেও বেশি যায় না।

দূর মসজিদ থেকে আযান ভেসে আসে। কথায় কথায় কখন যে সন্ধা হয়ে গিয়েছে, মনোয়ারার তা খেয়ালই করতে পারেনি। খেয়াল হতে দ্রুত হাতে সুইচ টিপে ঘর আলোকিত করে দিল। বাইরে গিয়ে ওজু করে নামাজ পড়তে বসল। নামায শেষ হতে না হতে মাজেদের বাবা বাড়ী ফিরে আসল।

সাদেক আলী রোজ সন্ধায় বাড়ী ফিরে। তার অফিস বাড়ী থেকে প্রায় সাত আট কিলো দূরে। এই টুকু রাস্তা সে বরাবরই সাইকেলে চলে। সেই সকাল আটটায় বের হয়ে যায় ফিরে সন্ধায়। বাড়ী ফিরে তার প্রথম কাজ বাইরে রাখা মগের পানিতে হাত মুখ ধুয়ে সারাদিনের ক্লান্তি ঝরিয়ে ফেলা। এরপর কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে থাকে।

মনোয়ারা নামায শেষ করে স্বামীর পাশে এসে বসল। শান্ত গলায় বলল, তোমার সাথে কিছু কথা আছে।

সাদেক এমনিতেই প্রায় সবসময় গম্ভীর থাকে। আজ কেন যেন হাসি মুখে বলল, বল কি বলবে?

মনোয়ারা স্বামীর এমন হাসি মুখ অনেকদিন দেখেন নি। তাই আজ এই হাসি মুখ দেখে তার মাঝে দ্বিধা এসে ভর করে। অজানা এক আশংকায় তার বুকটা কেঁপে উঠে। সেই কাঁপা বুকে বলে, তোমার কিছু হয়েছে?

না তো, কি হবে? সাদেকের সংক্ষিপ্ত জবাব।

তবে আজ তোমার মুখটা কেমন যেন লাগছে?

এই কথায় সাদেকের মুখটা আবারও গম্ভীর হয়ে যায়। এই গম্ভীর মুখ নিয়েই বলে, কি যেন বলতে চেয়ে ছিলে?

সাদেকের গম্ভীর মুখ দেখে মনোয়ারা নিশ্চিত হয়। এবার নিশ্চিন্ত মনে বিকেলে মা ছেলের মাঝে হয়ে যাওয়া কথাগুলো বলে। কথা শেষ করে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে, তোমার কি মত?

সাদেক কিছুটা সময় চিন্তা করে বলে, তোমরা মা ছেলে মিলে যেটা ভাল হয় সেটাই কর। আমি এর মাঝে নেই।

মনোয়ারা বুঝল, যা করার তাকেই ভেবে চিন্তে করতে হবে। তার স্বামী এ ব্যাপারে কোন মতামত দিবে না।

দুই

স্কুলে যাওয়ার সময় হয়েছে, আঁখি তাই ব্যস্ত নিজেকে সাজাতে। তাকে সহায়তা করছে আছিয়া বেগম। মেয়ে এখনও চুল বাঁধতে শিখেনি। তাই মাকেই এই দায়িত্ব পালন করতে হয়। আঁখি নবম শ্রেণীতে পড়ে। তার ক্লাশ শুরু হবে এগারোটায়। আছিয়া একমনে মেয়ের চুল বাঁধছে। আঁখির চুল খুব একটা লম্বা না, যত্ন না নিলে জট পাকিয়ে যায়।

সনি ঘর ঝাড়ু দেওয়া শেষ করে আছিয়া বেগমের সামনে এসে দাঁড়াল। মামিকে বরাবরই তার ভয় হয়। সনিকে একটু আগে ঘর ঝাড়ু দিতে বলা হয়েছিল, সে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে মামির সামনে এসে বলল, কাজ শেষ এবার স্কুলে যাই?

আছিয়া ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে সনির দিকে তাকিয়ে বলল, স্কুলে যাই?? বললেই হল, তোর মার অসুখ, সব কাজ করবে কে? আমি? আজ তোর স্কুলে যেতে হবে না। যা আঁখি স্কুলে যাবে ওকে খাবার বেড়ে দে। ইশ কত বেলা হল, মেয়েটা এখনও না খেয়ে আছে। না খেতে খেতে মেয়েটা শুকিয়ে গেল।

সনি মুখ নিচু করে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। আজ তাদের নতুন অধ্যায়ের অংক শেখাবে। সনি এবার দশম শ্রেণীতে পড়ে। আজ যে অধ্যায় করাবে তার শুরুর ক্লাসে থাকতে না পারলে পরে সমস্যা হয়ে যাবে। কিন্তু এ বাড়িতে মামির উপর কথা বলবে এত বড় সাহস কার?

রান্না ঘরে বসে আঁখি ভাত খাচ্ছে। সনি সামনে বসে তদারকি করছে। তরকারীর বাটি থেকে একচামচ তরকারী নিয়ে আঁখির পাতে দিল। একবার দরজার দিকে চেয়ে মামির অবস্থান বুঝে নিয়ে বলল, আঁখি বোন আমার একটা কাজ করে দিতে পারবি?

কি কাজ, সনি আপু?

আমাদের ক্লাসের মমতাজকে বলবি, আজ আমি স্কুলে যেতে পারব না, ও যেন ওর খাতায় আজ যে অংকগুলো তুলবে তা তোর কাছে দিয়ে দেয়। আমি রাতে গিয়ে খাতা দিয়ে দেব।

সনি এবার দশম শ্রেণীতে পড়ে। এমনিতে পড়াশোনায় ভাল, কিন্তু ঠিক মত ক্লাস করতে পারেনা। তবে তাকে সহায়তা করে তার বান্ধবী মমতাজ। যেদিন ক্লাস করতে পারে না সেদিন জরুরী বা নতুন কিছু শেখালে তা সনিকে দিয়ে যায়। কিন্তু এভাবে সনির কষ্টই হয়। কিন্তু কি করার আছে?

মানুষে বলে মামা বাড়ির আবদার। কিন্তু সনি জানে আবদার জিনিস টা কি? যাওয়ার জায়গা নেই বলে মায়ের সাথে মামার বাড়ি থাকতে হয়। একসময় তার বাবার যে অবস্থা ছিল তাতে করে মামার বাড়ি থাকার মতো পরিস্থিতি কখনও ছিল না। সনির বাবা-মায়ের বিয়ের পর কেটে গেল তিন তিনটি বছর। এই তিন বছরে কোন সন্তানের দেখা না পাওয়ায় নানান গঞ্জনা সহ্য করতে হল সনির মা খালেদা কে। আর এতে করে এক সময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। সবাই বলে জ্বীনে ধরেছে। এর সাথে যোগ হল মৃগী রোগ। মাঝে মাঝেই হঠাৎ হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যায়। এত সব বিষয় দেখে সনির বাবা এক সময় বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। কোথায় হারিয়ে গেল তা কেউ বলতে পারে না। আর ঠিক চলে যাওয়ার কয়েকদিন পরই খালেদা বুঝতে পারল তার ঘরে নতুন মেহমান কেউ একজন আসছে।

গর্ভে সন্তান আসার সংবাদে সবাই খুশি হয়েছিল। কিন্তু সনির বাবা এই সংবাদ পাওয়া থেকে বঞ্চিত থাকল। তাকে  তখন অনেক খোঁজা হয়েছে। কোথাও পাওয়া যায়নি। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক লোক নিজে থেকে হারিয়ে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।

দিন যায় মাস আসে, একসময় খালেদা সন্তান হওয়ার দিন ঘনিয়ে আসে। ছয় মাস হতে সনির নানা ছামাদ আলী মেয়েকে নিয়ে আসেন বাড়িতে। আরও আগেই নিয়ে আসত কিন্তু জামাই যদি ফিরে আসে তাই অপেক্ষায় ছিল। ছামাদ আলীর অবস্থা ভালই বলা চলে। গ্রামে বেশ কিছু জমিজমার মালিক সে। এক ছেলে তিন মেয়ে। ছেলেটি মাস্টারি করে, বিয়ে করেছে। মাস্টারির আয় আর জমির আয় দিয়ে ভালই চলে যায়।

একসময় সনি পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখতে পেল। কিন্তু তার বাবার মুখ দেখার সৌভাগ্য হল না। বাবা সেই যে বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল আর ফিরে আসার নাম নেই। সনি মেয়ে হওয়ায় তার বাবার বাড়ি থেকে আর কেউ দেখতেও আসেনি। যে জন্মের পর বাবার দেখা পায়নি তার মত অভাগা আর কে আছে। সনির চাচারা আর কেউ দেখতে আসেনি। ছামাদ আলী কয়েকবার খবর পাঠিয়েছে তার মেয়ে ও নাতনীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিন্তু কেউ আসেনি, খবরও নেয়নি। সেই থেকে নানার বাড়ি আশ্রয় মেলে তাদের।

নানা বেঁচে থাকতে কোন সমস্যাই হয়নি সনিদের। ছামাদ আলী মারা যাওয়ার পরই শুরু হয় বিপত্তি। খালেদা আগে ছিল এই বাড়ির মেয়ে, বাবা মারা যাওয়ায় হয়ে গেল কাজের মেয়ে। সব কাজ তাকেই করতে হচ্ছে। না যে করবে তারও উপায় নেই। যায় জামাই নিরুদ্দেশ বাবার বাড়িতে তার অবস্থা কতই আর ভাল হতে পারে। সকাল থেকে রাত অবধি তাকে কাজ করতে হয়। আর ফসলের দিনে তো কথাই নেই।

মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে নিরবে সকল কাজই করে খালেদা। না করে উপায় কি? কে তাকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে। বাবা ছিল যতদিন ততদিন বেশি কিছু করতে হয়নি। বাবা মারা যাওয়ার পরই তাকে সব কাজ করতে হচ্ছে। দিন দিন সনির মায়ের অসুখটা বেড়ে যায়। মাঝে মাঝেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। শরীর কাঁপতে থাকে। ডাক্তার দেখানো হয় না।

সনি কিছুটা বড় হয়ে উঠেছে। সে এখন মায়ের কষ্ট বুঝতে পারে, মায়ের সাথে কাজে কর্মে হাত লাগায়। গ্রামের বাড়িতে কাজের অভাব নেই। আর দশটা কাজের মেয়ের সাথে তার পার্থক্য হল বেশির ভাগ কাজের মেয়েরা স্কুলে পড়ার সুযোগ পায়না, কিন্তু সনির মামা যেহেতু মাস্টারি করে, আর প্রাইমারি স্কুলে যেহেতু খরচ কম তাই স্কুলের যাবার সুযোগ একটা এসেই যায়। কিন্তু সেটাও কাজীর গরুর মতো, খাতায় আছে, গোয়ালে নেই। স্কুলে নাম আছে কিন্তু প্রতিদিন স্কুলের যাবার সুযোগ পায়না। তারপরও প্রাইমারি পাশ করল, হাই স্কুলে ভর্তি হল।

সেই সনি এবার নবম শ্রেণি পাশ করে দশম শ্রেণিতে পা দিয়েছে। তাকে সহায়তা করে পাশের বাড়ির মমতাজ। মমতাজ না থাকলে হয়ত সনির পড়াই হত না। আঁখি বিষয়টা ভালই জানে। এই বাড়িতে একমাত্র আঁখিই বুঝতে পারে সনির কষ্টকে। একবছরের ব্যবধান তাদের বয়সের, আঁখি যেমন বেশির ভাগ কথাই সনির সাথে শেয়ার করে, সনিও ঠিক তেমনই।

তিন


সন্ধায় বাড়ি ফিরল হামিদ মাস্টার। হাত মুখ ধুয়ে ঘরে গিয়ে বসল। আছিয়া বেগম এক গ্লাস শরবত করে দিল। স্বামীর হাসি মুখ দেখে বলল, কি হয়েছে এত খুশি লাগছে যে?
খুশি তো হবই, হওয়ারই কথা। শহরে গিয়ে শুনলাম আমার হজ্জে যাওয়ার সব ঠিক ঠাক। এবার রওয়ানা হলেই হবে।
শরবতের খালি গ্লাস হাতে নিয়ে আছিয়া বলল, কবে ফ্লাইট?

হামিদ একটু হিসেব করে বলল, আগামী মাসের ১৫ তারিখ নাগাদ হতে পারে।

আছিয়া হেসে বলে, তাহলে তো ভালই হবে। তবে শেষ পর্যন্ত যে কি হয়? আমার তো ভয়ই করছে।

হামিদ স্ত্রীর দিকে তাকালেন, চেহেরাতে সত্যিই একটা ভয়ের রেশ লেগে আছে। স্ত্রীর ভয় মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, এবার তাহলে একটা অনুষ্ঠান করে সবাইকে দাওয়াত খাওয়াতে হবে। মুরুব্বিদের দোয়াও নিতে হবে। তুমি কি বল?

হামিদের কথা শুনে দ্রুত আছিয়ার চেহেরা পাল্টে গেল, ভয়ের জায়গা দখল করল রাগ। তার বউয়ের চেহেরার এই দ্রুত পরিবর্তন ঠিক বুঝতে পারেনা হামিদ। আজ এত বছর সংসার করেও বুঝতে পারেনা, কোন কথায় রাগবে, কোন কথায় ভয় পাবে। আছিয়া যখন যা চেয়েছে তখন তাই দিতে চেষ্টা করেছে হামিদ। আছিয়া তার ননদদের সব সময় অবহেলা করে। ননদরা বাবার বাড়ী আসলে ঠিকমতো যত্নআত্তি করা হয়না, এসব কিছু হামিদ জানে। কিন্তু অশান্তি হবে ভেবে কখনও তার স্ত্রীকে কিছু বলে না। স্ত্রীকে অনেক ভালোবাসেন তাই ভাবেন হয়ত সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু সেই সময় আর আসে না।

হামিদ তার স্ত্রীকে কড়া কথা শোনান না তার একটা কারণ অবশ্য আছে- আছিয়ার বিয়ে হয়েছিল স্কুল পাশ করার পর। বিয়ের সময় কে কি এক কাণ্ড হয়েছিল তা আজও হামিদ ভুলতে পারে না।

বিয়ের দুইদিন আগে বিষ খেয়েছিল আছিয়া। স্কুলে থাকতে একজনকে ভালোবেসে ছিল সে। বাবা মা রাজি না হওয়ায় সে কিছুই করতে পারে নাই। সেই ছেলের কাছে বিয়ে না দিয়ে যোগ্য ছেলে হামিদকে বেছে নিয়েছিল আছিয়ার বাবা মা। আর আছিয়া বেছে নিয়েছিল বিষের পাত্র। হামিদ ছেলে হিসেবে ভাল, বাবার একমাত্র ছেলে, তা ছাড়া নতুন চাকরী পেয়েছে। এমন ছেলে বাদ দিয়ে কেউ মুদি দোকানদারের সাথে নিশ্চয় তার মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইবে না। আছিয়া যে ছেলের প্রেমে পড়েছিল সেই ছেলে স্কুলের পাশে একটা মুদি দোকান চালাত।

বাবা মায়ের সিদ্ধান্ত মানতে রাজি ছিল না আছিয়া, কিন্তু না মেয়ে উপায়ও ছিলনা, পালিয়ে যে যাবে সে সাহসও ছিলনা। তাই সহজ উপায় হিসেবে বিষের পাত্র হাতে তুলে নিয়েছিল।

কিন্তু সে যাত্রায় বেঁচে যায় আছিয়া।

এক সময় বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় তাকে, কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় বিয়ের পর। সামান্য কটু কথাও সহ্য করতে পারেন না, অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে, দেখে ভয় লাগে। সব চেয়ে বড় কথা কেন যেন স্বামী বাদে স্বামীর আর কোন আত্মীয়কে পছন্দ করতে পারে না সে।

কথায় কথায় রাত বাড়ে, মনে পড়ে রাতের খাওয়া হয়নি। আছিয়া সনিকে ডাক দেয়। আজ স্কুলে যাওয়া হয়নি, মমতাজের কাছে থেকে আঁখি খাতা এনে দিয়েছিল সেটাই দেখছে সনি। সারাদিনের কাজের পর ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়েছে। তাও জোড় করে শরীরটাকে ধরে রেখেছে পড়ার টেবিলে। সামনেই পরীক্ষা। এই সময়ে মামীর ডাক। কিন্তু এই ডাক অগ্রাহ্য করা তার পক্ষে সম্ভব না। টেবিল থেকে উঠে মামীর ঘরের দরজার সামনে দাড়িয়ে বলল, কি মামী?

খাবার বাড়, রাত কত হয়েছে খেয়াল আছে? একটা কাজও যদি নিজে করতে পারিস? সবই বলে দিতে হয় কেন?

সনি কোন কথা না বলে খাবার ঘরে চলে গেল। একটু পর খাবার ঘরে মামা, আঁখি মামী এসে যার যার চেয়ারে বসে পড়ল। সনি সবার পাতে পাতে খাবার দিতে লাগল। সবার খাবার খাওয়া শেষ হলেই সনি তার মায়ের জন্য খাবার নিয়ে যাবে। মা - মেয়ে একসাথে বসে খাবে। এটাই এই বাড়ির নিয়ম।

খাবার টেবিলে আছিয়া স্বামীকে লক্ষ্য করে বলল, কামালের কোন খবর আছে?

কামাল আছিয়া - হামিদের বড় সন্তান, শহরে থেকে পড়ালেখা করে। হামিদ কাল শহরে গিয়ে নিজের হজ্ব সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে কামালের সাথেও দেখা করে এসেছে। তাই বলল, ভালই আছে।

আছিয়া ডালের বাটি থেকে ডাল নিতে নিতে বলল, কতদিন ছেলেকে দেখিনা, ও আসবে কবে?

সামনেই পূজার ছুটি,  তখন এসে কিছুদিন থেকে যাবে। এখন ক্লাশ চলছে।

সনি খাবার দিতে দিতে ভাবল, ক্লাশ না ছাই, ও যে কি করে তা আমিই জানি।।


চার

কাসেম অনেকদিন পর তার বন্ধুর বাড়ি এলো।

তাহের বাড়ীতে বসে কয়েকটা ছবি দেখছিল। কাসেম সেখান থেকে একটি ছবি নিয়ে বলল, বাহ! ভালো হয়েছে তো ছবিটা। কার ছবি দোস্ত?

কাসেমের হাত থেকে ছবি নিয়ে তাহের বলল, এটা মাতব্বর বাড়ীর মেয়ে, হালিমা।
কাসেম পর পর সবগুলো ছবি দেখতে লাগল আর তাহের সবার বর্ণনা দিতে লাগল। কার চেহেরা কেমন, কে বিয়েতে কত টাকা দিবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

কাসেম লোকমুখে শুনেছিল তাহের বিয়ে করবে, তবুও নিজ কানে শোনার জন্য সে বন্ধুকে বলল, এত মেয়ের ছবি? কি ব্যাপার?

মা বাবা বিয়ে করাবে আমাকে, এগুলো পাত্রীর ছবি। রশিদ ঘটক দিয়েছে। দোস্ত , তোর খোঁজে ভাল কোন মেয়ে আছে?

আছে, কিন্তু তুই যেভাবে বলছিস, ঐ মেয়ের বাবা এই দিবে, ঐ দিবে সেই তুলনায় আমার খোঁজে যে মেয়ে আছে সে কিছুই না, চলবে?

তাহের আয়েশ করে বসে বলল, আমি বেশি কিছু চাইনা, বাবা হয়ত অনেক আশা করে। আমার চাওয়া মাত্র ত্রিশ হাজার টাকা। এটা দিতে পারলে আমার কোন আপত্তি থাকবে না, তা মেয়েটি কে?

কাসেম নিশ্চিত হল লোকমুখে যা শুনেছিল তাই ঠিক। তাহেরের সাথে কাসেমের খালাত বোন সনির মন দেওয়া নেওয়ার সম্পর্ক ছিল। দুই বছরের সম্পর্ক ছয়মাস আগে ভেঙ্গে গেছে, কিন্তু কাসেম বুঝতে পারে সনি কিছুতেই তাহেরকে ভুলতে পারে নি। তাহেরকে না পেলে হয়ত কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে। কিন্তু ত্রিশ হাজার টাকাও অনেক টাকা? এত টাকা সনির মা কিভাবে যোগাড় করবে?

তাহের ছবি দেখা বাদ দিয়ে কাসেমের দিকে তাকিয়ে বলে, কিরে চুপ হয়ে গেলি যে?

একথায় কাসেম সম্বিৎ ফিরে পায়। কৈ না তো, চুপ হব কেন? তুই ছবি দেখছিস তাই আমি বিরক্ত করিনি। তা এ কয়দিন দোকানে এলি না যে?

কাসেম তাহেরের সাথে মিলে ধানের ব্যবসা করে। কাজ বেশি কিছু না, বাড়ি বাড়ি ঘুরে ধানের দিনে ধান কিনে, শুকিয়ে গুদামে রাখে, যখন ধানের দাম বাড়ে তখন বিক্রি করে। লাভ ভালই হয়। তবে টাকা আটকা থাকে বেশ কিছু দিন, আর পুঁজিও লাগে বেশি।

তাহের কিছুটা লজ্জিত হয়ে বলে, মেয়ে দেখা নিয়ে ব্যস্ত আছি, কাল থেকে নিয়মিত যাব।

বিয়ে তাহলে করবিই, এত অল্প বয়সে?

অল্প দেখলি কোথায়? আর পড়াশোনাটাও করা হল না, কি আর করব, তার চেয়ে বিয়ে করে কিছু টাকা নিলে ব্যবসাটা দাঁড় করানো যাবে। এত কম টাকায় ব্যবসা করা যায়?

কাসেম কিছুটা রাগ নিয়ে বলল, তাই বলে যৌতুক নিবি? যৌতুক নেওয়া অপরাধ জানিস না? এর জন্য মামলাও হতে পারে, মামলায় জেল জরিমানা অনেক কিছু আছে।

মুখটাকে হাসি হাসি করে তাহের বলল, মামলাটা কে করবে শুনি, হবু শশুর? সে তো কখনই মামলা করবে না, মামলার চেয়ে কিছু টাকা খরচ করে যদি মেয়েকে পাড় করে দিতে পারে সেটাই তার চেয়ে ভাল, এছাড়া আর কে আছে বল, নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবে? আর দেশের যারা আইন বানায় তারাই আইনের বাইরের কাজ করে পাড় পেয়ে যায়, সেখানে আমরা কোন ছাড়।

তবুও তোর কথা মানতে পারলাম না, রাগি মুখ নিয়ে বন্ধুর  দিকে তাকিয়ে কাসেম বলতে থাকে, কে কি করল, সেটা দেখে তুইও তাই করবি?

দেখ কাসেম, স্রোতের বিপরীতে কে চলতে চায় বল? আর তা ছাড়া..

কাসেম উঠে বলে, তুই থাক তোর তাছাড়া নিয়ে, আমি চললাম, বাড়ি যাই, অনেক কাজ পড়ে আছে। কাসেম আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা হল।

পাঁচ

সনি আজ স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। আঁখির সকালে প্রাইভেট ছিল, সে সকালেই চলে গেছে। রাস্তায় যাওয়ার পথে লিপিদের বাড়ি। লিপি সনির বান্ধবী, ওখানেই তাহেরের থাকার কথা। সনি আজ তাহেরকে ওখানে থাকতে বলেছে।

সনি বার বার দেয়ালে টানানো ঘড়িতে সময় দেখছে। তাহেরকে যে সময়ে আসতে বলেছে সে সময় ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে। সনির চিন্তা হতে লাগল। তাহেরতো কখনও সময় নিয়ে এমন করেনি। অবশ্য ছয় মাসে অনেক কিছুই পরিবর্তন হতে পারে।

সনি বাড়ী ফিরে যাবে কিনা ভাবছে। তাড়াতাড়ি না ফিরলে মামী রাগ করতে পারে। তাহেরকে আজ কি বলবে তা মনে মনে আবারও আওড়িয়ে নিলো। দরজায় যেন কার ছায়া দেখা যাচ্ছে। অনেকদিন পর পরিচিত ছায়া। অনেকদিন পর দেখা, তাহের সেই আগের মতোই আছে। হঠাৎ তার ভয় হতে লাগল, সে ভাবল কাজটি কি সে ঠিক করছে? স্কুলে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়েছে। কিন্তু স্কুলে যাওয়া হচ্ছে না। আবার এটাও ভাবল এই মূহুর্তে স্কুলে যাওয়ার চেয়ে তাহেরের সাথে দেখা করাও জরুরী।

তাহেরকে দেখে সনি দীর্ঘক্ষণ কোন কথা বলল না, শুধু অপলক তাকিয়ে রইল। দীর্ঘ ছয় মাস পর দেখা। দুই বছর আগে যেমন হঠাৎ করে সম্পর্কটা তৈরি হয়েছিল ছয়মাস আগে সম্পর্কটা হঠাৎ সেইভাবেই ভেঙ্গে গেছে।

তাহের কিছুটা অবজ্ঞার স্বরে বলল, কি বলবে সনি তাড়াতাড়ি বল, আমার কাজ আছে।

তাড়া থাকলে চলে যাও, পরে কথা হবে। সনির নির্লিপ্ত কণ্ঠ।

তাহের চলে যেতে চায়, আবার কি মনে হতে বসে পড়ে, উদাস মুখে বলে, কি বলবে বল?

তুমি নাকি বিয়ের জন্য পাত্রী দেখছ, টাকা নিয়ে বিয়ে করবে?

কার কাছে শুনলে, কাসেমের কাছে? তাহের আশ্চর্য হওয়ার ভান করে উত্তর দেয়।

যেখানেই হোক শুনেছি, কথাটি সত্যি কিনা সেটা বল?

হ্যাঁ সত্যি, তাহের আর সনিকে ঘাটাতে চায় না।

সনি বলল, টাকা নিয়েই যদি বিয়ে করবে তাহলে আমাকে বিয়ে কর, আমার বাবার খোঁজ নেই বলে কি আমার মা এতই গরীব যে মেয়ের বিয়ে দিতে পারবে না?

তাহের এই কথার কি জবাব দিবে ভেবে পায়না।
সনি আবারও বলতে শুরু করল, তোমার হয়ত জানা নেই, মেয়েরা যাকে একবার ভালোবাসে তাকে কখনও ভুলতে পারে না, তোমরা ছেলেরা সহজেই ভুলে যাও, ভালোবাসাকে মনে কর পুতুল খেলার মতো। ইচ্ছে হল খেলা করলাম ইচ্ছে হল খেললাম না। কিন্তু মনে রেখ, মেয়েরা যাকে সত্যিকারে ভালবাসে তাকে সারাজীবন মনে রাখে।

তাহের এবার প্রতিবাদের সুরে বলল, কে বলল মনে রাখে? মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে তারা পূর্বের সব ভুলে যায়; তখন স্বামীই হয়ে উঠে সব থেকে প্রধান জন; আর সব মিথ্যা।

ওটাতো বাহিরের রূপ, সংসারে বেঁচে থাকতে হলে এমন অভিনয় করতেই হয়, কিন্তু তুমি যদি ঐ সব মেয়েদের অন্তরের রূপ দেখতে পেতে তবে বুঝতে সেখানে কতটা ক্ষত নিয়ে তারা বেঁচে আছে।

তাহেরের আর কিছু বলতে পারল না। চলে যেতে উদ্যত হল। সনি বাঁধা দিয়ে বলল, কোথায় যাচ্ছ? কথা তো শেষই হল না।

তাহের আবারও বসে পড়ল।

সনি এবার আদেশের স্বরে বলল, বাড়ি গিয়ে ভাল করে চিন্তা করবে। এরপর আমাদের বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাবে। মনে থাকবে তো? এবার যাও, তোমার অনেক সময় নষ্ট করলাম।

তাহের চলে যায়, সনি ভাবনায় পড়ে এত টাকা তার মা কোথা থেকে জোগাড় করবে?

ছয়

কাসেম মাকে আবারও তাড়া দেয়।

মনোয়ারা বেগম বড় ছেলের কাছে পরামর্শ চাইল, কিন্তু বড় ছেলের এত সময় নেই মায়ের সাথে এই বিষয়ে কথা বলার। তার নাকি তাড়া আছে। এসব বৈষয়িক কথা শোনার সময় ও ধৈর্য্য কোনটাই নাই। মনোয়ারা ভাবেন তার এই ছেলেটা যেমন কেমন, বাবার মতো হয়েছে, বৈষয়িক কোন কথাতেই থাকতে চায় না।

মনোয়ারা অগত্যা ছোট ছেলের কাছে যায়। হাসেম এবার কলেজে পড়ে, সে সব শুনে বলল, ছোট ভাই তো ঠিকই বলেছে, আমাদের উচিত প্রাপ্যটা নিয়ে আসা। কাদের জন্য ছাড় দেব, ঐ মামীর জন্য? কিন্তু তারা আমাদের জন্য কি করেছে? তোমার মনে নেই আমার পরীক্ষার সময় কি করল?

মনোয়ারা বেগমের সবই মনে আছে, চোখের সামনে সব ভেসে উঠল-

হাসেমের তখন এসএসসি পরীক্ষা। পরীক্ষার কেন্দ্র পড়েছে শহরে। মামার বাড়ী থেকে শহরে যাওয়া সহজ। তাই মনোয়ারা ছেলেকে পাঠালো মামার বাড়ী। ওখানে থেকে পরীক্ষা দিতে। হাসেম রাতে পৌঁছাল মামার বাড়ী।

মামী হাসেমকে দেখে ও কথা শুনে বলল, তুমি এসেছ ভালই হয়েছে, কিন্তু তোমাকে কোথায় থাকতে দেই? ও ঘরে সনি আঁখি, আর এই ঘরে কামালের সাথে আমার চাচাত ভাই এসেছে ও থাকে। ওখানে ছোট খাট, ওদেরই কষ্ট হয়, সেখানে তুমি থাকবে কোথায়?

হাসেম সব বুঝতে পারে, হাসিহাসি মুখ করে বলে, সমস্যা নেই, বন্ধুরা শহরে বাসা নিয়েছে ওখানে থাকতে বলেছিল, আমি ভাবলাম মামার বাড়ির কাছে বাসা নিলে লোকে কি বলবে? আগে কি জানতাম এখানে সমস্যা হবে?

হাসেম আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মামার বাড়ী থেকে রাতেই চলে আসে। এ কথা কি কখনও ভুলে যাওয়া যায়? আর যে ছেলেকে চাচাত ভাই বলে পরিচয় দিয়েছিল তার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জেনেছিল, সে ছিল অনেক দূর সম্পর্কের চাচাত ভাই। নিজের ভাগ্নেকে যাতে না রাখতে হয় তাই এই ব্যবস্থা।

হাসেমের মনে পড়ে কথাগুলো। মাকে জোড় গলায় বলে, এমন আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক না রাখাই মঙ্গল। যা পার মিটমাট করে নিয়ে আসো।

মনোয়ারা ভাবল, তার ছোট ছেলেটাও দেখি দিন দিন বৈষয়িক হয়ে উঠছে।

একদিন ছুটির দিন দেখে মনোয়ারা মেঝ ছেলে কাসেমকে নিয়ে বাবার বাড়ি এলো। উঠানে ধান শুকাতে দেওয়া হয়েছে, সনির মা একপাশে বসে পাখি তাড়াচ্ছে। এতদিন পর বড় বোনকে দেখে খালেদা হাউমাউ করে কেঁদে দিল।

কান্না শুনে ঘর থেকে বের হয়ে এল আছিয়া। বাইরে এসে দেখে মনোয়ারা ছেলেকে সাথে নিয়ে দাড়িয়ে  আছে। মুখে শুষ্ক হাসি ফুটিয়ে বলল, ভালো আছেন আপা? ভেতরে আসেন।

মনোয়ারা জবাব দিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। হামিদ মাস্টার বাড়িতেই ছিল। ভাইকে বাড়িতে দেখে বুঝতে পারল, আছিয়ার হাসি মুখের রহস্য কি।

দুই ভাইবোনে অনেক কথাই হল। আছিয়া সেই সময়টা রান্না ঘরেই কাটালো। কয়েকদিন আগে সে কানাঘুষায় শুনেছে কাসেমরা নাকি সম্পত্তির ওয়ারিশ চায়। তাই এবার যখন কাসেমের মা বাবার বাড়িতে এল তখন স্পষ্টই বুঝতে পারলো তাদের আগমনের উদ্দেশ্য। রান্না ঘরে যাওয়ার উদ্দেশ্য একটাই, যদি ভাল মন্দ রান্না করে খাইয়ে তাদের মন রক্ষা করে সম্পত্তি বাঁচানো যায়।

সনি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখে কাসেম ভাই এসেছে। আজ তার পরীক্ষা ছিল, পরীক্ষা শেষ করেই বাড়ি এসেছে। মনোয়ারা বলল, কিরে কেমন আছিস, পড়াশোনা কেমন চলছে?

সনি খুশি মনে বলল, চলছে ভালই, এইতো পরীক্ষা দিয়ে এলাম, আজও পরীক্ষা ছিল। এরপর খালাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে কাসেমকে বলল, ভাইয়া তোমার সাথে কিছু কথা আছে। আমার ঘরে একটু আসতে পারবে?

কাসেম সনিকে ছোট বোনের মতো ভালবাসে, শুধু বাসে বলা যায় না, একটু যেন বেশিই ভালোবাসে। কাসেমরা তিনভাই তাদের কোন বোন নেই, তাই বোনের জায়গাটা কাসেম সনিকেই দেয়। যদিও মামী বিষয়টা ভালো চোখে দেখে না কিন্তু কাসেমকে কিছু বলতেও পারে না। মামী ভয় পায় তাকে।

কাসেমকে সঙ্গে নিয় বাইরের মাচায় গিয়ে বসে সনি। স্কুল থেকে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে এসেছে সে। বাড়ির বাইরে চমৎকার করে মাচা পাতা আছে। এ বাড়ির দক্ষিন পাশে ছোট্ট একটা পুকুর, পাড়ে কিছু গাছপালা, সেই গাছের নিচে মাচা পাতা।

কাসেম যতই মনে মনে ভালোবাসে বাইরে সেটা প্রকাশ করে না। সবসময় রাগত স্বরে কথা বলা তার অভ্যাস, বিশেষ করে সনির সাথে, সেই ঝাঁঝেই বলল, কি বলবি বল?

কিভাবে বলব বুঝতে পারছি না, আগে বল, এখন যা বলব তা কাউকে বলবে না?

কি এমন কথা? যা শুনতে পারব, কিন্তু কাউকে বলতে পারব না? ঠিক আছে বল, কাউকে বলব না।

বলতে চাইছিলাম তোমার বন্ধু তাহেরের কথা, কিন্তু তুমি কিছু মনে করতে পারবে না।

কেন কি করেছে তাহের? কিছুটা অবাক হওয়ার ভান করে তাহের। সনি যদি আজ তাহেরের কথা না বলত তাহলে কাসেমই এই প্রসংগে কথা বলত।

কিছু করেনি, তবে সমস্যা অন্যখানে। সনি বলবে কিনা তা এখনও ঠিক করতে পারেনি, তার মুখে আলো ছায়া খেলা করছে, কাসেম চুপ করে থেকে সনিকে গুছিয়ে নিতে দিল।

সনি নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করল-

ভাইয়া তোমার হয়ত মনে নেই, বছর দুই আগে তাহের ভাইকে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছিলে। দুইদিন ছিল, কিন্তু সেই দুই দিনেই আমার মনটা কেড়ে নিয়েছিল। এরপর মাঝে মাঝেই দেখা হত, কথা হত। এক সময় সে আমাকে জানায়, আমাকে ভালবাসে। আমি কি যে খুশি হয়েছিলাম তা বলার বাইরে। আসলে ছোট বেলা থেকে যেভাবে বড় হয়েছি, তাতে ভুলেই গিয়েছিলাম আমিও ভালবাসা পাওয়ার যোগ্য।

মুখে অবশ্য কিছু বলি নাই। কিন্তু মনের ভাষা তো লুকিয়ে রাখা যায় না, একদিন না একদিন বের হয়ে পড়েই। তাকে অনেক বুঝিয়েছিলাম, বলেছিলাম আমাদের দুইজনকে মানায় না। কিন্তু ও কিছুতেই মানতে আগ্রহী ছিল না। আমিও ভালবাসতাম তাই কড়া বলতেও পারতাম না। দুইবছর ভালই কাটল, মাঝে মাঝে স্কুলে যাওয়ার সময় দেখা হত। কথা হত, স্বপ্ন দেখতাম। চিঠিতে রোজ যোগাযোগ হত।

মাস ছয়েক আগে একটা তুচ্ছ ঘটনা থেকে সম্পর্কটা ভেঙ্গে গেল। ভেঙ্গে গেল! কথাটা যত সহজেই উচ্চারণ করতে পারলাম তা কি এত সহজে ভেঙ্গে ফেলা যায়? কই এত চেষ্টা করেও তো ভুলতে পারলাম না

এখন শুনলাম ও নাকি বিয়ে করবে। তাই থাকতে না পেরে দেখা করলাম, শুনলাম টাকা নিয়ে বিয়ে করবে। আমি যদি টাকা দিতে পারি তবে ও আমাকেই বিয়ে করবে। সমস্যা হল ত্রিশ হাজার টাকা কোথায় পাবো?

ভাইয়া, মামা, খালাকে বলে কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পারবে? না হলে...

না হলে কি করবি শুনি?

না হলে এ জগতে আর থাকা হবে না হয়ত। কি হবে এই ব্যর্থ জীবন নিয়ে?

কাসেম চুপ করে রইল, সনি তাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বাড়ির ভেতর চলে গেল।


মনোয়ারা বেগম তার অপ্রিয় অথচ সত্য কথাটি বলে ফেলল। অনেকক্ষণ যাবৎ তারা মা-ছেলে এই বাড়িতে এসেছে অথচ একবারও আছিয়া খাওয়ার কথা বলে নি। ভাবীর কাছে এমন আদরই প্রত্যশা ছিল মনোয়ারার, এর চেয়ে বেশি পাবে তাও আশা করে না। অনেক দিন ধরে দেখে আসছে। তারপরও মাঝে মাঝে রাগ লাগে।

সবাই মিলে বসার ঘরে বসে আছে। মনোয়ারা হামিদের উদ্দেশ্য বলল, কাসেমের ব্যবসার জন্য টাকার দরকার, আমার ভাগের জমিটুকু দিলে বিক্রি করে ওকে টাকা দিতে পারতাম। হামিদ কিছু একটা কর, শুনলাম তুই হজ্বে যাবি, যাওয়ার আগে একটা কিছু ব্যবস্থা কর।

ঝড়ের সময় আকাশে যেমন বিদ্যুৎ চমকায়, তেমনি হামিদও চমকে গেল। লোকমুখে এমন কিছু একটা শুনেছিল, ভেবেছিল হজ্ব করে এসে পরে এক সময় টাকা জোগার করে বোনদের ভাগের টাকা দিয়ে দিবে। কিন্তু এখন এই সময়ে এভাবে বোনরা তাকে ধরবে তা ভাবতেও পারে নাই।

হামিদ বোনকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপা, বাবার সম্পত্তিতে তোর অধিকার আছে, তোর অংশ তুইই নিবি, তবে আমাদের এলাকায় কেউ কোনদিন বাবার বাড়ির ওয়ারিশ নেয়নি। লোকে শুনলে কি বলবে?

মনোয়ারা শান্ত স্বরে বলল, লোকের কথা শুনলে তো আমার চলবে না, এখন সমস্যায় পড়েছি, না হলে কি আর বাবার সম্পত্তি নেই?

হামিদ কি বলবে ভেবে পায় না, সে তার স্ত্রীর দিকে তাকায়। আছিয়ার মুখ দেখে মনে হয় কে যেন একপ্রস্থ কাঁদা মেখে দিয়েছে।

মনোয়ারা আবার তাগাদা দেওয়ার স্বরে বলে, চুপ করে রইলি, কিছু একটা বল। হামিদ কিছু না বলায় মনোয়ারা বলল, বাবার বাড়ির সম্পত্তি আমাদের এলাকায় কেউ নেয়নি এটা ঠিক। কিন্তু আমি তো আর অদরকারে নিচ্ছি না। এখন টাকার দরকার তাই নিচ্ছি। তবে কি দরকার তা আর বলল না মনোয়ারা, হামিদও জিজ্ঞেস করল না।

তাহলে আমি কি জমির বেচার জন্য লোক খুঁজব না তুই কিনে রাখবি?

হামিদ এবার কথা খুঁজে পায়। সে বলতে থাকে, এভাবে হঠাৎ কোন কাজ হয় নাকি? আগে হিসাব নিকাশ করতে হবে, তাছাড়া হঠাৎ বললেই কেউ জমি কিনে নিবে নাকি, রেকর্ড কার নামে আছে, এসব বিষয় আগে দেখতে হবে। তাছাড়া কে কিনবে দাম কেমন দিবে তাও জানতে হবে।

কাসেম এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার বলে উঠল, ও নিয়ে চিন্তা করবেন মামা, হিসেব তো একদম সোজা। আপনি আর আপনার তিন বোন, তাহলে পাঁচ ভাগের দুইভাগ আপনি আর একভাগ করে বোনেরা পাবে। আর যদি বর্তমান আইনে যাই তাহলে সবাই সমান সমান, আমরা এটা চাইনা, তাই ঐ পাঁচের এক দিলেই চলবে। আর আমি খোঁজ নিয়েছি, আমরা যা পাব তার বাজার দর হিসেব করলে প্রায় সত্তর হাজার টাকার মতো হবে। তাছাড়া জমির দাম যত দিন যায় ততই বাড়ে।

হামিদ তার ভাগ্নেকে দেখলেন, পড়ায় যদি ততটা ভাল না তবে হিসেবে যে অনেক পাকা তা বুঝতে পারলেন। সে কিছুটা অসহায় বোধ করলেন। মৃদু গলায় বলল, এখন হঠাৎ করে জমি বিক্রি করতে গেলে কেউ তো এত দাম দিয়ে কিনতে চাইবে না। তাই বলছিলাম কি, আমি তোদের পঞ্চাশ হাজার টাকা দেই, তোরা দাবি ছেড়ে দে।

কাসেম আর কিছু বলল না। হামিদ দেখল আছিয়া তার দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে আছে, সে কটমট চোখকে আগ্রহ্য করল। এছাড়া কি আর করার আছে তার।

ঠিক হল, সামনের সপ্তাহেই টাকা দেওয়া হবে। মনোয়ারা কাসেমকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা হল। তার ইচ্ছে ছিল একদিন থাকার। কিন্তু কেউ তাকে থাকতে বলল না।

উঠোনে ধান শুকোতে দেওয়া হয়েছে। ধান শুকানোর কাজ প্রায় শেষ। সনি আর তার মা মিলে সেগুলো ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। মনোয়ারা বোনের কাছে গিয়ে বলল, খোদেজা যাই।

খোদেজা সব কথাই হাউমাউ করে বলে, শুনলে মনে হয় কেঁদে কেঁদে বলছে। সে মনোয়ারাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আবার আসবে তো? মনোয়ারা কোন জবাব না দিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালো।

কাসেম সনিকে ডেকে বলল, তাহেরকে বল, প্রস্তাব পাঠাতে।

কিন্তু টাকা? সনির মুখে সংশয় নিয়ে প্রশ্ন করল।

ওটা নিয়ে চিন্তা করিস না, একটা না একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে। তাছাড়া মামা আছেন না।

মামা আছেন না, এই কথা শুনে সনি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

সাত

কামালের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা। আছিয়া ছেলের চিন্তায় অস্থির। পরীক্ষা শুরু হল কিনা, কেমন হল, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে চিন্তা করছে। স্বামীকে অনেকবার বলল খোঁজ নিয়ে আসতে।

একদিন দিন ভাল দেখে হামিদ শহরের দিকে রওয়ানা হল। বাড়ি থেকে মাত্র বের হয়েছে এমন সময় দেখে কয়েকজন ছেলে মিলে কামালকে ধরে নিয়ে আসছে। কামাল অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাড়াতাড়ি সবাই মিলে হাসপাতালের দিকে নিয়ে গেল।

দুইদিন পর ডাক্তাররা জানাল, অতিরিক্ত মদ্য পানে এ অসুখ হয়েছে। একথায় আছিয়া হামিদ দুইজনই বিস্মিত হল। এটা কেমন কথা, তার ছেলে এমন হতেই পারে না। কিন্তু পরে খোঁজ নিয়ে জানাল এটাই হয়ে আসছে। কামাল শহরে পড়তে যাওয়ার পর থেকেই এসব নেশা করে আসছে।

কামালের অসুখ অনেক বড় পর্যায়ে চলে গেছে। এর চিকিৎসা চালাতে হবে দীর্ঘদিন ধরে, আর বেশ খরচও করতে হবে। তাও শেষ পর্যন্ত ভাল হবে কিনা তাও বলা যাচ্ছে না। হামিদ তাতেও রাজি।

তাহেরের বাড়ি থেকে প্রস্তাব আসল। সনিকে তাদের পছন্দ। কিন্তু সমস্যা হল ছেলেকে ত্রিশ হাজার টাকা দিতে হবে। এত টাকা কে দিবে। হামিদ সব শুনে বলে দিল এত টাকা দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। পাত্রপক্ষও টাকা ছাড়া ছেলে বিয়ে করাবে না। শেষে বিয়ে ভেঙ্গে যায় আর কি।

এই সময়ে সনি সাহসী হয়ে সবার সামনে এসে বলে, টাকা আমি দেব।

সনির কথায় কিছু একটা ছিল, তাই কেউ কিছু বলতে পারল না। ঠিক হল, সামনের সপ্তাহেই বিয়ে হবে।

অতিথিরা চলে গেলে হামিদ ভাগ্নীকে বলল, তুই টাকা পাবি কই?

সনি চোখে কৌতূহল নিয়ে বলল, কেন মামা তুমি দিবে। ভাগ্নীর প্রতি একটা দায়িত্ব আছে না? এর উত্তরে হামিদ কোন কথা না বলে বাইরে চলে গেল।

কাসেম টাকা নিতে এসে শুনল সনির বিয়ে ঠিক হয়েছে। সনি আরও জানাল এখন সমস্যা একটাই টাকা। তোমার কথা মতোন মামাকে বলেছি টাকার যোগাড় হয়ে যাবে। কিন্তু এত টাকা আমি কোথায় পাব? কাসেম একথার উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।

এক সপ্তাহ পর বিয়ে। কিন্তু হামিদের কোন উদ্যোগ নেই। সে ভাবছে সনিকে অপমানিত করার এই তো সময়, তার মুখের উপর কথা বলে, কি সাহস মেয়েটার! ওকে এবার একটা শিক্ষা দিতে হবে।

বিয়ের অনুষ্ঠানে বেশি লোক হয়নি। সবাই মনে হয় জানে যে বিয়ে হবে না। এত টাকা এখনও সনি যোগাড় করতে পারে নাই।

বর পক্ষ চলে এসেছে। খাওয়ার আয়োজন সামান্য। খেয়ে বিয়ে পড়ানোর কথা উঠল। বিয়ের সময় টাকার কথা উঠল। টাকার কথায় সনি সহ তার বাড়ির সবাই চুপ। কেউ কোন কথা বলছে না। বাড়ির মাতব্বর হিসেবে হামিদের একটা দায়িত্ব আছে। সে তাহেরের বাবার কাছে বলল, টাকার যোগাড় হয়নি, কয়েকদিন পর টাকা দিলে হয় না?

তাহেরের বাবা রাগত স্বরে বলল, টাকা নেই তো বিয়েও হবে না। যেদিন টাকার যোগাড় হবে সেদিন খবর দিবেন, এসে ছেলেকে বিয়ে করে নিয়ে যাব। কথা শেষ করে চলে যেতে উদ্যত হল।

এমন সময় বাড়ির ভেতর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে এল। এই সময় কাসেম এগিয়ে এসে বলল, আমার একটা কথা আছে।

হামিদ ভাগ্নেকে ধমক দিয়ে বলল, মুরুব্বিদের মাঝে তোর আবার কি কথা? তুই তো নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। অন্যের কথা চিন্তা করার সময় কই তোর? তোরা মা-বেটা মিলে সম্পত্তি নিয়ে যা করলি তাতে তো আমার মাথা হেট হয়ে গেছে। সুযোগ পেয়ে আজ দুকথা শুনিয়ে দিল।

না মামা, আজ আমি বলব সবাই শুনবে। বসতে বললেই তো আর বসা যায় না। বসলে যে সব থেমে যাবে। আমার কথাটি শুনুন তার পর না হয় বিচার করবেন আমি কথা বলতে পারব কি পারব না।

হামিদ কিছুটা শান্ত হয়ে ভাগ্নেকে বলল, বল কি বলবি?

কাসেম দৃঢ় গলায় বলল, এই বিয়ে হবে।

সবাই কথা শুনে বিরক্ত হল। বিশেষ করে তাহেরের বাবা, সে বিরক্ত কণ্ঠে বলল, বিয়ে হবে কিন্তু টাকা? তাহের তো‌মার বন্ধু হতে পারে, তাই বলে আমি আমার ছেলের বিয়ে টাকা ছাড়া দিতে পারব না।

কাসেম বলল, বিয়ে হবে এবং টাকাও দেওয়া হবে।

হামিদ আবার বিরক্ত মাখা কণ্ঠে বলল, টাকা কি তুই দিবি??

কাসেম পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে বলল, হ্যাঁ আমিই দেব। নিন গুনে নিন, পুরো ত্রিশ হাজারই আছে।

অবস্থা দেখে সবাই বিস্মিত হয়ে পড়ল। এই ছেলেই মায়ের সাথে মিলে নানার বাড়ীর ওয়ারিশ নিয়ে গেল আর সেই ছেলেই কিনা খালাত বোনের বিয়ের জন্য টাকা দিচ্ছে? এও কি সম্ভব? যে কিনা সামান্য কয়েকটি টাকার জন্য নানার বাড়ীর সাথে সম্পর্ক শেষ করে সেই আবার কি করে এত টাকা খালাতো বোনের জন্য বের করে?

কাসেম টাকাটা তাহেরের বাবার হাতে দিয়ে কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাইরে চলে এল। আসতে আসতে শুনতে পেল মামা বলছে, টাকাটা আমিই দিতে পারতাম, এমন কি দুইদিন পর দিতামও। মাঝখান থেকে ছেলেটা ডাঁট দেখিয়ে গেল ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন সময় কেউ একজন এসে হামিদের কাছে হাসপাতালে রাখা তার ছেলের খবর দিল। খবর দিতে যে ছেলেটি এসেছে তার কণ্ঠে কিছু একটা ছিল, তাই খবর শুনে আছিয়া কাঁদতে লাগল।

কাসেম দ্রুত পা চালালো। তার কাজ শেষ। যাদের সাথে সম্পর্ক শেষ করেছে তাদের আর কোন খবর শুনতে চায় না সে। কিন্তু কানে কান্নার আওয়াজ প্রাকৃতিকভাবেই চলে আসল।

মহসীন হল টু মোহনগঞ্জ (১৩/০৯/২০০৪- ২৪/০৯/২০১৪)
(লিখেছিলাম সেই ২০০৪ সালে, পুরনো খাতা ঘাটতে গিয়ে পেয়ে গেলাম, আজ ডিজিটালি প্রকাশ করলাম)
আপনার মন্তব্য লিখুন

ফেসবুক লাইক ও শেয়ার